একুশ দিনের গল্প - ৫ম(শেষ)

পাঠকের জন্য এর আগের পর্বের লিংকঃ একুশ দিনের গল্প - ৪র্থ  

****************************************************************************************

আম্মাকে অর্থোপেডিক ইউনিট থেকে বের করে নিয়ে যাবার সময়টাতে সারা করিডোর জুড়ে অসংখ্য মানুষের ঢল নামলো। ইউনিট হেড থেকে শুরু করে অন্যান্য সিনিয়ার ডাক্তার, জুনিয়ার ডাক্তার, স্টেশন নার্স, সিস্টার, নার্স অ্যাটেন্ডেন্ট, রুম সার্ভিস স্টাফ, ডায়েটারি স্টাফ, সকলে এসে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আম্মাকে এমন ভাবে দেখতে থাকলো যেন এটাই শেষ দেখা। ভয়ে আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। 

অক্সিজেন মাস্ক সরিয়ে অসহনীয় শ্বাস কষ্টের মধ্যেও আম্মা বলতে থাকলো, আই সি ইউ তে যে একবার যায় সে আর ফেরত আসে না। আমি তো তোমাদের কিছুই বুঝিয়ে দিয়ে গেলাম না। ভেতর থেকে ডুকরে ওঠা কান্নার বেগ থামিয়ে আমি আম্মাকে বললাম, আম্মা শান্ত হও। নিশ্চয় তুমি খোদা তা'লার কৃপায় সুস্থ হয়ে ফেরত আসবা।

যেদিন দুপুরে আম্মাকে আই সি ইউ তে নেয়া হল, সেই দিন বিকাল, সন্ধ্যা, রাত কিভাবে কাটলো জানিনা। সব কিছু ভুলে আল্লাহ্‌র কাছে খালি আম্মার জন্য প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছি। সেদিন সন্ধ্যার সময় আম্মাকে পাঁচ মিনিট দেখার সুযোগ মিলল। সেও এক বিরাট প্রস্তুতির ব্যাপার। মাথা থেকে পা পর্যন্ত হসপিটাল গাউন পরে আইসিইউ এর ভেতরে ঢুকতে হয় এবং সময় মাত্র দু'তিন মিনিট। আমরা দুই বোন পালা করে ঢুকলাম। দেখলাম আম্মাকে ভেন্টিলেটরে রাখা হয়েছে। আম্মা কোনো কথা বলার অবস্থায় ছিলোনা। শুধু চোখ খুলে তাকিয়ে আমাদের উপস্থিতি টের পেয়েছে। আইসিইউ ইনচার্জ ডাক্তার বলল, এখনো পর্যন্ত কিছুই বলা যাচ্ছেনা আম্মার অবস্থা কোন দিকে যাচ্ছে তবে আরো কিছু টেস্টের পর আমাদের জানানো হবে।

দুশ্চিন্তা আর দুঃস্বপ্ন নিয়ে প্রথম রাতটা কাটালাম। ভোরের দিকে বালিশের পাশে রাখা ফোনটা যেই বেজে উঠলো আর তাতে ইউনাইটেড হাসপাতাল নাম আসলো, আমার বুকের ভেতর জোরে জোরে কেউ যেন হাতুরি দিয়ে বাড়ি মারতে লাগলো। ওপাশ থেকে সিস্টার এর গলার স্বর ভেসে আসলো। আপনার আম্মা উনার তিন মেয়েকে দেখতে চাইছে আর এখনি আসতে বলছে। নাহলে উনি কোন টেস্টে যাবেন না। সিস্টারকে বললাম আম্মার কানে ফোনটা ধরতে আর আমি আম্মাকে বুঝিয়ে বললাম, আমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে আসবো। মেজো আপা অন দা ওয়ে। আম্মা যেন কোনো টেস্টে বাঁধা না দেয়।      

মেজো আপা খবর পেয়ে সাথে সাথেই লন্ডন থেকে রউনা হয়ে গিয়েছিল। সে প্লেনে বসে সারা রাস্তা নিজেকে সামলিয়েছে আর অনবরত দোয়া করেছে। পরের দিন ঢাকায় পৌঁছালে আমরা তিন বোন মিলে আম্মাকে দেখতে গেলাম। আম্মা আমাদের তিনবোনকেই আলাদা আলাদা করে বললেন, যে তিনি আইসিইউতে থাকতে চান না, তার রুমে যেতে চান। কড়া কড়া ওষুধের ঘোরে, আধো ঘুম আধো জাগরণে, আম্মা বুঝতে পারছিলেন না যে বিপদ এখনো কাটেনি। তিনি আউট অফ ডেঞ্জার হননি।  

