আমি কি আপনার প্রিয় বন্ধু?
.....নাহলে দিন নেই, রাত নেই, কেন আপনি আমার কথা ভাবেন? আমার দিকে চেয়ে থাকেন? একটু পর পর নতুন কিছু দেখার আশায় জেগে উঠেন? নতুন কিছু দেখলে, নতুন কিছু জানলে মনটা পুলকিত হয়। ভাবতে থাকেন, আমি না থাকলে আপনার জীবনটা কেমন শূন্য লাগতো। কেমন রংহীন ধূসর হতো আপনার নিত্যদিন। এই যে এখন আমার সাথে সময় কাটাতে কাটাতে কোথা দিয়ে আপনার প্রহরগুলো কেটে যায়, টেরই পান না।
আপনার জীবনে আমি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি শক্তি, যা প্রতিনিয়ত আপনাকে প্রভাবিত করি, সজ্ঞানে বা অজান্তে। ভাবছেন তো, আমি কি?...
দুই বছর আগে ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে, আপনাদের বলেছিলাম আমার আত্মকথা। লেখাটির নাম ছিল, বলুন
তো আমি কি? (ক্লিক করুন, এই লেখাটি পড়তে চাইলে)
মনে পড়ছে কি? অগাস্ট মাসে ঘটা করে আমার জন্ম। জন্মের শুরু
থেকেই আমি নীল আর সাদা রঙে রঞ্জিত। এই তো আপনার মনে পড়েছে। হ্যাঁ ঠিক, আমি আর কেউ নই, আপনাদের অতি পরিচিত, প্রাণের বন্ধু ‘ফেইসবুক’।
দুই বছর পর আবার আজ বলতে এসেছি, আমার কিছু কথা। শুনবেন তো?
এতোদিনে আমার বহু পরিবর্তন সাধন হয়েছে। আমার প্যারেন্ট কোম্পানির নতুন নামকরণ হয়েছে, মেটা। যদিও আমি সারা দুনিয়ার কাছে সেই পুরানো নামেই বেশী পরিচিত, ফেইসবুক।
যতদিন যাচ্ছে, এই মানব সমাজ যেন আরো বেশী যান্ত্রিক, আরো বেশী অস্থির চিত্তের হয়ে পড়ছে। সময় নেই, সময় নেই, একদম সময় নেই। ফেইসবুক দেখেই যদি সবার খোঁজ খবর নিয়ে ফেলা যায় তাহলে আর কষ্ট করে ফোন করা, দেখা করা বা বাড়িতে যাওয়ার প্রয়োজন কি?...এমন চিন্তা ধারায় তারা বিশ্বাসী।
কিন্তু এটা ভাবলেতো চলবেনা। ফেইসবুক লাইফটা আংশিক ভাবে হলেও কখনই পুরাপুরি সত্যি বা বাস্তবসম্মত নয়। এটা অনেকটা 'সত্য' আর 'সাজানোর' এক আজিব মিশ্রণ বা ককটেল। আমি ফেইসবুক তাই এই ককটেলটির নাম দিলাম - সাজানো সত্য। যা খেলেও বিপদ, আপনার পেটে সহ্য নাও হতে পারে। আবার না খেলেও বিপদ। ওটার স্বাদ কেমন ছিল, না খেলে কোনোদিন জানবেন না।
মানুষগুলো হলো ককটেল বানানোর একজন মহান কারিগর। কে কতটুকু সত্য বা সাজানো মেশাবে, সেটা সম্পূর্ণ নির্ভর করে যার যার নিজের ইচ্ছা, বাসনা, চাহিদা ও স্বাধীনতার উপর। এই ককটেল খেয়ে কেউ কেউ প্রতিনিয়ত বেঁচে থাকার শক্তি পায়, আর কেউ কেউ সহ্য করতে না পেরে হয়ে যায় মানসিকভাবে শয্যাশায়ী।
আমার জন্ম হয়েছিল সারা বিশ্বের দূর দূরান্তে থাকা মানুষগুলোর
