একুশ দিনের গল্প - ৩য়
পাঠকের জন্য এর আগের পর্বের লিংকঃ একুশ দিনের গল্প - ২য়
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------
পুরো একটা সপ্তাহ কাটলো দারুণ আনন্দে। হলুদ, মেহদী, বিয়ে, ফিরানি, সব মিলিয়ে অনেক ফূর্তি, অনেক হৈ চৈ হলো। আমার ভাগ্নি জামাই খুব ট্যালেন্টেড একটি ছেলে। সে মিডিয়া লাইনে আছে বহু দিন ধরে। একাধিক চ্যানেলে টিভি কমার্শিয়ালে অভিনয়, টিভি শো হোস্টিং, কমেডি ক্লাব প্রেজেন্টার, এমন বিভিন্ন ধারার শৈল্পিক কর্মকান্ডে তার বিচরণ। ও পরিবারের বড় ছেলে হওয়ায় এই বিয়েতে ওর বাবা মা, ছোট দুই ভাই, ওদের আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব সহ অনেক আনন্দ করলো।
ঐদিকেআমার বোনের মেয়েটা আমাদের পরিবারের একমাত্র মেয়ে। আমার মা তার একমাত্র নাতনির বিয়েতে খুব আনন্দ করলেন। শরীরে ব্যাথা বেদনার কষ্ট নিয়েও তিনি খুশী মনে নাতনির মেহেদিতে নাচলেন, গাইলেন, সবার সাথে আনন্দ ফূর্তি করলেন। আমরা দুই বোন আমাদের একমাত্র ভাগ্নির মেহেদীতে মন উজার করে নাচলাম, প্রাণ খুলে হাসলাম। এর আগে আমাদের পরিবারের শেষ বিয়েটা ছিল আমার, ঠিক বিশ বছর আগে। আমার বিয়ে হয়েছিল নিউইয়র্কে। তখনও সবাই অনেক আনন্দ ফূর্তি করেছিলো।
সব কিছু ভালোই চলছিলো। মা এবার আমার সাথে আমেরিকায় আসতে রাজী হয়েছিলেন, আমি খুবই খুশী। মা আমেরিকায় এসেছিলেন প্রায় ছয় বছর আগে। আমার ছেলেরা এখন বড় হয়েছে। মা আমাদের এখানে এলে তারা তাদের নানিমা'র সাথে দারুণ সময় কাটাতে পারবে। আমেরিকার নাগরিক হিসেবে আম্মা চিকিৎসার ক্ষেত্রে অনেক সুযোগ সুবিধা পাবেন। ডাক্তারের চেকআপ এর পাশাপাশি তাকে নিয়ে আমরা অনেক জায়গায় ঘুরতে যেতে পারবো।
আমাদের আমেরিকা আসার ঠিক এক সপ্তাহ আগে, জানুয়ারি মাসের আঠারো তারিখ সকালবেলা নাস্তা শেষে, আমি আর মা গিয়েছি উপরতলায় বড় আপার বাসায়। ওখানে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমরা কথা বলছি, মা যখন পাঁচতলায় শিফট হবেন তখন মা'র ফার্নিচারগুলো কোথায় কোনটা রাখা হবে এই নিয়ে। কথা বলতে বলতে একটু আলাদা হয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে ছিলাম। আবার ফিরে মা'র দিকে তাকিয়ে দেখি, মা আস্তে আস্তে পড়ে যাচ্ছেন। কোথাও কোনো ধাক্কা বা বাড়ি খাওয়া ছাড়াই চিত হওয়া ভঙ্গিতে তিনি ধীরে ধীরে স্লিপ করলেন। মনের অজান্তেই খুব জোরে মুখ দিয়ে বেড়িয়ে এলো, আম্মা.....এক দৌড়ে মা'র দিকে প্রাণপণে ছুটে গেলাম।
আমি দৌড়ে পৌঁছানোর আগেই মা মেঝেতে পড়ে গেলেন আর কোমড়ে প্রচণ্ড আঘাত পেলেন। মা'কে পড়তে দেখে একটু দূরে দাঁড়ানো কেয়ারটেকার ছেলেটা দৌড়ে এলো। বাম কোমড়ের সাথে সাথে মা উনার মাথার পেছনে এবং কানেও প্রচন্ড আঘাত পেলেন। আমার চিৎকার ও কান্নাকাটি শুনে ইতিমধ্যে বাড়ীর গৃহকর্মী দু'জনও দৌড়ে এলো। খবর পেয়ে বড় আপা ইউনিভার্সিটি থেকে ছুটে আসলো। আমার ভাগ্নি তার জামাইকে নিয়ে শ্বশুর বাড়ি থেকে চলে এলো।
