সাউথ-ওয়েস্ট রোডট্রিপ (২য়)

অপূর্ব মহিমান্বিত গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের শোভা দর্শন শেষে, অ্যারিজোনা ছেড়ে আমরা উত্তর পশ্চিমে ক্যালিফোর্নিয়ার দিকে যাত্রা শুরু করলাম। যুক্তরাষ্ট্রের একেবারে পশ্চিমে, প্রশান্ত মহাসাগরের ধার ঘেঁষে অবস্থিত বিশাল বড় #ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যকে ডাকা হয় 'গোল্ডেন স্টেট'। কেনো গোল্ডেন স্টেট, তার পিছে এক নয়, একাধিক কারন জড়িত। 

১৮৪৮ সালে এই স্টেটটিতে প্রথম সোনার খনি আবিষ্কার হয় এবং তার পরপরই বহু মানুষ তাদের ভাগ্যের অন্বেষণে এবং কর্মখোঁজে বিভিন্ন স্টেট থেকে এখানে আসতে শুরু করে। ইতিহাসের পাতায় এই ব্যাপারটিকে ডাকা হয় 'গোল্ড রাশ'। ক্যালিফোর্নিয়া স্টেটে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য বীচ। বীচে দাঁড়িয়ে প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে সূর্যাস্ত দেখতে ছুটে আসে, দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা পর্যটক। দিন শেষে সোনাঝরা আলো দিয়ে সাগরের পানিতে আস্তে আস্তে ঢলে পড়ে সূর্যি মামা। আরো একটি কারনে এটি পেয়েছে স্বর্ণ স্টেটের খেতাব। মাইলের পর মাইল জুড়ে এখানে দেখতে পাওয়া যায় সোনালী হলুদ রং এর পপি ফুলের ক্ষেত। দূর থেকে দেখলে মনে হয় পুরো ক্ষেতে আগুন লেগেছে যার রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়ছে দিগন্ত জুড়ে।

অ্যারিজোনা থেকে আমরা মোহাভি মরুভুমির ভেতর দিয়ে উত্তর পশ্চিম ক্যালিফোর্নিয়ার দিকে যাত্রা শুরু করলাম। মোহাভি মরুভূমি এলাকাটি আমেরিকার মোহাভি আদিবাসীদের জায়গা। এজায়গাটির বৈশিষ্ট্য, রেইন-শ্যাডো এফেক্ট থেকে এই মরুভূমির জন্ম। একপাশে বিশাল সিয়েরা নেভাডা পর্বতমালা তার বিশাল উচ্চতা দিয়ে আকাশের এক প্রান্তকে ঢেকে রাখে। যার ফলে বৃষ্টিপাত বা আদ্র আবহাওয়া কোনটাই পাহাড় ডিঙিয়ে এই পারে আসতে পারেনা। তাই দিনের পর দিন বৃষ্টিহীন এই শুষ্ক অঞ্চলটি একটি মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। আমাদের গাড়িটি দুই পাহাড়ের মধ্য দিয়ে সরু রাস্তা দিয়ে চলছিল। লক্ষ্য করছিলাম, পাহাড় গুলো বড় বড় পাথরের চাই দিয়ে তৈরি। আরো একটি অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করলাম, চারিদিকে যতদূর চোখ যায় কোন সবুজ নয়, কিন্তু খয়েরী রঙের গাছ গাছালি আর ঝোপঝাড়। আর একটু পর পর বালুর পাহাড়। 

