একজন প্রবাসীর চোখে 'বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন'
১ম পর্ব ~
একজন ক্ষমতালোভী, স্বৈরাচারী শাসক যিনি ভেবেছিলেন তিনি ধরা, ছোঁয়ার বাইরে - UNTOUCHABLE একদল বুদ্ধিদীপ্ত, সাহসী তরুণ যারা জানতো তারা অপ্রতিরোধ্য - UNSTOPPABLE
এরপরের ঘটনা আপনাদের সবার জানা। আমাদের প্রাণপ্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশের দ্বিতীয় জন্ম, দ্বিতীয় স্বাধীনতা। তিন দশকের বেশী সময় ধরে দেশের বাইরে থাকা একজন প্রবাসী বাঙালি হিসেবে আমি কিভাবে দেখেছি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকে?
জুলাই ২০২৪ঃ
জুলাই মাসের মাঝামাঝি আমরা গিয়েছিলাম সপরিবারে গ্রীষ্মের ছুটি কাটাতে। এবারের গন্তব্যস্থল ছিল ইউরোপ ও আফ্রিকা। ভেবেছিলাম ফিরে এসে আমার ভ্রমণ কাহিনী নিয়ে লিখবো। তা আজ লিখতে বসেছি। তবে ভ্রমণ কাহিনী নয়, কোটা আন্দোলন নিয়ে। ভ্রমণ কাহিনী পরে লেখা হবে।
আমাদের যাত্রার প্রথম স্টপ ছিল স্পেইন এর মাদ্রিদ। সেদিন ছিলো ১৬ই জুলাই। এয়ারপোর্ট থেকে আমাদের এয়ার বিএনবি তে পৌঁছে ভাবলাম একটু গোসল সেরে ফ্রেশ হয়ে নিই। তারপর ঘুরতে বেরুবো। ওমা, বাথরুম থেকে বেরুতেই আমার হাসব্যান্ড হন্তদন্ত হয়ে বললেন, দেশের অবস্থা খুবই খারাপ। শিক্ষার্থীরা কোটা আন্দোলন করতে গিয়ে মারা পড়ছে তবুও পিছে হটছে না। ফোন করে একটু খবর নিওতো সবাই ভালো আছে কিনা।
তাড়াতাড়ি ফোন হাতে নিলাম। ঢাকা, ছাত্র আন্দোলন গুগল সার্চ দিতেই অনেকগুলো খবর ফিডে চলে এলো। এক নিঃশ্বাসে পড়তে লাগলাম। আগে কিছুটা জানা থাকলেও আরো ভালো করে জানলাম কোটা আন্দোলন এর কথা। কোটা আন্দোলন এর পুরো নাম কোটা সংস্কার আন্দোলন যেটা শুরু হয়েছিল এবছর ১ জুলাই থেকে। তবে এর মূল সূত্রপাত বেশ কয়েক বছর আগে যেটা বারে বারে পরিবর্তন, বাতিল, সংযোজন করা হয়েছিল। এবছর আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল কোটা সংস্কার - সরকারি চাকরির সব পদে সর্বোচ্চ পাঁচ শতাংশ কোটা রাখা যাতে মেধার ভিত্তিতে উপযুক্ত ব্যক্তি নিয়োগ হওয়া থেকে বাদ না হয়। মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট ধারীর পরিবারের কেউ যাতে আত্মীয়ের সুবাদে চাকরি না পায়।
আমার মনে হল, এটা খুবই যুক্তিযুক্ত কথা। সুপারিশ বা পরিবারের সুবাদে চাকরি পাওয়ার কথাতো পাশ্চাত্যের দুনিয়াতে চিন্তাই করা যায়না। বিশেষত সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে। চাকরিতে ঢুকার আগে সবাইকে কম বেশী ইন্টারভিউ দিতে হয়। সেটা কারো রিকমেন্ডেশনে গেলেও একই কথা। এরপর অন্যান্যদের সাথে প্রতিযোগিতা করে যোগ্যতা বিচারের ভিত্তিতে ফাইনাল প্রার্থীকে নির্বাচন করা হয়।
