একুশ দিনের গল্প - ৪র্থ

 পাঠকের জন্য এর আগের পর্বের লিংকঃ একুশ দিনের গল্প - ৩য় 

--------------------------------------------------------------------------------------------------------------

পেশেন্ট আপনার কে হয়? ইউনাইটেড হাসপাতালের জরুরী বিভাগের ফ্রন্ট ডেস্কে বসা ব্যক্তিটি ডেস্ক থেকে মুখ না তুলেই আমাকে জিজ্ঞেস করলো। প্রচণ্ড আতংক ভরা কণ্ঠে উত্তর দিলাম, আমার মা। 

এই ফর্মগুলা ভরে, সই করে জমা দিন। পেশেন্টকে ভেতরে নেয়া হয়েছে। ভেতরে উনার কাছে খালি একজন ভিজিটর থাকতে পারবে। আমি আর বড় আপা অসহায় দৃষ্টিতে একে অন্যের দিকে তাকালাম। একটু ভেবে বড় আপা বললেন, তুমি আগে যাও। আমরা বাকিরা বাইরে অপেক্ষা করছি। 

হন্তদন্ত করে ভেতরে  ঢুকলাম। মায়ের বেডটা খুঁজে পেতে কোনো অসুবিধা হলোনা। অসহ্য যন্ত্রণায় মা কাতরাচ্ছেন। নার্স অ্যাটেন্ডেন্ট আমাকে দেখে বলে উঠলো, উনাকে এক্সরে এবং সি টি স্ক্যান এর জন্য নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু প্রচন্ড ব্যাথার কারনে উনাকে একটুও নড়ানো যাচ্ছেনা। যেহেতু মা আঘাত পেয়েছে দুই জায়গায়, কোমরে ও মাথায়, তাই তারা এক্সরে এবং সি টি স্ক্যান এর মাধ্যমে ভালোমত বুঝবে মা'র প্রকৃত অবস্থাটা এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে। আমি বললাম, তাহলে মা'কে ব্যাথা কমানোর ওষুধ দেয়া হোক। সে বলল, অন ডিউটি ডাক্তার এসে আগে দেখবে তবে ওষুধ দেবে।

একটু পরেই অন ডিউটি ডাক্তার আসলো এবং সব দেখে শুনে যা বলল তার সারমর্ম করলে দাঁড়ায়, যেহেতু মা'র কোনো পূর্ব মেডিকাল রেকর্ড তাদের কাছে নেই কাজেই পুরাপুরি মেডিকাল ইতিহাস না জেনে চট করে মা'কে তারা কোনো শক্তিশালী ব্যথার ওষুধ যেমন প্যাথেড্রিন জাতীয় কিছু দিতে পারবেনা। তাহলে মা'কে ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে এক্সরেতে নেয়া হোক, আমি বললাম। তিনি জানালেন না, সেটা করা যাবেনা। মায়ের বয়সের কারনে কড়া ঘুমের ওষুধ দেয়া খুবই বিপদ্দজনক। 

হায় আল্লাহ্‌, তাহলে কি করে এই সমস্যার সমাধান হবে? কি হয়েছে না জেনে তো তারা চিকিৎসা শুরু করতে পারবেনা। আমি করজোড়ে বিনীত অনুরোধ করলাম, ডাক্তার সাহেব, ডোজ কমিয়ে দিয়ে কি প্যাথেড্রিন দেয়া যায়না? অন ডিউটি ডাক্তার কিছুক্ষণ ভাবলেন এবং রাজী হলেন।

মা'কে এক্সরে রুমে নিয়ে যাওয়া হলো। আমি বাইরে এসে বড় আপাকে জানালাম কি হয়েছে। আমরা অপেক্ষা করছি এক্সরে ও সি টি স্ক্যান এর রিপোর্টের জন্য। একটু পরে আমাদেরকে জানানো হলো, অর্থোপেডিক ইউনিটের সিনিয়র কন্সালটেন্ট, ডঃ মান্নান এসে  আমাদের সাথে কথা বলবেন। 