এবার এলো আরো একটি অবাক হওয়ার পালা। ঠিক ক্যালিফোর্নিয়ার বর্ডারে আমরা দেখলাম কাস্টমস চেক অ্যান্ড বর্ডার পেট্রোল। ঢোকার মুখে তারা আমাদের প্রশ্ন করলো, আমাদের সাথে কোনো ফলমূল বা শস্য জাতীয় খাদ্যদ্রব্য আছে কিনা। বুঝলাম, তারা বিশেষ ভাবে সতর্ক যাতে অন্য স্টেট থেকে আসা ফল ফলাদি বা শস্যের মাধ্যমে কোন জীবাণু বা গাছের রোগব্যাধি ক্যালিফোর্নিয়ায় প্রবেশ না করে। শুনেছি, ক্যালিফোর্নিয়া ডিপার্ট্মেন্ট অফ ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার তাদের স্টেট বর্ডারে প্রায় ১৬টি জায়গায় এই চেকপোস্ট বসিয়েছে। 

ক্যালিফোর্নিয়ায় প্রবেশ করে আমরা ফ্রেসনো নামক একটি জায়গায় গিয়ে পৌঁছুলাম। ওখানে রাতে থেকে পরদিন আমাদের ইয়োসেমিটি ন্যাশনাল পার্ক পরিদর্শন করতে যাওয়ার কথা। প্রায় ১১৭০ বর্গ মাইল এলাকা জুড়ে অবস্থিত এই পার্কটির অপরিসীম সৌন্দর্যের কথা বহু মানুষের কাছে শুনেছি। পার্কটি দেখার ইচ্ছেও ছিলো বহু দিনের। অনেক উৎসাহ আর কৌতূহল নিয়ে আমরা পরের দিন সকাল বেলায় নাস্তা সেরে পার্কের উদ্দেশ্যে রউনা হলাম। 

ফ্রেসনো ছেড়ে পনের বিশ মিনিট যাওয়ার পরেই রাস্তায় আমাদের এসইউভি গাড়ীতে 'ইঞ্জিন ফেল' মেসেজ আসতে শুরু করলো এবং গাড়ীর গতি ধীর ধীরে কমতে শুরু করলো। আমরা খুবই ভয় পেয়ে গেলাম এবং আরো বেশী দূর যাওয়ার আগেই সিদ্ধান্ত নিলাম যে গাড়িটি কাছাকাছি একটি ডিলার শপে নেওয়া প্রয়োজন। ওরা আমাদের গাড়িটা সারানোর উদ্দেশ্যে রেখে দিয়ে আমাদেরকে একটা রেন্ট-আ-কার দিলো। তাই নিয়েই আমরা আবার নতুন উদ্যমে যাত্রা শুরু করলাম।

দুই দিকে পাহাড় আর পাইন গাছের সারি দিয়ে মোড়ানো,পাহাড়ের ধার ঘেঁষে আঁকাবাঁকা রাস্তা। তার ভেতর দিয়েই আমাদের গাড়ী ধীরে ধীরে উপরে উঠতে লাগলো। প্রথম দিন আমরা গেলাম 'এল ক্যাপিটান' নামে একটি গ্র্যানাইট ক্লিফের চূড়ায় যেখান থেকে নিচে তাকিয়ে এই বনভূমির অপারগ বৈচিত্র্য উপভোগ করা যায়। এই ভ্যালির ভেতর দিয়ে বয়ে চলেছে মারসেড নদী। এটি এমনই একটি উদ্যান যার ভেতর রয়েছে একাধারে গ্র্যানাইট ক্লিফ, স্বচ্ছ জলপ্রপাত, পর্বত, হ্রদ, তৃণভূমি, হিমবাহ (গ্লেসিয়ার) এবং বিশালকার সেকোয়া উপবন। প্রকৃতির এতো ভিন্ন ভিন্ন রূপ একসাথে ধারণ করে আছে এই মায়াবী জায়গাটি, যা চোখে না দেখলে বিশ্বাস হবার নয়। ইউনেসকো এই পার্কটিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং তাদের World Heritage Site হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছে।

