বলুন তো আমি কি?

অনেকের মতে আমি লাইফ সেভার। আমাকে ব্যবহার না করলে কারো চোখে ঘুমই আসেনা। কারো কারো রাত জাগা সঙ্গী আমি। আমিই সবাইকে পরিচয় করিয়ে দেই, কাছে টেনে আনি। হারানো সাথীকে খুঁজে নিয়ে আসি। সবার গোপন তথ্য জানি আমি। সবার লুকানো ইতিহাস আমার নখদর্পণে। আমি যেমন পারি সম্পর্ক গড়তে, তেমনি পারি অনেক দিনের সম্পর্ক ভাঙ্গতেও। 

আমার এতো ক্ষমতা, এতো শক্তি। কোনোটা ভালো, কোনোটা মন্দ। আমাকে কাজে লাগিয়ে মৃত্যু পথযাত্রী রোগীর চিকিৎসার অর্থ তোলা হয়, প্রতিযোগীতার ফলাফল নির্ধারিত হয়। কখনো, কখনো আমাকে দিয়ে জানানো হয়, আগামীতে কত গুলো মানুষের মৃত্যু হবে।  দুনিয়ার এতো এতো মানুষের পছন্দ, অপছন্দ, ভালো কর্ম, অপকর্ম, অভিযোগ, অনুযোগ, সফলতা, ব্যর্থতা সবই আমি ধারণ করি অকপটে, নীরবে।

বলুন তো আমি কি?

২০০৪ সালের অগাস্ট মাসে আমার জন্ম। জন্মের শুরু থেকেই নীল আর সাদা রঙ্গে রঙ্গিন আমি। আমি আর কেউ  নই, আপনাদের খুব কাছের বন্ধু, ফেইসবুক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দুনিয়াতে, আমি দাপটের সাথে চালিয়ে যাচ্ছি আমার বিরামহীন জীবন। আজকে আমি আপনাদের সাথে শেয়ার করতে চাই আমার আত্মকথা। ফেইসবুকের আত্মকথা!

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল মেধাবী ছাত্রের দল আমাকে প্রথম তৈরীর কথা ভেবেছিলো। আবার সেটা নিয়েও এক বিরাট কাণ্ড হয়েছিল। ঐ দলেরই একজন ছাত্র আমাকে সৃষ্টির পুরো কৃতিত্বটা কৌশলে নিজে হাতিয়ে নেবার পরিকল্পনা করেছিলো। অনেক মামলা, মোকদ্দমা, কোর্ট, কাচারি করে পুরো ব্যাপারটা শেষমেষ আপোষ হয়। আমার উদ্ভাবন তালিকায় পাঁচ জনের নামই অন্তর্ভুক্ত হয়। আমি পেয়ে যাই ঐ ছেলেটির দেয়া নাম, ফেইসবুক। তার পরের ইতিহাসটা তো আপনাদের সকলের জানা। রাতারাতি পুরো দুনিয়াতে সাড়া জাগিয়ে দেই আমি।     

সামাজিক মহলে যোগাযোগের পাশাপাশি আরও একটি কাজ করি আমি, প্রচারণা। বিয়ে শাদী, সন্তান জন্ম, গৃহ প্রবেশ, পরলোক গমন, বিদেশ ভ্রমণ, গ্র্যাজুএশন, পিকনিক, পার্টি, জন্মদিন, নববর্ষ  কি নেই আমার কাছে? সব কিছুর ছবি আর বৃত্তান্ত আমার গায়েই লেখা হয়। গল্প, কবিতা, গান, নাটক, নাচ কিংবা ছবি আঁকা, সব কিছুরই অ্যাডভারটাইজিং করি আমি। তাও আবার বিনা মূল্যে। ঘরে ঘরে মহিলাদের রান্না শেখাই। মেয়েদের শেখাই রূপচর্চা। যুবক, যুবতীরা আমায় দেখে শেখে ব্যায়াম। অনেক ভালো সমাজ গঠন মূলক কাজের সূচনা করি আমি। পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন, ব্যক্তিগত জীবন, কর্মময় জীবন, নিঃসঙ্গ জীবন, বিবাহিত জীবন, ছাত্র জীবন এমন সব ধরণের জীবনে আমার সর্বত্র আনাগোনা। হোক তা প্রকাশ্যে, কিংবা অগোচরে।    

আমার খুব ভালো লাগে যখন দেখি আমার দেয়া ছবি দেখে বা লেখা পড়ে মানুষ অনুপ্রাণিত হয়। নিজে ভালো কাজ করে, আবার অন্যকেও উৎসাহিত করে। উন্নয়ন মূলক কর্ম কাণ্ডের আহবান দেয়। হাজার হাজার মানুষ তাতে সাড়া দেয়। কোনো ভালো কিছুর বার্তা আমি বয়ে নিয়ে বেড়াই। যা দেখে হতাশ মানবকূল আশাবাদী হয়। আরো ভালো লাগে দেখতে, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মানুষগুলো একত্রিত হয় যোগাযোগ এর মাধ্যমে। পরিবার, আত্মীয়, বন্ধু, পরিচিত স্বজনেরা। তাদের ভালো, মন্দ, সুখ, দুঃখ শেয়ার করে। খুব, খুব খারাপ লাগে যখন দেখি আমাকে ব্যবহার করে কোনো কু বুদ্ধি, ধ্বংসাত্মক চিন্তা শাখা প্রশাখা বিস্তার করে। আর তাতে বহু মানুষ সামিল হয়। মনুষ্য সমাজের ক্ষতি সাধন করে। চেনা মানুষের অপকার করে। অথবা প্রতিশোধ নেয়।

