ওপারের কাছাকাছি


বিখ্যাত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের লেখা একটি গল্প পড়েছিলাম, ছায়া সঙ্গী। একটি অজপাড়া গাঁয়ে 'মন্তাজ মিয়া' নামে দশ, এগারো বছরের একটি ছেলে প্রচণ্ড জ্বরে ভোগে এবং একসময় ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করে। তাকে যথারীতি কবর দেয়া হয়। সেদিন রাতে পাশের গ্রাম থেকে ছেলেটির পোয়াতি বড় বোন নাইওর আসে এবং দাবি করে যে তার ভাই বেঁচে আছে। কবর খোঁড়া হলে ছেলেটিকে সেখানে জীবিত পাওয়া যায় আর অস্বাভাবিক ব্যপার গুলোর শুরু সেখান থেকেই। 

ছেলেটি কবরের অন্ধকারে তার অভিজ্ঞতার কথা সবাইকে বলতে শুরু করে। সে বলে, সে ছাড়া আরো একজন তার সাথে কবরে ছিলো যিনি কিনা ছেলেটিকে আদর করতো আর বলতো, কোনো ভয় নেই। তিনার শরীর থেকে শ্যাওলার গন্ধ বের হতো। সবাই একসময় ছেলেটিকে পাগল ভাবতে শুরু করে। সেই গল্পটি কোনো সত্যি ঘটনা অবলম্বনে নাকি পুরোটাই লেখকের কল্পনা ছিল তা জানিনা। তবে গল্পটি পড়ার পর খুব অদ্ভুত লেগেছিলো।

কলেজে যখন সাইকোলজি বা মনোবিজ্ঞানের উপর গ্র্যাজুএশন করেছিলাম, তখন পরিচয় হয়েছিল মনোবিজ্ঞানের একটি শাখা 'প্যারাসাইকোলজি' বা অতিপ্রাকৃত মনস্তত্ত্ব এর সাথে। প্যারাসাইকোলজি মানুষের জীবনের প্যারানরমাল বা অস্বাভাবিক ঘটনা নিয়ে গবেষণা করে, যে সব ঘটনার কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পাওয়া সম্ভব নয়। আধুনিক জগত এটিকে পুরোপুরি বিজ্ঞানের পর্যায় ফেলেনা। তার কারন, যা কিছুর কোনো প্রমান বা ব্যাখ্যা নেই, তা বিজ্ঞানীদের চোখে বিজ্ঞান নয়। 

প্যারাসাইকোলজি যে সকল অতিপ্রাকৃত বিষয় নিয়ে বিশ্লেষণ করে তাদের মধ্যে সবথেকে আলোচিত বিষয় হলো NDE বা Near Death Experience । যার বাংলা করলে দাঁড়ায় 'মৃত্যুর কাছাকাছি অভিজ্ঞতা'। সারা দুনিয়াতে খুবই কম সংখ্যক মানুষ আছে যাদের এই ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছে বা তারা সেই অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে সবাইকে বলতে পেরেছে। আমেরিকাতে কিছু  Near Death Experiencer আছে যাদের কথা সবসময় নিউজ, ইন্টারনেট বা কোনো গ্রন্থ, প্রবন্ধে এসেছে।

মানুষের শরীর যখন কোনো প্রাণঘাতী অবস্থার মধ্যে দিয়ে যায় যেমন কোমা (Brain Dead), কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট, ট্রমা (কোন বিস্ফোরণ বা পড়ে যাওয়া থেকে), অথবা অপারেশনের আগে পুরাপুরি অ্যানাসথেশিয়া দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়ার পর, তখন মানুষের মস্তিষ্ক পুরোপুরি ভাবে বা আংশিক ভাবে নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। যার ফলে শরীর থেকে মস্তিষ্কে রক্ত এর মাধ্যমে অক্সিজেন সরবরাহ একদম কমে যায়। আর তখনই এই ঘোর লাগা বা ট্রান্স অবস্থার সৃষ্টি হয়। 

সমস্যাটা এখানেই। ডাক্তারি ভাষায়, মস্তিষ্ক যখন নিস্তেজ হয়ে পড়ে তখন মানুষের 'মন' বা কনশাস এরও নিস্তেজ হয়ে যাওয়ার কথা। জাগতিক কোনো অনুভূতি তার অনুভব করার কথা নয়। কিন্তু কিছু কিছু মানুষের ক্ষেত্রে তা ঘটে না। নিস্তেজ অবস্থায় সেসব মানুষেরা এক ধরনের অলৌকিক যাত্রায় অংশ নেয় এবং যাত্রার পর আবার এই পার্থিব দুনিয়ায় ফেরত আসে।

NDRF (Near Death Research Foundation)  সংস্থা সারা পৃথিবীর এই "প্রায় মরে যাওয়া" চার হাজার মানুষকে ইন্টারভিউ করেছে। আশ্চর্যের ব্যাপার, তাদের প্রায় সকলে একই রকম অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেছে। 