দ্বিতীয় দিন আমরা এই অসম্ভব সুন্দর উপত্যকাটির একেবারে মাঝখানে ড্রাইভ করে গেলাম। মনের ভেতর একটা অদ্ভুত অনুভূতি, একটা আলোড়ন হচ্ছিল। মনে হচ্ছিলো, বেহেশত বুঝি এমনই দেখতে হয়। স্বচ্ছ ঝিলের জলে পা ডুবিয়ে বসে পাহাড়ের চূড়ায় জমে থাকা বরফের গায়ে সূর্যের আলোকছটা পড়তে দেখা; নিঃশব্দ, নিশ্চুপ অরন্যের মাঝখানে দাঁড়িয়ে জলপ্রপাতের কলকল শব্দ শোনা; বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘতম, প্রাচীনতম দৈত্যাকার সেকোয়া বৃক্ষের নীচে দাঁড়িয়ে নিজেকে অতিকায় তুচ্ছ-নগণ্য মনে করা, এর সব কিছু এই একটি জায়গাতেই করা সম্ভব। মনে মনে ভাবলাম, ভাগ্যে থাকলে আবার আসবো তোমায় দেখতে ইয়োসেমিটি।   

ক্যালিফোর্নিয়ার বিখ্যাত গোল্ডেন গেইট ব্রিজের কথা কে না জানে। ১৯৩০ সালে নির্মিত প্রায় ১.৭ মাইল লম্বা কমলাভ-লাল রঙের এই ব্রিজটি, প্রশান্ত মহাসাগর  এবং স্যানফ্র্যান্সিস্কো বে এর মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করে দাঁড়িয়ে আছে। এই ব্রিজের খুব লম্বা টাওয়ার গুলিতে যখন সূর্যের আলো পড়ে তখন তা সোনার মতই চকচক করে। 'সোনালি দুয়ার' হিসেবে খ্যাত এই ব্রিজটি দেখতে প্রতিদিন হাজার হাজার ভ্রমণ পিপাসু মানুষ ভিড় করে। দীর্ঘ চার বছর ধরে নির্মিত এই ব্রিজটি এক সময় দুনিয়ার সপ্তম আশ্চর্যের একটি ছিল। আমাদের ভ্রমণ কাহিনীর এটি ছিল সর্বশেষ আকর্ষনীয় স্থান। 

সেদিন প্রচণ্ড জোরে বাতাস বইছিল। মনে হচ্ছিল আমাদের একেবারে উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে সমুদ্রের মাঝখানে ফেলবে। মেঘলা আকাশ, স্যাঁতস্যাঁতে ঠাণ্ডা আর দূর্দান্ত বাতাস উপেক্ষা করে ব্রিজের একধারে পেডেস্ট্রিয়ান ওয়াক এর উপর দিয়ে আমরা চারজন হাত ধরাধরি করে হেঁটেছি। পায়ের নীচে উত্তাল সমুদ্র, চোখের সামনে এক অপূর্ব বিশালতা, জীবনের কিছু সুন্দর মুহূর্ত গুলোকে আরো নিবিড় করে তুলল। মনে পড়ে গেলো ১৮ বছর আগেকার কথা। প্রথম যেবার ব্রিজটি দেখেছিলাম। বিয়ের পর আমাদের হানিমুনে, শুধু আমরা দু'জনে। এবার সাথে আছে আরো দু'জন। আমাদের দুই ছেলে। একটি পরিবার। ব্রিজটি যেন মানুষের ভালোবাসা আর ভালো লাগার এক নীরব সাক্ষী। 

Comments

  1. A captivating experience indeed.

    ReplyDelete
  2. Another picturesque and engaging travel journal.

    ReplyDelete
  3. Impressive! Really a great tour experience. In this write up also I got to know many new things. For the first time I heard California state to be known as ''Golden State'' and people used to settle over there for job purpose and making luck. Then also I got to learn about Yosemite Park, but I found it very interesting that this park got internationally recognized. However, the information about Poppy Flower Field impressed me the most. Truly a phenomenal write up. Keep it up!

    ReplyDelete

Post a Comment