আমাদের ঘোরাঘুরি মাথায় উঠলো। যতগুলো দর্শনীয় জায়গা দেখতে যাই না কেন মাথার ভেতরে সারাক্ষণ একই জিনিস ঘুরছিলো। কি চলছে দেশে? হাতের মুঠোফোনে সারাক্ষণ নিউজ আপডেট ফলো করছিলাম। প্রথম দিকে সভা, সমাবেশ এর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও ১৬ জুলাই থেকে এই আন্দোলন ভয়াবহ আকার ধারণ করলো। পুলিশের নির্বিচার গুলিতে নিরস্ত্র শিক্ষার্থীর মৃত্যু সারা দুনিয়ায় বাঙালি জাতিকে কাপিয়ে তুলল। এর কয়েক দিনের মধ্যে অগণিত ছাত্র জনতার মৃত্যুর খবরে বিশ্ববাসী বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো। আন্দোলনরত শিক্ষার্থী, সাংবাদিক, পথচারী, সেবাদাতা, ভলান্টিয়ার কর্মী, এমনকি আন্দোলনের বাইরে দোকানদার, রিকশাওয়ালা, গার্মেন্টস কর্মী, শ্রমিক, নিরাপত্তা কর্মী কেউ বাদ গেলোনা। যখন খবরে এলো, ছোট ছোট শিশুরা বাবার কোলে, ছাদে খেলতে গিয়ে, জানালায়, বারান্দায় কি হচ্ছে দেখতে গিয়ে, কোনো কিছু বোঝার আগেই শহীদ হয়েছে, বাঙালীর হৃদয় কেঁপে উঠলো এই সহিংস নাশকতায়। কারোর মাথায় এলোনা সরকার কি করে পারে অবলীলায় এই হত্যাযজ্ঞ সম্পন্ন করতে।
আল্লাহ্র দুনিয়াতে কোনো কিছুই নজর এড়ায়না। টেকনলজি এখন এতই দূর্দান্ত এবং নিখুঁত যে, কোন ঘটনার সাক্ষ্য প্রমান রাখা বা ছবি, ভিডিওতে ধারণ করা কোন ব্যাপারই না আজকের যুগে। অসংখ্য ছবি, ভিডিও, রিল, স্টোরি, মেসেজ, শর্ট ক্লিপ, মুহুর্তের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লো বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে ঘিরে। প্রবাসী বাঙালীরা বিভিন্ন পোস্টের মাধ্যমে একদিকে যেমন দেখল আসলে কি ঘটছে অন্যদিকে অবাক বিস্ময়ে হজম করলো সরকার কি বলছে যে কোনো কিছুর জন্য তারা দায়ী নয়। আর কি করছে, অতিরিক্ত বল প্রয়োগ ও সুনির্দিষ্ট হত্যাকান্ড চালিয়ে। যে কোন বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন বাঙালির বুঝতে বাকি রইলোনা ফ্যাসিবাদী সরকারের প্রহসন আর অপপ্রচার।
নিরপরাধ মানুষ কোনো ভাবেই অকারণে প্রাণ হারাতে পারেনা - এই একটা চিন্তাই সারা বিশ্বের দেশপ্রেমিক বাঙালিদের বিবেককে নাড়া দিল। লাগামহীন হত্যা, রাতের আঁধারে গ্রেফতার, নির্যাতন, হয়রানি, হুমকির খবর অনবরত নিউজ পোর্টাল গুলোতে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসতে থাকলো। দেশের ভাইবোনদের জন্য, তরুণ সমাজের জন্য কিছু করার জন্য আকুলি বিকুলি করে উঠলো প্রবাসী বাঙালির মন। দেশের বিভিন্ন স্তরের ব্লগার, ইউটুবার,ইনফ্লএন্সার, অ্যাকটিভিস্টদের ডাকে সাড়া দিল পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা প্রবাসী বাঙালি সমাজ।
