শেষ মুহূর্তের ঝলক

"হৃদয়ের স্পন্দনই আমাদের বাঁচিয়ে রাখে। কিন্তু এই স্পন্দন কোনো ঘোষণা না দিয়েই থেমে যেতে পারে। এ কথাটি আমরা বারবার ভুলে যাই। গতকাল দিনটি শুরু করার সময় কি আমি জানতাম যে আমার সঙ্গে কি হতে যাচ্ছে" - কথাগুলো বলেছিলেন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক তামিম ইকবাল। চলতি বছর মার্চ মাসে প্রিমিয়ার লীগ খেলার সময় তার আকস্মিক হার্ট অ্যাটাক ঘটে। হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে ছাড়া পাওয়ার পর এক চ্যানেলে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন।

কিন্তু এমন যদি হয়, কারো হৃদয়ের স্পন্দন্ চিরতরে থেমে যায়। আর সেই থেমে যাবার আগ মুহুর্তে সেই মৃত্যুপথযাত্রী মানুষটি কি ধরনের অনুভূতি বা উপলব্ধির মধ্যে দিয়ে যায়, তা সম্পর্কে আমরা একটু হলেও জানতে পারি। এটা সম্ভব হয়েছিল একজন রোগীর ব্রেইন স্ক্যানের মাধ্যমে। ঘটনাটা ঘটে কানাডায়।  

মৃত্যু হল এমন একটা বিষয় যেটা সম্পর্কে অনেক কিছুই আমাদের অজানা। আমরা জানি, কারো মৃত্যু হলে তার দেহ বা শরীরের কি পরিণতি ঘটে। কিন্তু মৃত্যুর আগ মুহুর্তে মন বা মানসিক অবস্থা কি কি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায় সেটা সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোনো ধারণা আমাদের নেই।

দুনিয়া ছেড়ে চলে যাবার আগ মুহূর্তটা কেমন? কি ঘটে আমাদের মস্তিষ্কের ভেতর? একটি বারের জন্যও কি মনে পড়ে পেছনের কথা? যেতে যেতে কি মনে পড়ে আপনজনের মুখ? 

মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসা মানুষেরা যে সব অভিজ্ঞতার কথা বলে তাকে বলা হয়, নিয়ার ডেথ এক্সপেরিএন্স।  বিভিন্ন সময় তারা যখন ইন্টারভিউ দেয় তখন অনেক ক্ষেত্রেই তারা একটা জোরালো সাদা আলো দেখার কথা বলে। অনেকে স্মরণ করে যে তারা মনের ভেতর এক ধরনের প্রশান্তি অনুভব করেছিলো। অথবা অনেকে কোনো কিছুই মনে করতে পারেনা। (এসব অভিজ্ঞতার কথা আগে লিখেছি 'ওপারের কাছাকাছি' লেখাতে, এখানে লিংক

কিন্তু একটা ব্যাপার সমগ্র দুনিয়ার মানুষ তা সে যে কোনো জাতি, ধর্ম, বর্ণের হোক না কেনো, নির্দিধায় বলে থাকে যে সে সময় তারা তাদের চোখের সামনে তাদের পুরো জীবনের এক ঝলক দেখতে পায়। অন্য ভাষায় আমরা যাকে বলতে পারি, জীবনের সারাংশ অথবা সংক্ষিপ্ত পুনুরাবৃত্তি। চিকিৎসক বা গবেষকেরা মৃত্যুর দরোজা থেকে ফেরত আসা মানুষের এই সংক্ষিপ্ত জীবনী দেখার কথা অনুধাবন করলেও, এতোদিন অবধি প্রমান করতে পারেনি। 

২০২২ সালে প্রকাশিত ফ্রন্টিয়ার ম্যাগাজিনের নিউরোবিজ্ঞান শাখায় একটি স্টাডি রিপোর্ট ছাপা হয় যা কিনা জনমনে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। রিপোর্টিতে মৃত্যুর ঠিক আগ এবং পর মুহুর্তে মানব মস্তিষ্কের স্ক্যান চিত্রের এক পরিষ্কার বিবরণ দেয়া হয় যেখানে জীবনের সংক্ষিপ্ত পুনুরাবৃত্তি ঘটে যাওয়ার এক সুস্পষ্ট আভাস মেলে। 

