সাউথ-ওয়েস্ট রোডট্রিপ (১ম)

জুন মাসের গরমের এক উত্তপ্ত রাঙ্গা সকালে দৈনন্দিন কাপড়, জামা, জুতো, জিনিসপত্র গুছিয়ে, আমাদের এস ইউ ভি গাড়ীর পিছে লোড করে আমরা যাত্রা করলাম এক উত্তেজনাময় রোড ট্রিপে। ডেস্টিনেশন - সাউথ ওয়েস্ট আমেরিকা। এতো বড় আমেরিকা মহাদেশের পঞ্চাশটি স্টেটে কেউ যদি ঘুরতে বের হয় তাহলে অচিরেই টের পাবে, এখানে এক একটি স্টেটের একেক রকমের সৌন্দর্য। এক এক রকমের নতুনত্ব, মৌলিকত্ব। কোনটার সাথে কোনটার মিল নেই।

আমাদের যাত্রার শুরু টেক্সাস অঙ্গরাজ্য থেকে। টেক্সাসের রাজধানী অস্টিন থেকে টেক্সাসের বর্ডার পর্যন্ত পৌঁছাতে প্রায় আট ঘন্টা সময় লাগে। কারন এই রাজধানী শহরটি বিশাল বড় টেক্সাস ভূখণ্ডের একেবারে মাঝামাঝি কেন্দ্রে অবস্থিত। অস্টিন থেকে রউনা হয়ে আমরা ছোট ছোট দুটি শহর পার হলাম। লেনো ও ব্রেডি। রাস্তার দুই ধারে চোখে পড়লো বিশাল বিস্তীর্ণ  জমিন যার পুরোটাই পাথুরে মাটি, বালি দিয়ে ভরা। জমিন গুলো দেখতে ঠিক সবুজ ফসলী ক্ষেত নয়, আবার ধূ ধূ মরুভূমিও নয়। রাস্তার দুই ধার দিয়ে  একটু পর পর ঝোপাকৃতি বেঁটে, জংলা জাতীয় গাছ। 

মাঝে মাঝে চোখে পড়ছিল ভুট্টার ক্ষেত। আবার চোখে পড়ছিল বিরাট বিস্তৃত মাঠের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে সারি সারি উইন্ড টারবাইন্স। এই উইন্ড টারবাইন্স গুলো বাতাসের চাপে ক্রমাগত ঘুরতে থাকে আর বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদন করতে থাকে। এখানে বড় বড় অঞ্চল জুড়ে গড়ে উঠেছে বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদনের কারখানা। পুরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে টেক্সাস একমাত্র স্টেট যারা নিজেদের বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং তারা নিজেদের চাহিদা নিজারাই মেটাতে পারে। কোন ফেডারেল সহায়তার উপর নির্ভরশীল নয়।    

ঠিক টেক্সাস বর্ডার পার হয়েই আমরা নিউ মেক্সিকো স্টেটের ভেতর প্রবেশ করলাম এবং এর বর্ডার এর কাছেই অবস্থিত ছোটো শহর রসওয়েলে রাত কাটাতে থামলাম। রসওয়েলকে ডাকা হয় ইউএফও (অজ্ঞাত উড়ন্ত বস্তু) শহর। কেন তার ইতিহাস একটু বলি। ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসের ঘটনা। এই শহরের কিছু মানুষ দাবি করে তারা আকাশে একটি পিরিচের আকৃতির অতিকায় বস্তুকে উড়ে বেড়াতে দেখেছে। সঙ্গে সঙ্গে রটে যায় ভিনগ্রহ থেকে আসা আকাশযানের কথা। কিছু দিন পর শহর থেকে দূরে একটি ফার্মে সেই মহাকাশযানটিকে পড়ে থাকতে দেখে মার্কিন সেনাবাহিনীর লোকেরা এবং এর ভগ্নাবশেষ উদ্ধার করে। 