আন্দোলন ছড়িয়ে পড়লো দেশ, মহাদেশ, সাগর পেড়িয়ে দূর দুরান্তের ভুখন্ডে। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, মধ্যপ্রাচ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন শহরে রাগে, ক্ষোভে ফেটে পড়লো উত্তেজিত বাঙালীরা। রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রতিবাদী শ্লোগান, প্রটেস্ট, ব্যানার, বাংলাদেশে দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ, জনসমাবেশ, যে যার জায়গা থেকে অংশ নিল এই আন্দোলনে।
অকুতোভয় রেমিট্যান্স যোদ্ধারা সাড়া দিল তাদের জায়গা থেকে। জুলাই মাসে দেশে রেমিট্যান্স পাঠানো তারা কমিয়ে দিলো বা বন্ধ করে দিল। অনেক রেমিট্যান্স যোদ্ধা আন্দোলনে স্বজন হারালো। তবুও সেই কষ্ট বুকে চেপে সামাজিক মাধ্যমে তারা পোস্ট দিল - প্রিয় ভাইবোনেরা, আমাদের দেশটাকে আগে স্বাধীন করুন। এরপর দ্বিগুণ পরিশ্রম করে অধিক রেমিট্যান্স পাঠিয়ে পুষিয়ে দিবো। আমি তাদের পোস্ট পড়ে আবেগে আপ্লূত হলাম। আহা, কি অপূর্ব তাদের দেশপ্রেম, কি কঠিন তাদের দেশের প্রতি টান।
এদিকে কিছুদিন পরপর ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়ে অমানবিক হত্যাযজ্ঞ চালানোর খেলায় মেতে উঠলো রক্তপিপাসু সাবেক সরকার। কিন্তু তাতে একটুও দমলোনা জেন যি প্রজন্মের ছাত্র সমাজ। ভিপিএন ব্যবহার করে এবং বিভিন্ন মহল্লায় এলাকা ভিত্তিক ওয়াইফাই চালু ও শেয়ারের মাধ্যমে ছাত্র সমাজ এবার সাহায্য চাইলো, আন্তর্জাতিক কমিউনিটি ও অভিবাসী বাঙালিদের কাছে। সাহায্য চাইলো অবাঙালি ইন্টারন্যাশনাল কনটেন্ট মেকারদের কাছে। তাদের আকুল আবেদন ভেসে উঠলো সকলের স্ক্রিনে স্ক্রিনে - আমাদের সাহায্য করুন। আমাদের ইন্টারনেট বন্ধ করে দিলে আপনারা হবেন আমাদের ভয়েস। আহা, এমন ডাকে সাড়া না দিয়ে কি চুপচাপ বসে থাকা যায়।
তাই এবার মাঠে নামলো অনলাইন যোদ্ধারা। প্রবাসীরা হয়ে উঠলো বিপ্লবী। দেশের বাইরে থাকা বাঙালীরা সামাজিক মাধ্যমে তুলল প্রতিবাদী ঝড়। বিভিন্ন ধরনের তথ্য, ছবি, ভিডিও নিউজ, আর্তি, আবেদন, সহযোগিতা, সহমর্মিতা, হুশিয়ারি বার্তা, আল্লাহ্র দরবারে দোয়া এমন বহুমুখি প্রচারণায় ভরিয়ে তুলল তাদের ফেইসবুক স্ট্যাটাস, ওয়াল, ব্লগ, ইনবক্স, ইউটিউব চ্যানেল ও অন্যান্য যোগাযোগ মাধ্যম। পোস্ট, রিপোস্ট, শেয়ার করলো প্রয়োজনীয় সব গ্রুপে। ভাইবোনদের ডাকে সাড়া দিয়ে বদলে ফেললো প্রোফাইল ছবির রং।
আমেরিকার অনেক শহরে বাঙালিদের সম্মিলিত আবেদন পাঠানো হলো তাদের লোকাল কংগ্রেস প্রতিনিধির কাছে। কোনও ভৌগলিক সীমারেখা নয়, স্থান, কাল, বয়স নির্বিশেষে বাঙালীরা অনুভব করলো একাত্মতা, ইন্টারনেট কালচারে একাত্মতা। অনুভব করলো বাঙালীরা কতটা একত্রিত জাতি দেশের ভিতরে, দেশের বাইরে।
