একজন প্রবাসীর চোখে 'বাংলাদেশের ২য় স্বাধীনতা'
২য় পর্ব ~
ওই মেয়েটির ভিডিও ক্লিপ মুহূর্তের মধ্যে ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল। আমিও সেটি দেখেছি। সাংবাদিক সাহেব যখন প্রশ্ন করলো আন্দোলনে যোগ দেয়া স্কুল ছাত্রী মেয়েটি বলল, 'অনেক সুযোগ ছিল পিছনে ফিরে যাওয়ার। এখন আর পিছনে ফিরার রাস্তাই নেই। পিছনে পুলিশ, আর সামনে স্বাধীনতা। অবশ্যই আমরা সম্মানের সাথে মৃত্যু গ্রহণ করতে রাজী আছি।' ক্লিপটি দেখে শিউরে উঠেছিলাম। কতটা সাহসী আর বদ্ধপরিকর হলে একটা অল্পবয়সী মেয়ে তার সম্ভাবনাময় জীবনের হাতছানি ছেড়ে, মৃত্যুর দরজায় দাঁড়াতে প্রস্তুত থাকে।
অগাস্ট ২০২৪ঃ
প্রবাসে জীবনে একটা খবর প্রায়ই চোখে পড়ে। কোনো জঙ্গলে বা ফরেস্টে আগুন লেগেছে আর সেই আগুন নেভাতে বা দমন করতে দমকল বাহিনীর দারুণ বেগ পেতে হচ্ছে। এটাকে বলা হয় ওয়াইল্ড ফায়ার। অতিরিক্ত গরমে এবং শুষ্ক আবহাওয়ায় ঘন অরন্যের মাঝখানে কোনো বজ্রপাত বা বৈদ্যুতিক লাইনের শর্ট সার্কিটের কারনে একটি ছোট অগ্নিস্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি হয়। তারপর সেখান থেকেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে এক গাছ থেকে আর এক গাছে এবং বনের পর বন উজার করে দেয় সেই ওয়াইল্ড ফায়ার, যা দিনের পর দিন ধরে চলতে থাকে।
ওয়াইল্ড ফায়ার এর দাবানলের মতই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়লো রাস্তায়, মহল্লায়, শহরে, মফস্বলে, জেলায়, উপজেলায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীর সাথে যোগ হল স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। তাদের সাথে যোগ হল শিক্ষক-শিক্ষিকা, অভিভাবক, আইনজীবী, ব্যারিস্টার, সমাজকর্মী, শিল্পীসমাজ, চিকিৎসক-সমাজ। নেমে এলো রিকশাওয়ালা, দোকানদার, শ্রমিক, খেটে খাওয়া দিনমজুর। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন পরিণত হল ছাত্র-জনতার আন্দোলনে। ওদের নয় দফা নেমে আসলো এক দফায়, ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন।
অগাস্ট মাসের শুরুতেই অসংখ্য ছাত্র-জনতা শাহাদাত বরণ করলো। আহত অবস্থায় বিপুল সংখ্যক আন্দোলনকারী হাসপাতালে ভর্তি হল, হাত-পা হারিয়ে চিরজীবনের জন্য পঙ্গু হলো, দৃষ্টিশক্তি হারালো। অনেক আন্দোলনকারী জেলহাজত ও কারাগারে অমানবিক অবস্থা ও পাশবিক নির্যাতনের শিকার হল। প্রতিনিয়ত বিশ্ববাসী বাঙালিরা খবর পাচ্ছিলাম বিভিন্ন জায়গায় ঘটে চলা বিক্ষোভ, সংঘাত, ভাংচুর, সংঘর্ষ, অগ্নিসংযোগ এর। আরো খবর পাচ্ছিলাম হামলা, গণহত্যা, গণগ্রেপ্তার, রিমান্ড ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের।
গণ-অভ্যুথানের ফলাফল কি হবে এই ব্যাপারে বিশ্ববাসী অধীর উত্তেজনায় অপেক্ষা করছিল। আমেরিকার সাথে বাংলাদেশের সময়ের ব্যবধানের কারনে দেশে যখন দিন হয়, আমেরিকাতে তখন রাত হয়। ৫ অগাস্টের কর্মসুচি লং মার্চ টু ঢাকা শুরু হওয়ার সাথে সাথে আমার রাতের ঘুম হারাম হল। রাত জেগে অনবরত নিউজ আপডেট চেক করতে করতে এক সময় খবর দেখলাম, দেশের সেনাপ্রধানের ভাষণ এবং স্বৈরাচারীর দেশত্যাগ। অবশেষে ২৩ দিনের দেশ কাঁপানো আন্দোলনের শুভ পরিণতি লাভ এবং সারা দেশে ব্যাপক বিজয় উল্লাস, বিজয় মিছিল।