অবাক ব্যাপার হলো, মৃত্যুর কথা মাথায় রেখে কিন্তু বিজ্ঞানীরা এই স্টাডি পরিচালনা করেনি। বরঞ্চ ৮৭ বছর বয়সী একজন কানাডীয় অধিবাসির এপিলেপ্সি জনিত কারণে একদল নিউরোবিজ্ঞানীরা রোগীটির ই ই জি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করছিলো। যাতে তারা রোগীর খিঁচুনি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পেতে পারে। এই রেকর্ডিং এর সময় রোগীর হার্ট আটাক হয় বা হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। 

যেহেতু আগের থেকে রোগীর পরিবাররে পক্ষ থেকে হাসপাতাল প্রশাসনকে অনুমতি দেয়া ছিল যে চিকিৎসা চলাকালিন কোনো কারণে রোগীর মৃত্যু হলে তারা কোনো ধরনের জীবনরক্ষাকারি ব্যবস্থা নিবেনা, সেহেতু হার্ট অ্যাটাকের পরপরই রোগী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। কিন্তু শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগ মুহুর্তে রোগীর মাথার ভেতর কি কি ঘটে যায় তার একটা পরিষ্কার চিত্র আকস্মিক ভাবেই চিকিৎসকদের হাতে এসে পড়ে। 

সর্বমোট ১৫ মিনিটের রেকর্ডিং সম্পন্ন হয় যাতে মৃত্যুর আগ মুহুর্তে, মৃত্যু চলাকালিন এবং মৃত্যুর ঠিক পর মুহুর্তের ব্রেইনের চিত্র ধারণ করা হয়। রিপোর্টটির মতে, এটি দুনিয়ার প্রথম রেকর্ডিং যা কিনা প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়া একটি মস্তিষ্কের শেষ মুহুর্তের ছবি তুলে ধরতে সক্ষম হয়।  তবে পুরো ১৫ মিনিটের মধ্যে বিশেষ নজর কাড়ে ৩০ সেকেন্ড এর চিত্র, যা কিনা রোগীর হার্ট বন্ধ হবার একটু আগে এবং একটু পরে ধারণ করা হয়। 

রিসার্চ গ্রুপের প্রধান ডঃ আজমাল যেমার ফ্রন্টিয়ার ম্যাগাজিনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, তিনি রিপোর্টে দেখতে পান যে রোগীর মস্তিষ্কের নিউরাল অক্সিলেশন বা স্নায়ু স্পন্দন বিদায়ের আগ ও পর মুহুর্তে কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছে। রোগীর মস্তিষ্কের ভিতর যে সব তরঙ্গ ওঠা নামা করে তার মধ্যে তিনি গামা তরঙ্গের একটি উচ্চ মাত্রার ফ্রিকোএন্সি দেখতে পান। এই তরঙ্গ স্ফীতি ঘটে মস্তিষ্কের স্মৃতি ভান্ডার নামক প্রকোষ্ঠটিতে। যা কিনা  জীবিত মানুষের ক্ষেত্রে স্মৃতি রোমন্থন, স্বপ্নচারণ এবং ধ্যান নিবেশ প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত। গামা তরঙ্গের সাথে মস্তিষ্কের অন্যান্য তরঙ্গ আলফা, বেটা, ডেল্টা, থেটা একত্রিত হয়ে এমন একটি প্যাটার্ন সৃষ্টি করে যা সাধারনত দেখতে পাওয়া যায়, যখন কোনো মানুষ গভীর ভাবে কিছু মনে করার চেষ্টা করে বা স্বপ্ন দেখে। 

ডঃ যেমারের মতে, এই অভাবনীয় রিপোর্ট থেকে এই সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে যে বিদায়ী মুহুর্তে রোগীর ব্রেইন সারা জীবনের এক সংক্ষিপ্ত চিত্র তাকে দেখানোর চেষ্টা করছিলো বা তার জীবনের বিশেষ মুহুর্তগুলো শেষ বারের মত মনে করিয়ে দিতে চেষ্টা করছিলো। 

আরো একটি আশ্চর্যের বিষয় হলো, বিজ্ঞানীরা ইঁদুরের মস্তিষ্কের উপর গবেষণা চালিয়েও একই রিপোর্ট পেয়েছেন যেখানে গামা তরঙ্গের উত্থান দেখতে পাওয়া গিয়েছে। বিজ্ঞানীরা ধারণা করেছে যে সকল ম্যামাল বা স্তন্যপায়ী প্রানীর জীবনের শেষ মুহুর্তে তাদের সারা জীবনের এক ঝলক অনুভব করার সুযোগ মেলে। 