সবাই অবশ্য ফেইসবুকে সমান সোচ্চার হলনা। বাঙালিদের মধ্যে অনেকেই দ্বিধা দন্দে ভুগছিল যে কিছু পোস্ট করা বা শেয়ার করা ঠিক হবে কিনা। অনেকে ছিল ভয়ে শংকিত যে সব কিছু যখন আবার আগের মত হয়ে যাবে, তখন তো এইসব পোস্ট গুলোকে ট্র্যাক করা হবে। কে পোস্ট দিয়েছে বের করা হবে। হয়তো এই সব ভেবেই একদল ফেইসবুকার একদম চুপ মেরে গেলো। কেউ কেউ আবার ছাত্র আন্দোলনের বিপক্ষে সরকারের পক্ষে সাফাই গাইতে লাগলো। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঢেউ তাদের বিন্দুমাত্র নড়াতে পারলোনা। নিরপরাধ ছেলেমেয়ে, শিশু, কিশোরের মৃত্যুতে তাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হলনা। ঘটনা কোথায় গিয়ে ঠেকে এই অপেক্ষায় তারা বসে রইলো। এইসব বাঙালিদের খামোশি, নিরবতা ও নির্লিপ্ততা দেখে খুব অবাক হলাম।
ইতিমধ্যে আমরা ছুটি শেষে বাড়িতে ফেরত এসেছি। জুলাই শেষ হতে আর কটা দিন বাকি। আমি প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্ত বাংলাদেশের শ্বাসরুদ্ধকর ঘটনার বিবরণ পাচ্ছি, ছবি ভিডিও দেখছি। আমি সব সময় এতো অন্যমনস্ক ও মন খারাপ করে থাকতাম যে ছেলেরা একদিন জানতে চাইলো, আম্মু তোমার কি হয়েছে। আমার দুই ছেলে জেন জি প্রজন্মের। ওদের চিন্তাধারা অনেক ভিন্ন, জীবন সম্পর্কে ধ্যানধারণা ভিন্ন। ওরা পরিবর্তনে বিশ্বাসী, আর তা আনতে চায় সম্মিলিত বা দলীয় প্রচেষ্টার মাধ্যমে। ওরা রেভ্যুলেশনারী জেনারেশন, এক জনের ডাকে হাজারো জন ছুটে আসে। ওরা বুক পেতে নিজের অধিকার আদায় করতে প্রস্তুত হয়। আবার বুক পেতে অন্যের অধিকার রক্ষায় সোচ্চার হয়।
আমি আমার ছেলেদের বললাম, বাংলাদেশের বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের কথা। চেনালাম নাহিদ, আসিফ, সারজিস, হাসনাতের মত সাহসী যোদ্ধাদের। বন্দুক, গুলি আর গ্রেনেড যাদের থামাতে অক্ষম। ওদেরকে জানালাম, আবু সাইদ, মুগ্ধ, ফাইয়াজ, ইয়ামিন, শান্ত, তামিম, রিয়ার কথা। বলতে বলতে আমার চোখ ভিজে উঠলো।
আমাকে অবাক করে দিয়ে ছেলেরা বলল, আজকে যদি আমাদের বাংলাদেশে জন্ম হতো, আমরা যদি বাংলাদেশে থাকতাম, তাহলে তুমি নিশ্চয় আমাদের এই আন্দোলনে যেতে দিতে। আমি বললাম, আলবত দিতাম। আর তোমাদের পেছনে দূর্বার শক্তি হয়ে আমি ও তোমার বাবা শামিল হতাম।
২য় পর্বের লিংক - একজন প্রবাসীর চোখে 'বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা'
Fantastic storytelling. Read it in one breath. Thank you for documenting this history. Waiting eagerly for the next part
ReplyDeleteVery nice explanation.
ReplyDeleteপ্রবাসীর দৃষ্টিতে এই আন্দোলনের অর্থ ছিল দেশকে নিয়ে নতুনভাবে স্বপ্ন দেখা। ইতিহাসের পাতায় লেখা হবে এই বিপ্লবের কাহিনী, পরে হয়ত ইতিহাসকেও কেউ বিকৃত করার চেষ্টা করবে। কিন্তু সত্য চিরকালই সত্য থেকে যাবে এই ব্লগের পাতায়, ক্যামেরাবন্দী ছবি আর ভিডিওতে, সাহিত্যে, কবিতায়, গানে, যার প্রত্যক্ষদর্শী আমরা সকলে দেশে-বিদেশে।
ReplyDeleteতোমার প্রতিবেদনে সমগ্র ঘটনার একটি চিত্র পেলাম। অনেক ধন্যবাদ।
ReplyDelete