মাথার ভেতর অসংখ্য চিন্তা ও মনের ভেতর হাজারো আবেগ পাল্লা দিয়ে ছুটতে লাগলো। কেন এমন হলো? আর এক সপ্তাহ পরেই তো আমার মা'কে নিয়ে আমেরিকায় চলে যাবার কথা। আমেরিকায় থাকাকালিন পড়ে গেলে তো মায়ের অনেক ভালো চিকিৎসা হতে পারতো। বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর আমার কোনো আস্থা নেই। আর বাংলাদেশের হাসপাতাল সম্পর্কেতো কোনো ধারণাই নেই। আমি দেশ ছেড়েছি তিরিশ বছর আগে। ছোট থাকতে মায়ের অ্যাপেনডিক্সের অপারেশনের সময় হাসপাতালে গিয়েছি তাকে দেখতে, অন্য সময় গিয়েছি কোন অসুস্থ আত্মীয়স্বজনকে দেখতে। এর বাইরেতো আর কোনো অভিজ্ঞতা নেই। আমি বা এই অবস্থায় মা'কে ফেলে কিভাবে ফেরত যাবো। আমেরিকায় ফোন করে আমার বাচ্চাদের, ওদের বাবাকে জানালাম। 

খুব বেশীক্ষন অপেক্ষা করতে হলোনা। করিডোরের উল্টো দিক থেকে অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনেরাল ডঃ মান্নান তার এক বিশাল বাহিনী সঙ্গে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে এলেন। সবার সামনে তিনি - অর্থোপেডিক ইউনিটের হেড। ঠিক তার পেছনে দুজন সিনিয়ার ডাক্তার, তার পেছনে দুজন জুনিয়ার ডাক্তার। এরপর সেই দলে যুক্ত হলেন ইমার্জেন্সি ইউনিটের যে ডাক্তার এতোক্ষন ইনচার্জ ছিলেন তিনি। কারন তিনিই, এতোক্ষন ধরে যা ঘটেছে তার সকল বৃত্তান্ত এই ডাক্তারদের দলকে বুঝিয়ে বলবেন। একটু দূরে দাঁড়িয়ে আমি হাসপাতাল ডাক্তারদের এই প্রটোকল অবাক হয়ে দেখছিলাম। 

কয়েক মিনিট পরেই একজন জুনিয়ার ডাক্তার আমাদের ডাকলেন। এই কয়েক মিনিট মনে হলো কয়েক বছরের সমান। আমি ভাবতেই পারছিলাম না আমাদের জন্য কি ধরনের সংবাদ অপেক্ষা করছে। ডঃ মান্নান এর দিকে তাকিয়ে মনে হলো এই মানুষটিকে ভরসা করা যায়। শান্ত, সৌম্য, বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা তার। মুখে বয়স ও  অভিজ্ঞতার ছাপ। যখন কথা বলতে শুরু করলেন, তখন মনে হলো তিনি জানেন যে তিনি কি বলছেন - আম্মার কি ঘটেছে সেটা যেমন জানেন, কিভাবে তার চিকিৎসা করতে হবে সেটাও তিনি জানেন। 

তিনি খুব পরিষ্কার ভাবে এক্সরে প্লেট হাতে নিয়ে আমাদের কাছে সব কিছু ব্যাখ্যা করলেন। উনার কথার ধরনে মনে হলো, রোগীর চিন্তায় ভীত, শংকিত, পরিবারের কোনো অসহায় সদস্যদের সাথে তিনি কথা বলছেন না যাদেরকে খুব সহজেই বোকা বানানো যায়, যে কোনো কিছু বলা যায়, কারন তারা চিকিৎসা সম্পর্কে কিছুই বোঝেনা। আমি কিছু সরাসরি প্রশ্ন করলাম যার উত্তর তিনি সরাসরি দিলেন, কোনো ঘুরিয়ে পেচিয়ে নয়। 

আমি যেই দেশে থাকি সেখানে পেশেন্ট রাইট অনেক বেশী জোরদার, অনেক মজবুত। ডাক্তার এবং হাসপাতাল ম্যানেজমেন্ট, রোগী ও তার পরিবারের কাছে যে কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য। তাদের কোনো অন্যায় বা অবহেলার প্রতিবাদে তাদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নিতে রোগীর পরিবারকে কোনো বেগ পেতে হয়না। এসময় আমি মাথা থেকে আমেরিকাকে একদম সরিয়ে ফেলেছি। আমেরিকান কোনো নিয়ম কানুন এই দেশে খাটবেনা।    