মানবজাতির ব্যস্তময় জীবনে আমার প্রয়োজনীয়তা অপিরিসীম। আমায় পড়ে কেউ হাসে, কেউ কাঁদে। কেউ বা আবার হিংসার আগুনে জ্বলে। কেউ কেউ হয় রাগ। কি করি বলুন তো? কেউ কেউ আমায় ডাকে শাঁখের করাত। আমায় ছেড়েও থাকতে পারেনা, আবার আমায় দেখেও মানতে পারেনা। এই সব ভারসাম্য হীন মানুষদের দুনিয়াতে কেনই বা আমায় তৈরি করলো, তা বুঝিনা। তবে একটা কথা ঠিক। আমার কিন্তু এতো সহজে মৃত্যু নাই। আমি তো ফেইসবুক।

পৃথিবীর সব সামাজিক মাধ্যম গুলোর মধ্যে আমিই সর্ব বৃহৎ। প্রায় তিন বিলিয়ন পৃথিবী বাসীর বন্ধু আমি। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা নির্বিশেষে সবাই আমাকে আপন করে নিয়েছে। এটা কি সোজা কথা? আর ভাবুন তো। আমাকে সামাজিক মাধ্যম ডাকতে গিয়ে, এই মানুষ গুলো তাদের নিজস্ব সামাজিকতাই ভুলতে বসেছে। আনন্দ, বেদনা, হাসি, কান্না, রাগ, অভিমান সব কিছুরই বার্তা আমি আনা নেয়া করি, এপার থেকে ওপারে। কাজেই এই মানুষগুলোর নিজেদের মুখোমুখি হয়ে আর কিছুই করতে হয়না। ক্লিক, ক্লিক, ক্লিক.....নিজের ছোট্ট গণ্ডির ভেতর থেকে সবাইকে জানিয়ে দেয় নিজের কথা। আবার জানতে পারে সবার কথা। হোক সে সত্যি, কিংবা মিথ্যা। বাস্তব কিংবা বানানো।

আজকে আমার এই আত্মকথার মধ্য দিয়ে আমি মানুষের মাঝে একটি বার্তা পৌঁছে দিতে চাই। দয়া করে আপনারা ফেইসবুকে যখন যাই দেখবেন তা অকপটে বিশ্বাস করবেন না। আপনি নিজে যাচাই, বাছাই করুন।  আমাকে দিয়ে যা বলানো হয়, করানো হয়, দেখানো হয় তার সবটুকুই অনেক সময় সত্যি নয়। মানুষ শুধু ভালোটার কথাই জানাতে চায়, খারাপটা নয়। মানুষ শুধু সুন্দর গল্প গুলোই বলতে চায়, খারাপ গুলো নয়। এ যুগের মানুষেরা এতো বেশী যান্ত্রিকতায় ডুবে যাচ্ছে, যে তারা সামাজিকতা কি তা ভুলতে বসেছে। বিজ্ঞাপন, প্রচারণা, লোক দেখানো, বিভ্রান্তি, বোকা বানানো সবই তাদের নিত্য দিনের সঙ্গী, যা ফেইসবুক তাদের হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে। যা দিয়ে তারা ঢেকে রাখতে চায় তাদের প্রকৃত অবস্থানটি। এরই নাম হলো ফেসবুক আইডেনটিটি যা কোনো ভাবেই তাদের নিজস্ব পরিচয় নয়। এটি ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ড এ  ছদ্মবেশ ধারণ এর একটি নাম মাত্র। এখানে মিলে মিশে বাস করে ভালো আর খারাপ, আসল আর নকল।

বলতে চাই, আর কোনো তরুণ বা তরুণী যেন ফেইসবুকে দেয়া তথ্য বিশ্বাস করে বিপদে না পড়ে। অন্যের দেয়া প্রলোভনে, উস্কানিতে পড়ে নিজের জীবন বিসর্জন না দেয়। আর কোনো সরল মনের মানুষ যেন তার সর্বস্ব না হারায়। আমি ফেইসবুক শুধু আপনাদের উপকার এই আসতে চাই। তবে সেটা নির্ভর করবে আপনি আমাকে কি ভাবে ব্যবহার করছেন তার উপর। 

আপনাকে বুঝতে হবে, কে আপনার প্রকৃত বন্ধু। কে সুসময়ের আর কে দুঃসময়ের।

Comments

  1. Informative and thought-provoking. You presented the pros and cons of the technology; it's up to the users to decide which way they want to steer towards. God has given us options and also wisdom and knowledge to choose from them. Your article reflects this.

    ReplyDelete
  2. Facebook's inception and the history attached to it, found it so intriguing and thank you for enlightening us with your well researched write up.
    Every new invention covering the virtual world has it's positive and negative side and Facebook is no exception to it.
    No matter how annoying or irritating some posts can be now and then, it can equally be heartwarming, amusing or entertaining.
    Also taught us to be more tolerant..����

    ReplyDelete
  3. An extremely interesting read on the history of Facebook!
    Every aspect of social or digital media has its pros and cons which have been very well articulated, but this social media platform has definitely brought about a change in our lives as a whole.
    Very well researched piece, keep up the fantastic work!

    ReplyDelete

Post a Comment