আইসিইউ হেড ডাক্তার আমাদেরকে ব্রিফিং এর জন্য ডেকেছিল। ডাক্তার ম্যাডামের কাছ থেকে জানতে পারলাম, আম্মার ফুস্ফুসে দুটি ভিন্ন ধরনের ইনফেকশন হয়েছে যা কিনা চার রকমের অ্যান্টিবায়োটিক এর ককটেল দিয়ে সারাতে হবে। তবে কোনো চিকিৎসাই ফুল প্রুফ নয়। জীবনরক্ষাকারী লাইফ সেভিং ড্রাগস এর ক্রিয়া যেমন আছে, তেমনি প্রতিক্রিয়াও আছে। কার শরীরে কোনটা কাজ করবে বা করবে না, তা সময় গেলেই একমাত্র বোঝা সম্ভব।

খুব ছোট বেলায় বাবাকে হারানো অসহায় তিনটা বোন তাদের একমাত্র মাথার ছায়া, তাদের ভালোবাসার কেন্দ্রবিন্দু, মায়ের জন্য আল্লাহতা'লার কাছে আকুতি করে হাত তুলল। আম্মার রোগ মুক্তি ও সুস্থতা কামনা করে হাত তুলল তাঁর নাতি নাতনি, মেয়ে জামাই, নাত জামাই, দেশে বিদেশে ভাইবোন, তাদের পরিবার পরিজন, আত্মীয়স্বজন,  চেনা পরিচিত যারাই আম্মাকে চিনে, সকলে। আল্লাহ্‌ তা'লা সবার দোয়া কবুল করলেন। উনার অশেষ কৃপায় এবং উনার অনুমতিতে চার দিনের কঠিন সময় পার করে আম্মা আমাদের মাঝে ফেরত এলেন। 

চারদিন পরে আম্মাকে আইসিইউ থেকে রিলিজ করে রেগুলার ওয়ার্ডে নিয়ে আসা হল। বাড়ি যাবার জন্য তিনি ছাড়া পেলেন আরো এক সপ্তাহ পরে। তবে হাসপাতালে থাকাকালীন এর মধ্যে তিনি তাঁর তিন মেয়ের সাথে অচিন্তনীয় একটি অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করলেন। শেয়ার করলেন অবর্ণনীয় সুন্দর একটি জায়গার কথা যেখান থেকে তিনি এই দুনিয়াতে আবার ফেরত এসেছেন। 

দুবছর আগে একটা ব্লগ লিখেছিলাম, ওপারের কাছাকাছি - লিংক।  ব্লগটা ছিল Near Death Experience বা মৃত্যুর কাছাকাছি যাদের অভিজ্ঞতা হয় সেই সব মানুষদের নিয়ে লেখা। তখন গুনাক্ষরেও জানতাম না, এমন একটা অভিজ্ঞতা আমার খুব কাছের একজন মানুষের হবে। 

এপার আর ওপারের মাঝে এমন কিছু সময় আছে যা একদম আমাদের বোঝার বাইরে। যেই সময়টাতে নির্ধারিত হয়, কে ওপারে প্রবেশের অনুমতি পাবে আর কে না পেয়ে  আবার এপারে ফেরত আসবে।

মা আমাদের বলতে শুরু করলেন - ছোট ছোট তিনটা পাহাড়। পাহাড় কখনো এতো সুন্দর হয় আমার জানা ছিলোনা। চারিধারে গাছ গাছালিতে ভরা। গাছগুলোর চিরল সবুজ পাতা লম্বা লম্বা হয়ে নুয়ে পড়েছে। আর সেই পাতার ফাঁকে ফাঁকে ঝুমকো ঝুমকো ফুল। ফুলগুলি থেকে এক ধরনের লাল আভা বের হচ্ছে। চারিদিকে শান্ত, স্নিগ্ধ, প্রশান্তির আমেজ। 

একটা ছোট হলুদ কার্পেটের উপর দিয়ে হেঁটে আমি পাহাড়ের কাছে গেলাম আর পাহাড়ের গায়ে সিঁড়ি বেয়ে আস্তে আস্তে উপরে উঠতে লাগলাম। উপরে উঠে আমি চারিদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছি কিন্তু কারোর দেখা পাচ্ছিনা। জায়গাটা খুবই নির্জন।

কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করার পর মনে হল কে যেন আমার হাত ধরে নীচে নামিয়ে আনছে। কিন্তু সে অদৃশ্য কেউ, তাকে দেখা যাচ্ছেনা। সিঁড়ি দিয়ে সে ধীরে ধীরে আমার হাত ধরে আমাকে নামিয়ে আনলো। তবে এবার দেখলাম, হলুদ কার্পেটটার উপর একটা সবুজ কার্পেট। আমি যখন নামছি তখন দেখলাম সবুজটার নীচের ঐ হলুদ কার্পেটের ভেতর থেকে সোনালি আভা বের হচ্ছে। আমি অদৃশ্য কারো হাত ধরে পাহাড় থেকে নীচে নেমে এলাম। তারপর আর কিছু মনে নেই।

বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে Near Death Experience  কি কারনে ঘটে বা কার কার ক্ষেত্রে ঘটে তার কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা নেই। ছোট বাচ্চা থেকে বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত যে কোনো মৃত্যু পথযাত্রী রোগী বা অ্যাকসিডেন্ট এর কারনে অবচেতন হয়ে যাওয়া যে কারো ক্ষেত্রে এটা ঘটতে পারে। তবে সবার জীবনে এটা ঘটেনা। যাদের জীবনে ঘটে তারা সাধারনত সেটা শেয়ার করেন পরিবার পরিজন ও বন্ধুদের সাথে। যারা NDE থেকে ফেরত আসে তারা পরবর্তী জীবনে অনেক সময় খুবই ধার্মিক বা সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসী হয়ে যায়। তাদের কাছে জীবনের সংজ্ঞা হয়ে যায় অন্যরকম। দ্বিতীয় জীবন পাওয়ার মূল্য তারা অনুধাবন করে গভীর আবেগে। 

চিকিৎসা বিজ্ঞানে মিরাকেল বলে একটি কথা আছে। চিকিৎসা বিজ্ঞান কোনো এক জায়গায় এসে 'বিশ্বাসের' কাছে পরাজয় স্বীকার করে। যে বিশ্বাস, আমাদের যিনি সৃষ্টি করেছেন তাঁর প্রতি। যিনি জন্ম ও মৃত্যুর মালিক, তাঁর প্রতি। হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেলে  চিকিৎসকরা অবিরাম সি-পি-আর দিয়ে চেষ্টা করে রোগীর জান ফিরিয়ে আনার জন্য। কোমায় যাওয়া রোগীর ক্ষেত্রে, ডাক্তাররা পরিবার পরিজনদের বলে অনবরত প্রার্থনা করতে। ওপারে কি সিদ্ধান্ত হচ্ছে কেউতো তা সঠিক ভাবে জানেনা, হয়তো রোগীটি ফেরত আসবে। 

যেখানে জীবনের শেষ সেখানেই মৃত্যুর শুরু নয়। এই দুটোর মধ্যেখানে এমন একটি জায়গা আছে যা একদমই আমাদের অজানা। এপার আর ওপারের মাঝামাঝি - এক অচিনপুর। যিনি আমাদের এপার থেকে ওপারে পারাপার করেন, তিনি কারো নির্দেশে এটা করেন। হয়তো কখনো কখনো এই নির্দেশ বদল হয়, সিদ্ধান্ত বদল হয়। ওপারের কাছাকাছি এসে যাত্রীটি জানতে পারে, তার সময় এখনো আসেনি। ওপারে প্রবেশের অনুমতি মেলেনি। যাত্রীটিকে আবার এপারে পৌঁছে দেয়া হয়। এটাই বিজ্ঞানের ভাষায় মৃত্যুর কাছ থেকে ফেরত আসা যার সুনির্দিষ্ট কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা কেউ দিতে পারেনা। 

চার দিনের জীবন যুদ্ধ শেষে আইসিইউ থেকে আম্মা আমাদের মাঝে ফেরত এলেন। সঙ্গে করে নিয়ে এলেন অবিস্মরণীয় এবং ব্যাখ্যা করা যায় এমন একটি অভিজ্ঞতা, যা তিনি মনে রাখবেন আজীবন । বারে বারে স্মরণ করবেন ঐ ঘটনার কথা যেটা তার জীবনে ঘটেছিল বিভিন্ন মেশিনের সাথে সংযুক্ত থাকা অবস্থায় তিনি যখন ঘুমিয়ে ছিলেন। কিন্তু সেটা পুরাপুরি স্বপ্ন ছিল না। 

Comments

  1. প্রিয় শিশিরকন্যা, শেষ পর্ব পড়ার আগে নতুন করে প্রথম থেকে সবগুলো পর্ব পড়লাম। অসম্ভব সাবলীল আর মন ছুঁয়ে যাওয়া লেখনী। আপার এই অভিজ্ঞতার গল্প আমাকেও বলেছেন। সত্যি এক অনন্য অভিজ্ঞতা!

    ReplyDelete
  2. Goodness me, I was getting retraumatised while reading the last part, J.M.
    This was one of the toughest challenges that we have experienced in our lives. What stood out for me quite strongly,
    was the feeling of helplessness & desperation
    Very well presented

    ReplyDelete
  3. বরাবরের মতোই আপনি চমৎকার বিশ্লেষণ করেছেন। পুরো ঘটনাটাই হৃদয়বিদারক। তবে, এত কিছুর পরও আপনার মায়ের বেঁচে ফেরাটা আল্লাহর অনেক বড় মেহেরবানি। আল্লাহ সবসময় ওনাকে ভালো, সুস্থ, এবং হেফাজতে রাখুক।

    ReplyDelete

Post a Comment