শুধুমাত্র গামা তরঙ্গ নয়,  মানব মস্তিষ্কে আরো একটি জিনিসের উপস্থিতি মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের অভিজ্ঞতার কথা ব্যাখা করে। ডিএমটি বা ডাই মিথাইল ট্রিপ্টামিন নামক হরমোনের নিঃসরণ। এই নেশাকারক দিয়ে বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যে গবেষণা চালিয়েছে। গবেষণায় অংশ গ্রহণকারীরা এটি পেয়ে এক ধরনের হ্যালুসিনেশনের মধ্য দিয়ে গিয়েছে। শুন্যে ভাসার অনুভূতি, হালকা বোধ করা, কোন সময় বা স্থানের পরিসীমা অনুভব না করা, জীবনে ঘটে যাওয়া কোন ঘটনা বা স্মৃতি পরিষ্কার চোখের সামনে দেখতে পাওয়া এমন ধরনের কিছু অপার্থিব অনুভূতি। 

আর ঠিক এই সব অনুভূতির কথা বার বার বলেছে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফেরত আসা মানুষেরাও। তারা প্রায়শই মনে করতে পেরেছে অপরিসীম আনন্দ, সুখ, শান্তি ও ভালোবাসার অনুভূতির কথা। সেই সাথে মনে করেছে তাদের পুরো জীবনের এক প্যানোরামা দৃশ্য দেখার কথা। 

এতো কিছুর প্রমান পাওয়া সত্ত্বেও মৃত্যু নামক বিষয়টির পুরো ব্যাখ্যা নিশ্চিত করে দেয়া সম্ভব নয়। কারন এই পৃথিবীতে একেক জনের মৃত্যু একেক ভাবে ঘটে। সবাই চলে যাওয়ার আগে একই রকমের কল্পদৃশ্য বা সংক্ষিপ্ত জীবনী দেখতে পায় কিনা তা হলফ করে বলা মুশকিল। 

 খুব গুরুত্বপূর্ন একটা কথা বলেছে ডঃ যেমার। একজন মানুষের মৃত্যু নিঃসন্দেহে তার আপনজন ও পরিবারের জন্য কষ্টকর ও হৃদয় বিদারক। জীবনের কোনো কিছুই একজন মানুষের শুন্যতা পূরণ করতে পারেনা। তবে এটা ভেবে আপনজনেরা একটু হলেও শান্তি পেতে পারে যে, চলে যাওয়া মানুষটির শরীরের ক্রিয়া বন্ধ হবার সময় তার মস্তিষ্ক তাকে শেষবারের মত তার জীবনের একটি সুন্দর ফ্ল্যাশব্যাক দেখাতে সক্ষম হয়। 

পরিশেষে একটা কথা বলতে চাই। আমরা এ জীবনে প্রতিনিয়ত ছুটে চলেছি। নানা স্তরের হাজারো ব্যস্ততা আমাদের সব সময় গ্রাস করছে। একটু থেমে ভাবার সময় পর্যন্ত নেই যে পৃথিবীটা কত সুন্দর। পৃথিবীর বুকে ঘটে যাওয়া আমাদের জীবনের ঘটনার অনেকগুলোই স্মরণীয়, সবগুলো না হলেও। কিন্তু এগুলোর মর্ম বোঝার সময় বা ইচ্ছা আমাদের হয়না। হয়না সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া জানানোর সময়, যিনি আমাদের জীবনের প্রকৃত মালিক। 

তাই হয়তো জীবন প্রদীপ নিভে যাওয়ার আগে, প্রকৃতি কোনো এক অদ্ভুত উপায়ে আমাদের সামনে হাজির করে দেয়, সারা জীবনে আমরা কি পেয়েছিলাম। চোখ বন্ধ অবস্থাতেই আমরা দেখতে পাই আমাদের জীবনের গল্প। যে ভুবনে কত শত দিনরাত্রি পার করেছি, অতঃপর সে ভুবনের সাথে সব সম্পর্ক চুকিয়ে চলে যাই আর এক ভুবনে।  

Comments

  1. খুবই কৌতূহলোদ্দীপক একটি রচনা। পড়ে খুব ভাল লাগলো।

    ReplyDelete
  2. Beautiful compelling narrative based on scientific data…
    Want to read more like this👌🙏

    ReplyDelete
  3. Quite an intriguing topic. Enjoyed the narrative and new findings regarding the movement of Gama frequency in human brain.

    ReplyDelete

Post a Comment