আমাদের দুই বোনের সাথে ডাঃ মান্নানের খুব সুন্দর একটা কথোপকথন হলো। তিনি আমাদের বুঝিয়ে বললেন, আম্মা পড়ে গিয়ে উনার কোমড়ের হাড্ডি ভেঙ্গে গিয়েছে। সেই ভাঙ্গা হাড্ডি জোড়া লাগাতে অপারেশন করে স্টিলের পাত ও স্ক্র বসাতে হবে। তবে তাৎক্ষণিক ভাবে অপারেশনে নেয়া যাবে না কারন আম্মার সোডিয়াম লেভেল মাত্রাতিরিক্ত কম। দু'তিন দিন পরে অপারেশন হবে। সব ভাইটাল নরমাল লেভেলে আসলে তবে রোগী ওটিতে যাওয়ার অনুমতি পাবে।   

যেদিন আম্মা হাসপাতালে ভর্তি হলো এবং যেদিন আম্মা ছাড়া পেলো তার মধ্যে ব্যবধান ছিলো তিন সপ্তাহ অর্থাৎ একুশ দিন। এই একুশ দিনের গল্পই আমি বলতে শুরু করেছিলাম। এই একুশ দিনের প্রতিটা দিন আমি বারো ঘন্টা করে হাসপাতাল ডিউটি করেছি। এতো লম্বা সময় ধরে হাসপাতালে থাকাকালীন অনেক রকম ঘটনা দেখেছি, অনেক মানুষের সাথে পরিচয় হয়েছে। তিরিশ বছর আগে দেশ ছাড়া আমি যার বাংলাদেশের হাসপাতাল সম্পর্কে কোনই  ধারণা ছিলনা, একুশ দিন পরে সেই আমি বেড়িয়ে এলাম ছোট বড় অনেক ধরনের অভিজ্ঞতাকে সম্বল করে। আমেরিকান হসপিটাল এর চাইতে যা অনেক অনেক আলাদা।  

ইউনাইটেড হাসপাতালের চারতলায় অর্থোপেডিক ইউনিটের জুনিয়ার ডাক্তার, সিস্টার, পার্সোনাল কেয়ার স্টাফ, কিচেন স্টাফ, ইউটিলিটি স্টাফ, ক্লিনিং কর্মী, এলিভেটর গার্ড, প্রায় সকলের সাথে এক ধরনের সখ্যতার সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল। যদিও তারা সবাই রোগীর সেবায় নিয়োজিত, তবু তাদের মধ্যেও আকাশ পাতাল ব্যবধান লক্ষ্য করেছি। কাউকে পেয়েছি খুব ভদ্র, মনযোগী, কাজে নিষ্ঠা, আন্তরিক ও সেবাপরায়ন। এদের কাছে কোন সাহায্য চাইলে খুব বেশী অপেক্ষা করতে হয়নি। আবার এদের মধ্যে কাউকে দেখেছি কাজে উদাসীন, ফাঁকিবাজ, রুঢ় ব্যবহার, রোগীর সুবিধা অসুবিধার প্রতি বিন্দুমাত্র ভ্রক্ষেপ নাই। এদের ডেকে ডেকে হয়রান হয়ে যেতাম, প্রয়োজনের সময় আম্মার রুমে এদের পাওয়া যেতো না।

আম্মার ভর্তির তিন দিন পরে তাকে সার্জারিতে নেয়া হয়। আমাদের দুই বোনের কান্নাকাটি ও আকুতি মিনতি দেখে অপারেশনের আগে ও পরে সিনিয়ার সার্জন ডাক্তার, জুনিয়ার ডাক্তার, অ্যানেসথেসিওলজিস্ট  সবাই এসে একে একে  আমাদের খবর দিয়েছে, আশ্বস্ত করেছে। এমনকি তারা বাইরে এসে আম্মার ভাঙ্গা হাড্ডির মাথা আমাদের দেখিয়েছে, যেই স্টিলের পাত ও স্ক্র বসানো হবে সেটাও অপারেশনের আগে দেখিয়েছে। 