নেটওয়ার্কিং এর জন্যে। বিভিন্ন টাইম জোনে বিভক্ত হওয়া পৃথিবীতে বসবাসকারী
মানুষগুলোকে, একই প্ল্যাটফর্মে আনার জন্যে। যেন দূরে থেকেও তারা হতে পারে, কাছের
মানুষ। কিন্তু দেখুন কি হয়েছে-হয়েছে তার উল্টোটা। আমার বদৌলতে আজ তারা কাছে
থেকেও, দূরের মানুষ।
হাতে থাকা মুঠোফোনের মাধ্যমে ফেইসবুকে গিয়ে, ড্রইংরুমের সোফায়
পাশাপাশি বসে থেকে ভাই আর বোন, একে অন্যের ভিডিওতে লাইক দেয়, কমেন্ট করে। বেডরুমে
বিছানায় পাশাপাশি শোয়া স্বামী আর স্ত্রী, ফেইসবুকে তাদের একে অন্যের ছবিতে লাভ দেয়,
একে অন্যের পোস্টে প্রেম নিবেদন করে। দু'জন আলাপ আলোচনা করে ঠিক করে তারা কি লিখবে। দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু রেস্তোরায় মুখোমুখি বসে একে
অন্যের পোস্টে কমেন্ট দেয়, তাও খোলা মনে সামনা সামনি বলেনা কি বলতে চায়। আমি খালি দেখি আর
হাসি।
আরো দেখে হাসি পায় যে, তাড়াহুড়ো করে স্ক্রল করতে গিয়ে মানুষগুলো এতোই হারিয়ে যায়, যে অন্যের দেয়া পোস্টগুলো
ভালো করে না পড়েই কমেন্ট দেয়া শুরু করে। এই যেমন, কোনো হাসি হাসি মুখের দম্পতির ছবি দেখলে
ভালো করে না পড়েই, অ্যানিভার্সারির উইশ। অথবা কারোর অসুস্থতার খবর পুরোটা না পড়েই, তার জন্য
মৃত্যুপরবর্তী জান্নাত লাভের দোয়া। হয়তো ব্যাক্তিটি এখনো বেঁচে আছেন এবং সুস্থ হয়ে
পরের সপ্তাহে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাবেন। কেউ দুখী দুখী বিষণ্ণ মুখের ছবি দিলে, সাথে সাথে একগাদা প্রশ্ন, কি হয়েছে?
কেউ কেউ আবার কৌতুহলি হয়ে একটা ছবি বা কমেন্ট পোস্ট করে দেখেন, তার ফেইসবুক বন্ধুদের কাছ থেকে কি ধরনের সাড়া
মেলে। কয়টা লাইক, কয়টা লাভ আর কমেন্টস মেলে। কয়জন শেয়ার করে তার পোস্ট। আজব এই দুনিয়া আপনাদের। সবার মনোযোগ পাওয়ার এতো চেষ্টা। নিজের
ঢাকঢোল পেটানোর এতো চেষ্টা। নিজের মত করে সময় কাটান না ভাই। আপনার জীবনের সবকিছু
কি সবাইকে জানাতে হবে?
মাঝে মাঝে ভাবি, মানুষের নিজস্ব আত্মবিশ্বাস আর মনোবল কি এতোই দূর্বল হয়ে পড়েছে যে অন্যের দেয়া লাইক, লাভ, আর কমেন্টের সংখ্যা দেখে তা বাড়াতে হবে? তাও আবার মুখোমুখি বা সামনাসামনি নয়, একটা ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড এর ভেতর দিয়ে পাওয়া।
এবার আপনাদের সাথে একটা মজার তথ্য শেয়ার করি। সবাইতো আমাকে নিজের
প্রিয় বন্ধু মনে করেন, প্রিয় বন্ধুর মত মর্যাদা করেন। কিন্তু আপনি জানেন কি, আপনি
কোন ফেইসবুক ব্যবহারকারি দলের মধ্যে পড়েন?