বিজয় উদযাপনের পাশাপাশি আরো কিছু নির্মম বাস্তবতা আমাদের চোখের সামনে পরিষ্কার হল। এই গণ-অভ্যুথানে যারা শহীদ হল তারা আর কোনো দিন জানতে পারলো না আমাদের বিজয় অর্জনের কথা। বাড়িতে চিঠি লিখে আন্দোলনে চলে যাওয়া অসংখ্য কিশোর, তরুণ, শিক্ষার্থী পরবর্তীতে আর স্বাধীনতার আনন্দ মিছিলে যোগ দিতে পারলোনা। তাদের হারিয়ে বাবা-মায়ের বুক খালি করা আর্তনাদ দেশের আকাশে-বাতাসে প্রকম্পিত হল।
আয়নাঘর, ডিবি হাজতে আটকে থাকা মানুষগুলোর মুক্তির পরে তাদের উপর সংগঠিত বর্বরতা ও অত্যাচারের যে সব বিবরণ গণমাধ্যমে আসতে লাগলো, তা দেখে জাতি শিহরিত হলো। বহু পরিবারে হারিয়ে যাওয়া বাবা, ভাই, সন্তানের খোঁজে পাগলপ্রায় সদস্যরা কোনো না কোনো ভাবে নিজেদের বুঝ দিলো যে তারা আর ঘরে ফেরার নয়। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু শিক্ষার্থী মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ট্রমায়, আতংকে রাত ও দিন কাটাতে থাকলো। চোখের সামনে দেখা তাদের বন্ধু, সহপাঠী বা বড় ভাইয়ের বুলেটবিদ্ধ হয়ে, কুপিয়ে, আগুনে পুড়ে মৃত্যুবরণের দৃশ্য তারা কোনোদিন ভুলতে পারলোনা।
স্বৈরাচারী শাসক পতনের তিন দিন পর নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ডঃ মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। এই সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলীতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুজন সমন্বয়কও আছেন। এই সরকার ক্ষমতায় এসে প্রথম চোটেই দেশের গুরুত্বপূর্ণ শাখাগুলিতে যেমন মানবাধিকার, অর্থনীতি, আইন, পুলিশ ও প্রশাসন ব্যবস্থায় বিভিন্ন জরুরী পদক্ষেপ সহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলেন।
তবে এতো কিছুর পরেও ছাত্রসমাজের দায়িত্ব কিন্তু শেষ হল না। এরপর তারা দেশ সংস্কারের অভিযানে নামলো। রাস্তাঘাট পরিষ্কার, ট্রাফিক কন্ট্রোল, লুট করা টাকা-পয়সা, অস্ত্র পুনরুদ্ধার চলতে থাকলো। চলতে থাকলো পাড়ায়-মহল্লায় চুরি-ডাকাতি রোধে রাতভর টহল ও প্রতিরক্ষা। চলল মন্দির, গীর্জায় সংখ্যালঘুদের প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা। বিদেশি শক্তি দ্বারা প্ররোচিত পাল্টা অভ্যুথানের কয়েকটি প্রচেষ্টাও তারা শক্ত হাতে নস্যাত করলো। করলো দূর্নীতি দমন পরিকল্পনা ও ঘুষের বিরুদ্ধে কার্যকরী অ্যাপের উদ্ভাবন। এরপর ছাত্রেরা এগিয়ে এলো বন্যা কবলিত মানুষের সাহাযার্থ্যে ত্রান সামগ্রী বিতরন ও পূনর্বাসনে। কাজের যেন আর শেষ নেই।
খবরগুলো যতই পড়তাম ততই বিস্ময়ে অভিভূত হতাম। মনে হতো, ছেলেমেয়েগুলির বুঝি আর ঘরে ফেরার সময়ই হবেনা। এখনো এক জনের ডাকে সবাই ছুটে আসে, জনসাধারণের সাহায্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কি তাদের দেশপ্রেম, দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা। কি দারুণ সুচিন্তা ও আদর্শের ভিত্তিতে একটি সুন্দর বাংলাদেশের ছবি তারা তাদের মানসপটে এঁকে চলেছে। বাংলাদেশের নব্যপ্রাপ্ত দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জনে এই ছাত্রসমাজের ঋণ কোনোদিন শোধ হবেনা। এই ছাত্রসমাজের একেকজন যেন স্বর্ণসন্তান। এমন সূর্যসন্তান গর্ভে ধারণ করতে পেরে আমার দেশের মায়েরা ধন্য। সারা দুনিয়ার মানচিত্রে বাংলাদেশের এই দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জন এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্তের প্রতীক হয়ে জ্বলছে।বর্তমানে দেশে-বিদেশে বাঙালিরা অনেকেই খুব সন্দিহান বাংলাদেশের একটি সুন্দর ভবিষ্যতের ব্যাপারে। সামাজিক মাধ্যম খুললেই যার প্রমান পাওয়া যায়। অনেক অনেক নেতিবাচক কমেন্ট, উপহাস, পরিহাস, ব্যঙ্গ, অপমানকর জবাব, অবমাননাকর মন্তব্য প্রতিনিয়ত কেউ না কেউ দিয়ে চলেছে। এটা খুবই দুঃখজনক। এই বিষয়ে আমি কয়েকটা কথা বলতে চাই।