প্রায় ঘন্টা খানেক ধরে গরম শেক, ঠাণ্ডা শেক, ব্যাথার মালিশ, ব্যাথার ওষুধ, কোনোটাই যখন কাজে দিলো না, তখন ঠিক করা হল আম্মাকে হাসপাতালে নিতে হবে। আমাদের বাড়ি থেকে সবচেয়ে নিকটবর্তী হল, ইউনাইটেড হাসপাতাল। হাসপাতালের অ্যামবুলেন্স ডাকা হল। আম্মা ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছেন, আমরা অধীর ভাবে অপেক্ষা করছি অ্যামবুলেন্সের জন্য।
প্রায় তিরিশ মিনিট পর সাইরেন বাজিয়ে অ্যামবুলেন্স এসে গলির মুখে পৌঁছালো এবং দেখলো, আমাদের তেইশ নাম্বার রাস্তাটি প্রায় পুরাটাই কাটা। রাস্তার মধ্যে একটু পর পর বিশাল, গভীর গর্ত করা। ওহ, আমি তো বলতে ভুলেই গেছি.....
আমি যেদিন ঢাকায় পৌঁছাই, সেদিন সকাল থেকেই বাড়ীর সামনের রাস্তাটা কাটা শুরু হল। দারোয়ান পাঠিয়ে জিজ্ঞেস করে জানা গেলো, ঢাকা সিটি কর্পোরেশন থেকে বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে যে রাস্তা খুঁড়ে নতুন ভাবে সোয়ারেজ লাইন বসানো হবে। কাজটা করতে কতদিন লাগবে জিজ্ঞেস করতে, প্রথমে মিস্ত্রি গোছের কিছু লোকজন কিছুই বলতে পারলোনা। আরো কিছুক্ষণ অনুসন্ধান চালিয়ে কেয়ারটেকার খবর নিয়ে এলো যে কয়েক দিনের মধ্যেই পুরা কাজ সম্পন্ন হবে।ইউনাইটেড হাসপাতালের অ্যামবুলেন্স, রাস্তার ভেতর কেটে রাখা খানাখন্দের উপর দিয়ে আসতে গিয়ে গর্তে পড়ে গেলো। গাড়ী থেকে নেমে অ্যামবুলেন্সের দুইজন হাসপাতাল কর্মী ও আমাদের বাড়ির কেয়ারটেকার ও দারোয়ান মিলে আরো বিশপচিশ মিনিট ধাক্কাধাক্কি করে অ্যাম্বুলেন্সটিকে পুনরায় রাস্তার সমতলে আনতে সক্ষম হলো।
বহু দিন ধরে আমেরিকায় থাকার ফলে আমি পুরোপুরি অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম, বিছানাসমেত চাকাওয়ালা, সুপ্রশস্ত, মজবুত ও শক্ত স্ট্রেচার দেখতে। অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামিয়ে যখন কর্মী দুজন একটি লম্বা ও চিকন, লোহার দুটা রড ও মাঝখানে এক প্রস্থ কাপড় দেয়া অদ্ভুত দেখতে একটা স্ট্রেচার উপরে নিয়ে আসলো - চোখের পলকে আমার মস্তিষ্কের ভেতর এক আচমকা বোধোদয় ঘটলো যে এটা আমেরিকা নয়, বাংলাদেশ। আমেরিকায় যাওয়ার এক সপ্তাহ আগে আমার মায়ের এক চরম দূর্ঘটনা ঘটেছে। তিনি পড়ে গিয়ে খুব সম্ভবত হাড্ডি ভেঙ্গেছেন। এখন তাকে হাসপাতালে নিতে হবে। আমার মায়ের কোমড়ের যাবতীয় চিকিৎসা এই বাংলাদেশের মাটিতেই হবে। এ দেশে বসে তাই আমেরিকার নাগরিকত্ব, মা'কে সর্বোন্নত দেশের সর্বাধুনিক চিকিৎসা পাইয়ে দিতে পারবেনা। এটা অনেকটা রিয়ালিটি চেকের মত।