ব্যস, এর পর থেকেই আরো গুজব চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং ক্রমান্বয়ে রসওয়েল শহরটিকে বিখ্যাত করে তোলে। মজার ব্যাপার,  ছোট্ট এই শহরটিতে কোন আলাদা জৌলুস বা চাকচিক্য নেই। ডাউন টাউনের প্রধান সড়ক এর দুই পাশ দিয়ে শুধু বিভিন্ন ধরনের এলিয়েন এবং ফ্লাইং সসার বা ডিস্ক আকৃতির বস্তুর ছবি, পোস্টার, মূর্তি ও সু'ভেনির কেনার দোকান। আমাদের মনে হয়েছিল, এই শহরের জন্ম হয়েছে শুধুমাত্র আমাদের পৃথিবীতে  মহাজাগতিক প্রাণীদের আবির্ভাব জানান দেয়ার জন্য।

পরদিন রসওয়েল থেকে রউনা হয়ে ভন ও এনচিনো নামক আরো দুটি শহর পার হয়ে আমরা অ্যারিজোনা স্টেটের সীমানায় পৌঁছালাম এবং এর উত্তরে অবস্থিত উইলিয়ামস শহরের দিকে যাত্রা শুরু করলাম। অ্যারিজোনার মরুভুমির দৃশ্য টেক্সাস বা নিউ মেক্সিকোর চাইতে অনেক আলাদা। অ্যারিজোনার জলবায়ু খুবই বৈচিত্র্যময়। এদের গ্রীষ্ম কাল খুব উষ্ণ আর শুষ্ক আর শীতকাল হালকা। তাই এটিকে মরুভূমি সাদৃশ্য অঞ্চল হিসেবে গন্য করা হয়। উত্তর আমেরিকার সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ মরুভূমিটির নাম সানোরান মরুভূমি, যা যুক্তরাষ্ট্র থেকে মেক্সিকো পর্যন্ত বিস্তৃত। 

এই মরুভুমি একমাত্র জায়গা যেখানে পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত এবং এক বিরল প্রজাতির সাগুয়ারো ক্যাকটাস জন্মায়। সাগুয়ারো ক্যাকটাস দৈর্ঘ্যে অনেক উঁচু, মানুষের চাইতেও বেশী। এবং এদের থাকে লম্বা শাখাপ্রশাখা যা দূর থেকে দেখলে মানুষের হাতের মত দেখায়। একটি কথার প্রচলন আছে, দূর থেকে দেখলে সাগুয়ারা ক্যাকটাসকে একজন কাউ বয় বা রাখাল বালকের মত লাগে। এরা গতানুগতিক অন্যান্য ক্যাকটাসের মত নয় কারন এরা ১০০-২০০ বছর বাঁচে। সানোরান মরুভূমির ভেতর দিয়ে যেতে যেতে আমি অবাক বিস্ময়ে প্রকৃতির এই অসাধারণ সৃষ্টি দেখলাম, বয়সের হিসেবে যারা আমার চাইতে অনেক অনেক বড়। যুগের পর যুগ ঘটে যাওয়া পৃথিবীর জলবায়ু ও পরিবেশ পরিবর্তনের এরা এক নীরব সাক্ষী।    

আমাদের যাত্রা পথে আরো একটি ব্যাপার লক্ষ্য করলাম। রাস্তার দুই ধারে বিশাল বড় বড় পাহাড় আর পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে পুএবলো বা আদিবাসি আমেরিকান ইন্ডিয়ানদের বসতি স্থল। কাঠ, পাথর আর মাটি দিয়ে তৈরি ছোট কুঁড়েঘর গুলি তাদের দৈনন্দিন জীবন যাত্রার এক অনন্য উদাহরন। ওদেরই দেশ আমেরিকায় এসে শ্বেতাঙ্গ সেটলাররা দখল করে নিয়েছিল। আর ওদের সকল কিছু গ্রাস করে নিয়ে নিজেরা পুঁজিবাদী ব্যবসায় ধনী হয়েছিল এবং ওদেরকে সকল সুযোগ, সুবিধা থেকে বঞ্চিত করেছিলো। আমেরিকা দেশটির ইতিহাস অন্তত তাই বলে। 