বিগত পনেরো বছর আমরা তো সবাই চুপ ছিলাম। আমাদের মুখ বন্ধ ছিল অথবা বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। এমনকি বিদেশে বসে সহজে কিছু বলতে পারলেও দেশে গেলে আমরা একদম বোবা বোনে যেতাম। বেড়াতে গিয়ে অকালে প্রাণ হারানোর ভয় আমাদের সবারই ছিলো। তা এখন যখন আর সেই ভয় নেই, তখন আমরা কি একটু গঠনমূলক উপায়ে বাকস্বাধীনতার চর্চা করতে পারিনা? কেন প্রতিটি বিষয়ের কঠোর সমালোচনা করতে হবে? কেনো প্রতিটি বিষয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার থেকে শুরু করে কাউকে না কাউকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে হবে? অনলাইনে বসে কমেন্ট লেখা অনেক সহজ, টকশো বা ইন্টারভিউতে বসে কাউকে নীচু দেখানোও সহজ। কিন্তু প্রকৃত দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেয়া অনেক কঠিন। সেই যোগ্যতা, মেধা বা দূরদৃষ্টি সবার থাকেনা। অনলাইন কম্যুনিটির কাছে আমার অনুরোধ, এতো বেশী কট্টর সমালোচনা করা থেকে আপাতত বিরত থাকুন।
দ্বিতীয় কথা যেটা বলতে চাই, একটু ধৈর্য ধরুন। সময় গেলে অনেক কিছু বোঝা যায়, উপলব্ধি করা যায়। ঘরের কোণে একটা ময়লার ঝুড়ি যখন আবর্জনায় ভরে উপচে পড়ে, তখন তা দ্রুত অপসারন করা যায় বা ঝুড়িটা বদলে ফেলে যায়। কিন্তু ঝুড়িটা যেই ঘরে আছে সেই ঘরসহ পুরো বাড়িটা যখন ভেঙ্গে পড়ে, নোনা ধরে, স্তুপীকৃত পচা আবর্জনার দূর্গন্ধে, পোকামাকড় কীটপতঙ্গের আস্তানায় পরিণত হয়, তখন সেই বাড়িটাকে পরিষ্কার করতে, পরিশোধন করতে অনেক সময় লাগে। তখন সেটা আর ছোট একটি কাজ নয়, বরং একটি বড়সড় কার্যক্রমে পরিণত হয়। বাংলাদেশের সামগ্রিক সংস্কার সাধন ওই কার্যক্রমের চাইতেও বড় এবং জটিল একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। এখানে শুধু দেশ নয়, বাঙালিদের মানসিকতারও সংস্কারের প্রয়োজন। আর আমরা বাঙালিরা চাইলে অবশ্যই সেটা করতে পারি।
কথা শেষ করছি জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেয়া প্রধান উপদেষ্টা ডঃ ইউনুসের বক্তব্য দিয়ে। প্রবাসীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেছিলেন, 'এই গণ-অভ্যুথানে বিদেশে অবস্থানকারী বাংলাদেশিরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। জাতি তাদের অবদান বিশেষ ভাবে স্মরণ করবে। নতুন বাংলাদেশ গড়ার কাজে আমরা তাদের অংশ গ্রহণ চাইবো।'
আসুন, আমরা প্রবাসী বাঙালিরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেই। যে যেই দেশে আছি, যেই অবস্থানেই থাকিনা কেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে একবার বিপ্লবী হয়েছি, এবার নাহয় দেশ পুণর্গঠনে উদ্যোগী ও উদ্যমী হই। আবারও প্রমাণ করি বাঙালিরা কতটা একত্রিত জাতি, দেশের ভিতরে দেশের বাইরে।
অত্যন্ত জোড়ালো এবং সাবলীল লেখা। একটি লাইন আমার কাছে লাখ কথার এক কথা মনে হচ্ছে আর তা হলো 'এখানে শুধু দেশ নয়, বাঙালিদের মানসিকতারও সংস্কারের প্রয়োজন'। আমার মতে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।
ReplyDeleteThank you for documenting the history of our new independence through the recent Student Movement. We will always be indebted to all the innocent patriotic children & adult citizens that we have lost
ReplyDelete