বাংলাদেশের স্ট্রেচার এর আকৃতি ও সাইজ এমন যে এটা লিফটের ভেতর আটে না। তাই ছয়জন পুরুষ মানুষের সম্মিলিত শক্তি ও অদ্ভুত কোঅর্ডিনেশন ক্ষমতার জোরে, মা'কে স্ট্রেচারে শুইয়ে সিঁড়ি দিয়ে পাঁচতলা থেকে একতলায় নামিয়ে আনা হলো ও অ্যামবুলেন্সে তোলা হলো। এক অজানা আশংকা ও ভয় নিয়ে আমি আর বড় আপা অ্যামবুলেন্সে চড়ে বসলাম।
পো পো সাইরেন বাজিয়ে অ্যামবুলেন্স ঢাকার রাস্তার ট্র্যাফিক জাম সরিয়ে এগুনোর চেষ্টা করতে লাগলো। গাড়ী, রিকশা, হোন্ডা, টেম্পো, সাইকেল, পথচারী সবাইকে হটিয়ে একটু একটু করে আমাদের অ্যাম্বুলেন্স আগাতে থাকলো। আমি অবাক চোখে চারিদিকে তাকিয়ে আবারো নিজের মনকে বোঝালাম, যে এটা কোনো আমেরিকার রাস্তা নয়। এখানে আম্বুলেন্সের জন্য রাস্তায় চলা যাবতীয় যানবাহন এক পাশে সড়ে দাঁড়ায় না অথবা জায়গা করে দেয়না। প্রতিদিন কে মরছে, কে বাঁচছে, কে মরণাপন্ন, কার চিকিৎসার প্রয়োজন, এই ব্যাপারে রাস্তাঘাটে কারো কোনো ভ্রূক্ষেপই নাই।
মনে পড়লো, আমেরিকায় যখন প্রথম গাড়ি চালানো শিখেছি তখন বেদবাক্যের মত যে নিয়মটি আত্মস্থ করেছি সেটা হলো, রাস্তায় সাইরেন বাজিয়ে যাওয়া কোনো ইমার্জেন্সি যানবাহন যেমন অ্যাম্বুলেন্স, অগ্নি নির্বাপণ কর্মীদের গাড়ী, পুলিশের গাড়ী, ইত্যাদিকে দেখলে সাথে সাথে গাড়ীর গতি কমিয়ে রাস্তার এক পাশে সড়ে গিয়ে জায়গা দিতে হবে। নতুবা ট্রাফিক ভায়োলেশন টিকেট সহ দুইশো ডলার জরিমানা দিতে হবে।
মনের ভিতর ঝড় বইতে লাগলো। মনে হলো, হঠাত করে সব কিছু ওলট পালট হয়ে গেছে। মনে হলো, কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছি, এটা সত্যি নয়। আসলে খোদা'তালা, আমাদেরকে এক বিশাল পরীক্ষার সামনে অবতীর্ণ করেছেন। পরীক্ষার ফলাফল এখনো জানি না। এই পরীক্ষায় মায়ের আপনজনদের ক্রিয়া, প্রতিক্রিয়া উপরে যিনি বসে আছেন তিনি দেখবেন এবং তার পরে কি অপেক্ষা করছে, তাও জানিনা।
বিশ কি বাইশ মিনিটের মাথায় আমাদের অ্যাম্বুলেন্স, ইউনাইটেডের ইমার্জেন্সি বা জরুরী বিভাগের গেইটের সামনে এসে দাঁড়ালো। মা'কে স্ট্রেচারে করে ভেতরে ঢুকানো হলো। আমাদের হাতে ধরিয়ে দেয়া হল বেশ কিছু ফর্ম। এগুলো পূরণ না করলে, মায়ের চিকিৎসা শুরু হবে না।শুরু হল, জরুরী বিভাগে মায়ের রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া।
শুরু হল, আমার একুশ দিনের গল্প......(চলবে)
পাঠকের জন্য এর পরের পর্বের লিংকঃ একুশ দিনের গল্প - ৪র্থ
Such a tragic incidence. It is really heart breaking to see our loved ones suffering like this.
ReplyDeleteThat was clearly a journey, which consisted of utter panic, fear, uncertainty, desperation and endless challenges.
ReplyDeleteWaiting for the next issue
While the joyous wedding was to celebrate with the whole family together, Allah also gathered the family to tackle this crisis together. Even in misfortune there can be hope.
ReplyDelete