আমেরিকার ইউটাহ স্টেটের এক ইউনিভার্সিটির রিসার্চ টিম গবেষণা করে আবিষ্কার করেছে যে সারা পৃথিবীতে মোট চার ধরনের ফেইসবুক ব্যবহারকারি আছে। তাদের কথা বলি।
প্রথম দল
হল, রিলেশনশিপ বিল্ডার অর্থাৎ এই দল ফেইসবুকিং এর মাধ্যমে সত্যি সত্যি পৃথিবীর
ভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা চেনা অচেনা মানুষের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে চায়।
ফেইসবুকের মাধ্যমে তাদের সামাজিকতার পরিধি বাড়াতে চায়। এরা নেটওয়ারকিং এ বিশ্বাসী। প্রয়োজন হলে এরা আপনাকে বন্ধুর লিস্টে রাখবে। আর আপনার কাছ থেকে কোনো সাড়া শব্দ না মিললে, আপনাকে বাদ দিয়ে দিবে।
দ্বিতীয় দল হল সেলফি আর্টিস্ট। তারা সর্বদাই নিজেদের ছবি, ভিডিও, ব্লগ, রিলস, লাইভ শো, পোস্ট করতে থাকে এবং সব বন্ধুদের লাইক, লাভ, কমেন্টের
অপেক্ষায় বসে থাকে। কয়জনের কাছ থেকে তা এলো এবং তার মোট সংখ্যা কত, এর উপরই নির্ভর
করে এইসব সেলফি লাভারদের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি ও নিজের সম্পর্কে আস্থা অর্জন। এরা সর্বদা অন্যের মনে বিরাজ করতে চায়, নিজের জায়গায় থাকতে তাদের ভালো লাগে না। এদের মধ্যে খুব অল্প সংখ্যকেরা সারা দুনিয়ায় রিয়েল ইনফ্লুএন্সার হতে পারে। বাকিরা ব্যস্ত নিজেদের ব্র্যান্ডিং আর অ্যাডভার্টাইসিং নিয়ে।
তৃতীয় দল হল এমন কিছু মানুষ যারা ফেইসবুক এর মাধ্যমে মানব সমাজে
নানাবিধ সংবাদ, গল্প, তথ্য, চিত্র ও বার্তা প্রদান করে থাকে এবং এর মাধ্যমে সামাজিক
উন্নয়নের চেষ্টা করে। এরা এদের নিজেদের প্রোফাইল বা ব্যক্তিগত নেটওয়ার্ক বাড়ানোর
চাইতে, সারা দুনিয়ায় কি হচ্ছে সেটা সবাইকে জানাতেই বিশেষ আগ্রহী। এরা মনে করে এদের গুরু দায়িত্ব হল সবাইকে অবগত করা বা সাবধান করা, এই দুনিয়ার হালচাল আর কর্মকান্ডের ফিরিস্তি দিয়ে।
সর্বশেষ দলটি হলো, নীরব দর্শক-শ্রোতা। এরা আপনার অদৃশ্য, কৌতূহলী বন্ধুর দল। এরা নীরবে সকলের সব পোস্ট দেখেন, পড়েন, পুরোমাত্রায় অবগাহন করেন কিন্তু ভুলেও কোনো রকম লাইক, কমেন্ট বা শেয়ার করেন না। অন্যের জীবনে কি হচ্ছে না হচ্ছে সে সম্পর্কে এরা ওয়াকিবহাল কিন্তু এদের অস্তিত্ব সম্পর্কে কেউ ওয়াকিবহাল নন। এরা ছায়ার মত আপনার সাথে আছে এবং আপনার অ্যাকটীভিটি লিস্টে সারা জীবন অদৃশ্য হয়ে থাকতে আগ্রহী, যদি না আপনি তাদের বাদ দিয়ে দেন।
ভাবছেন তো আপনি কোন দলে পড়লেন? আপনি যে দলেই পড়েন না কেন আমার সাথে আপনার ঘনিষ্ঠতা আজীবন বাড়তেই থাকবে এবং আমি হবো আপনার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু।
ফেইসবুক ভালোবাসেনা এই যুগে এমন কি কেউ আছে?
(নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ঠিকানা পত্রিকার ৩৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ফেব্রুয়ারী মাসের বিশেষ সংখ্যায় এই লেখাটি প্রকাশিত হয়।)
Bravo! Excellent elaboration. Also congratulations for your write up getting published on newspaper.
ReplyDeleteAmazing analysis of facebook... I never thought of this way about FB
ReplyDeleteGood write up! Like how you are trying to help people identifying to be aware of META
ReplyDeleteWhile people are busy creating their own image, FAKEbook the data-thief (তথ্য-তস্কর) is laughing all the way to the bank. That's capitalism in the information age, information is the most valuable commodity. Fantastic analysis of how people's insecurities have taken over their lives! Facebook does have a few bright spots though --- it can quickly find someone lost in the past, and it can fundraise for someone in dire need.
ReplyDeleteযুবসমাজে অনেকেই এই ফেইসবুক পছন্দ করেনা। আমার ছেলেমেয়ের প্রভাবে এ থেকে দূরে সরে এসেছি। তবে মাঝে মধ্যে প্রবেশ করি এবং পোস্ট দেই সেই যে আত্মীয়স্বজনের খোঁজ খবরের জন্য যে কারণে ফেইসবুকের সৃষ্টি হয়েছিল। ভালমন্দ দুদিকটাই সুন্দর ভাবে তুলে ধরা হয়েছে এবং নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে এটাই প্রস্ফুটিত হয়েছে এই লেখায়।
ReplyDelete