সার্জারির পরে আম্মাকে রাখা হয়েছিল এইচ-ডি-ইউ তে যেটা ছিল এক প্রকারের মাছের বাজার। হরেক রকম অপারেশনের রোগীকে এই আফটার কেয়ার ইউনিটে রাখা হয়। এই ইউনিটের কর্মীদের কাজে কোনো মন নেই। তারা সারাক্ষনই ব্যস্ত ব্যস্ত ভাব করে এদিক ওদিক ঘুরাঘুরি করে। এবং তারা সর্বদাই বিছানায় মিশে যাওয়া, ব্যাথায় কাতরানো, অসহায় রোগী গুলোর সাথে নির্দয় ব্যবহার করে। আমার মনে আছে আম্মাকে দেখতে যখন ভেতরে ঢুকেছি, আম্মার জন্য একটু পানি চাইছিলাম, তার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু কেউ দিচ্ছিলোনা।

দুদিন পরে আম্মাকে আমরা আবার রেগুলার ওয়ার্ডে তার পুরানো রুমে নিয়ে আসলাম। এখানে সপ্তাহ খানেক আম্মার অবস্থা ভালো মতই এগুচ্ছিল। সব সময় ডাক্তার, নার্স এর অবজারভেশনে ছিল। একটু করে ফিজিওথেরাপিও চলছিলো। কিন্তু এরই মধ্যে সৃষ্টিকর্তা আমাদের জন্য আর একটি পরীক্ষার ব্যবস্থা করলেন। খুবই ভয়াবহ ও কঠিন একটি পরীক্ষা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। এই রুমে থাকতে থাকতেই আম্মার খুব জটিল এক ধরনের লাং বা ফুস্ফুসের ইনফেকশন হয়। বাংলাদেশের হাসপাতাল গুলিতে বয়স্ক রোগীরা সার্জারির পরবর্তীকালিন সময়ে প্রায়ই এই ইনফেকশনের শিকার হয়। এই ইনফেকশনের জীবাণু ছড়ায় হাসপাতাল কর্মীদের মাধ্যমে যারা বিভিন্ন রোগীর সেবা প্রদানের সময় যথার্থ হাইজিন ফলো করেনা। 

আম্মার প্রচন্ড রকমের শ্বাসকষ্ট শুরু হলো। খুব দ্রুত আম্মার অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকায় ডাক্তাররা সিদ্ধান্ত নেয়, আম্মাকে আই-সি-ইউ তে স্থানান্তর করতে হবে। ডাঃ মান্নান নিজে এসে আমাদের বললেন, কোমরের হাড্ডিকে শক্ত, সবল করার আগে এখন জান বাঁচানো বেশী জরুরী। আমাদেরকে মোটামোটি মানসিক ভাবে শক্ত থাকতে আভাস দেয়া হল। হাতের কাছে সব সময় ফোন রাখতে এবং ইউনাইটেড থেকে কল আসলে রিসিভ করার জন্য পরামর্শ দেয়া হল। অবস্থা কতটা ভয়াবহ সেটা পুরাপুরি বুঝতে না পারায়, অক্সিজেন মাস্ক মুখে থাকা অবস্থায়ই আমার  আম্মা আই সি ইউ যেতে প্রচন্ড আপত্তি জানান। আমার কাছ থেকে অনেকগুলো ফর্মে সই নেয়া হল যাতে জীবন রক্ষাকারী যে কোনো ধরনের চিকিৎসা পদক্ষেপ নিতে তাদের কোনো বাঁধা না থাকে। আমার মেঝো আপাকে জরুরী ভিত্তিতে দেশে আসতে খবর পাঠানো হল।

......(চলবে)                       

         

Comments

  1. অত্যন্ত সাবলীল লেখনী। দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার খন্ডচিত্র।

    ReplyDelete
  2. Eagerly awaiting for the next part

    ReplyDelete

Post a Comment