যে দুটি আমেরিকান আদিবাসীর প্রাধান্য এই অঞ্চলে বেশী, তাদের নাম নাভাহো আর যুনি। এরা এদের হাতের তৈরি থালাবাসন, পুতুল, পাথরের গহনা, শাল-কম্বল, শিকারের সরঞ্জাম, এমন বহুবিধ হস্ত সামগ্রীর পশরা সাজিয়ে ছোট ছোট দোকান গড়ে তুলেছে রাস্তার দুইধার দিয়ে। আমরা কয়েকটিতে থামলাম আর কিছু মন মত সু'ভেনির কিনলাম। আমরা সহ সকল টুরিস্টদের সাথে ওরা এতো সুন্দর ব্যবহার করছিল আর বার বার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছিল ওদের নিজস্ব তৈরি জিনিস কেনার জন্য।    

আমরা উইলিয়ামস শহরে রাত কাটিয়ে পরের দুই দিন দেখতে বের হলাম, উত্তর অ্যারিজোনায় অবস্থিত গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন যা খোদাতালার এক অপূর্ব সৃষ্টি। ভোউগলিক বিবেচনায় গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন, একটি গভীর ও খাড়া পার্শযুক্ত গিরিখাত যার ভেতর দিয়ে কলোরাডো নদী বয়ে গেছে। প্রায় ৭০ মিলিয়ন বছর আগে কলোরাডো নদীর বরফ গলা পানি দ্বারা এই অঞ্চলে শুরু হয় ভূমিক্ষয়। সেই ক্ষয় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বহু দিন ধরে এই গভীর উপত্যকাটির জন্ম যাকে বলা হয় পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের একটি। বিশাল বড় একটি গর্ত যার গভীরতা ৬০০০ ফিট।  মুগ্ধ বিস্ময়ে আমরা এই সৃষ্টির মহিমা উপভোগ করেছি। একটু একটু পর পর আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছিল আর চোখে পানি চলে আসছিল এই ভেবে যে, উপরে একজন মহান বসে আছেন, এই বিশ্ব চরাচর যার নির্দেশে তৈরি হয়েছে।  এতো গ্র্যান্ড, এতো বিশাল একটি গর্ততো কোন মানুষ দ্বারা তৈরি সম্ভব নয়। মনের অজান্তেই সৃষ্টিকর্তার উপর বিশ্বাস আরো সুদৃঢ় হল।  

চলবে......

২য় পর্ব ~ সাউথ-ওয়েস্ট রোডট্রিপ (২য়)

Comments

  1. অনেক নূতন তথ্য জানতে পারলাম। ভাল লেগেছে।অপেক্ষায় থাকলাম তোমার নূতন লিখার জন্য।

    ReplyDelete
  2. Totally engrossed by your lucid writeup. The narrations are so vivid that it seems that I am traveling with you. Can't wait for the next episode of the travel saga.

    ReplyDelete
  3. Big hole in the ground, really BIG!!! Wonders of nature are humbling for all of us. Also, the angle you presented about the Native Americans touched my heart. They are forgotten and neglected on their own land. Travel makes us aware of history along with the joy of seeing new places. Thank you for documenting this experience.

    ReplyDelete
  4. ঘরে বসেই তোমার ভ্রমণকাহিনীর বদৌলতে আমার ভ্রমণ হয়ে গেল - very lively and enchanting description.

    ReplyDelete
  5. Travelling while being able to enjoy and experience the beauty along with the history of the world so enriching for us.
    Eagerly waiting for the next part of your journey

    ReplyDelete

Post a Comment