শরীর থেকে বেরিয়ে এসে বাতাসে ভেসে বেড়ানোর অনুভূতি যাকে বলা হয় OBE বা Out of Body Experience ~ ওপর থেকে বা বাইরে থেকে দেখা তার শরীরটা নিয়ে আশেপাশের মানুষেরা কি করছে ~ কোনো ব্যাথা বা বেদনা অনুভব না করা ~ এক ধরনের সুখকর বা আনন্দময় অনুভূতি পাওয়া~ অন্ধকার, লম্বা সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে গিয়ে অনেক উজ্জ্বল আলোর ধারা দেখা ~ মৃত কোন পরিবারের সদস্য বা আপনজনদের সাথে মিলিত হওয়া এবং কোনো অজানা তথ্য বা প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া ~ শান্তিময়, অলৌকিক সংগীত বা সুর শুনতে পাওয়া ~ এক ঝলক বা ফ্ল্যাশ ব্যাকের মত পুরো জীবনের ঘটনা গুলো চোখের সামনে দেখতে পাওয়া ~ বিশাল কোনো আলোর উৎস থেকে শোনা, এখনো তোমার সময় হয়নি ~ কোনো ধরনের মৃত্যু ভয় অনুভব না করা।

যাদের জীবনে এমন অভিজ্ঞতা হয় তারা সকলেই দৃঢ়তার সাথে বলে যে এটা কোনো স্বপ্ন বা হ্যালুসিনেশন ছিল না। বরঞ্চ খুবই সত্যি একটি ঘটনা যা তারা প্রতি মুহূর্তে উপলব্ধি করতে পেরেছে। আলো ঝলমল, সবুজ গাছপালা, ফুলে ফুলে ভরা ঐ সুন্দর জায়গাটি ছেড়ে তাদের কখনই এই জীবনে ফেরত আসতে ইচ্ছে করেনি। তাদের ভাষায়, ঐটিই ছিলো বেহেশত বা হেভেন। দুঃখের বিষয় হলো, সবার অভিজ্ঞতাই খুব সুন্দর আর আনন্দময় হয়না। যেমনটি হয়েছিলো, ডঃ নীলের ক্ষেত্রে।

ডঃ মেরি নীল আমেরিকার ওয়াইওমিং স্টেটের একজন অরথোপেডিক সার্জন। ১৯৯৯ সালে তিনি তার স্বামীর সাথে দক্ষিন আমেরিকার চিলির একটি খরস্রোতা নদীতে কায়াকিং করছিলেন। একটি জলপ্রপাতের নীচে এসে একসময় তার নৌকাটি উল্টিয়ে যায় এবং তিনি পানির ভেতর নৌকার নীচে আটকিয়ে মারা যান। আশেপাশের অন্যান্য নৌকার বন্ধুরা তার হৃদকম্প বিহীন শীতল, নিথর দেহটি পানি থেকে তুলে আনে এবং ক্রমাগত সি-পি-আর দিয়ে বাচিয়ে তোলার চেষ্টা করে। প্রায় ৩০ মিনিট পর তিনি জেগে উঠেন এবং বলেন যে তিনি পরপারে চলে গিয়েছিলেন এবং সেখান থেকে আবার ফেরত এসেছেন। 

তার অভিজ্ঞতার কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আলোর তৈরি মানুষদের সাথে উনার দেখা হয়েছে যারা তাকে বলেছে, এখনো সময় হয়নি এবং দুনিয়াতে তার কাজ এখনো অনেক বাকি।। সে সব মানুষগুলো আর একটি বিপদ সংকেত তাকে দিয়েছিল যেটা তিনি কাউকে তখন বলেননি। ডঃ নীলের বড় ছেলে মারা যাবে। কিন্তু কবে বা কেমন করে তার কিছুই বলেনি তারা।

ডঃ নীল যখন মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফেরত আসে তখন তার বড় ছেলের বয়স ছিল নয়। এরপর থেকে প্রতিটা বছর তিনি আতংকের মধ্যে কাটান আর মনে মনে প্রার্থনা করেন, কোনো ভাবে যেন এই সাংঘাতিক ঘটনাটি তাদের জীবনে না ঘটে। মায়াবী মানুষগুলোর দেয়া সেই ভয়ংকর ভবিষ্যৎবাণীটি যেন তার ছেলের জীবনে মিথ্যা প্রমানিত হয়। 

ছেলের আঠারোতম জন্মদিনে ছেলে সাবালক হলে তিনি তার ছেলের সাথে এই তথ্যটি শেয়ার করেন আর ভাবেন হয়তো ফাড়া কেটে গেছে। ঠিক তার পরের বছর ২০০৯ সালে, চিলির ঘটনার দশ বছর পরে, একটি মর্মান্তিক গাড়ী অ্যাকসিডেন্টে তার উনিশ বছর বয়সী বড় ছেলে মারা যায়।   

বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে Near Death Experience  কি কারনে ঘটে বা কার কার ক্ষেত্রে ঘটে তার কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা নেই। ছোট বাচ্চা থেকে বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত যে কেউ, মৃত্যু পথযাত্রী রোগী বা কোনো অ্যাকসিডেন্ট এর কারনে অবচেতন হয়ে যাওয়া যে কোনো পরিস্থিতিতে এটা ঘটতে পারে। তবে সবার ক্ষেত্রেই এটা ঘটেনা। যাদের জীবনে ঘটে তাদের সবাই এটা শেয়ার করতে চায়না পাছে তাকে কেউ বিশ্বাস না করে। 

যারা NDE থেকে ফেরত আসে তারা পরবর্তী জীবনে অনেক সময় খুবই ধার্মিক বা সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসী হয়ে যায়। আফসোস করে কেন তারা এই পার্থিব জীবনে ফেরত এসেছে। তাদের কাছে জীবনের মানে অনেকটাই মূল্যহীন হয়ে যায়।

চিকিৎসা বিজ্ঞানে 'মিরাকেল' বলে একটি কথা আছে। চিকিৎসা বিজ্ঞান, কোনো এক জায়গায় এসে 'বিশ্বাসের' কাছে পরাজয় স্বীকার করে। যে বিশ্বাস, আমাদের যিনি সৃষ্টি করেছেন তাঁর প্রতি। যিনি জন্ম ও মৃত্যুর মালিক, তাঁর প্রতি। হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেলে ডাক্তার বা চিকিৎসকরা অবিরাম সি-পি-আর দিয়ে চেষ্টা করে রোগীর জান ফিরিয়ে আনার জন্য। কোমায় যাওয়া রোগীর ক্ষেত্রে, ডাক্তাররা পরিবার পরিজনদের বলে অনবরত প্রার্থনা করতে। ওপারে কি সিদ্ধান্ত হচ্ছে তা কেউতো সঠিক জানেনা - হয়তো রোগীটি ফেরত আসবে। 

জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে এমন কিছু 'সময়' বা 'জায়গা' আছে যা একদমই আমাদের বোঝার বাইরে। এপার আর ওপারের মাঝামাঝি - এক অচিনপুর। যিনি আমাদের এপার থেকে ওপারে পারাপার করেন, তিনি কারো নির্দেশে এটা করেন। 

হয়তো কখনো কখনো এই নির্দেশ বদল হয়। সিদ্ধান্ত বদল হয়। ওপারের কাছাকাছি এসে যাত্রীটি জানতে পারে, তার সময় এখনো আসেনি। ওপারে প্রবেশের অনুমতি মেলেনি। যাত্রীটিকে আবার এপারে পৌঁছে দেয়া হয়। 

মন্তাজ মিয়ার ক্ষেত্রেও হয়তো তাই হয়েছিলো। আধুনিক কোনো পশ্চিমা দেশে জন্মালে, মন্তাজ মিয়ার এই অভিজ্ঞতার কথা সবাই আরো গুরুত্ব দিয়ে শুনত। 

Comments

  1. Extremely interesting and thought provoking. Thoroughly enjoyed reading this informative piece.

    ReplyDelete
  2. তোমার এই লেখাটি 'দুরে কোথাও' শীর্ষকটির সাথে মিলে যাচ্ছে। সেই দূরেই কোথাও যেন চলে গিয়েছিলাম। বিজ্ঞান যদিও যা বস্তু অনুবিদ্ধ নয় তা মেনে নিতে রাজী নয় সে বিজ্ঞানই বলে energy never dies, it transforms into another form. এই ভেবেই কিছুটা সান্ত্বনা পাওয়া যায় - যে প্রিয়জনদের আমরা হারিয়েছি তারা কোথাও না কোথাও কোন না কোন form এ বিরাজ করছে।

    ReplyDelete
  3. আত্মা (soul/consciousness) ব্যাপারটি খুবই দারুণ। জাগ্রত অবস্থায় শরীর আর আত্মা উভয়ই থাকে সজাগ, অথচ ঘুমন্ত মানুষের দেহ সজীব কিন্তু আত্মা অসাড়। মৃত ব্যক্তির মাটির ধারকটি নিস্পৃহ, কিন্তু কি হয় সেই আত্মার? সেই consciousness এর অবস্থান কোথায়? আমাদের ইন্দ্রিয়সমূহে তার উপস্থিতি অনুভব করতে পারিনা।

    সেই মেশিনের অপেক্ষায় রইলাম যার মাধ্যমে যদি কখনো আত্মাকে জীবিত মানুষের ইন্দ্রিয়ে অনুভব করা যায়!

    ReplyDelete
  4. Such a heartwarming, interesting and thought provoking topic you have selected to write on. It helps to to see death in a more positive way. I think I have read this lady's book 'To heaven and back'. Looking forward to some more interesting topics.

    Ardent admirer

    ReplyDelete
  5. Very very interesting post .

    ReplyDelete

Post a Comment