অতিথি
কোথাও যেন খুট করে একটা শব্দ হলো। মনে হলো কে যেন দরজা খোলার চেষ্টা করছে। আওয়াজটা ঠিক কোন দিক থেকে আসছে এলিনা বুঝতে পারলো না। সে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেখলো, ওখানে কেউ নেই।
এই বাড়িতে আসার পর থেকেই সে বিভিন্ন রকমের আওয়াজ শোনে। বিকাল বেলায় বারান্দায় বসে চা খাচ্ছে, হঠাত এলিনার মনে হলো কলকল করে কোথাও পানি পড়ছে আর দূর থেকে সেই আওয়াজটা ভেসে আসছে। অথচ রান্নাবান্না, ঘরদোর পরিষ্কার, কাপড় ধোয়া থেকে শুরু করে বাড়ির সব কাজ এলিনা তিনটার মধ্যেই শেষ করে ফেলেছে। বাড়িতে আর কেউ নেই যে খাবার ঘরে বা বাথরুমে কল খুলবে।
তার এই শব্দ ভ্রমের কথা সে অনেক দিন থেকেই হাসানকে বলছে। কিন্তু হাসান সে কথা কানেই তুলছেনা। হাসান এলিনাকে বলেছে, এটা এক ধরনের কল্পনা। অনেক পরিশ্রমের পরে এলিনা যখন এক জায়গায় স্থির হয়ে বসে, বিশ্রাম নেয়, তখন তার ক্লান্ত মস্তিষ্ক বিভিন্ন ধরনের বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। শরীর দূর্বল থাকলে মনও দূর্বল হয়ে পড়ে। তখন ছোটখাটো কোনো আওয়াজও বড় আকারে মাথার ভেতর আঘাত করে।
এলিনা ও হাসান খুব বেশি দিন হয়নি এই এলাকায় এসেছে। রিয়েল এস্টেট এজেন্ট যখন প্রথম তাদেরকে এই বাড়িটা দেখিয়েছিলো তখন তাদের বাড়িটা বেশ পছন্দ হয়েছিল, কিন্তু একটু খটকাও লেগেছিল। এতো বড় বাড়ি অথচ এক রকম পানির দামে মার্কেটে দিয়েছিল। শুধুমাত্র তাদের দুজনার জন্য এই বাড়িটা অনেক বড়। তবুও তাদের ভবিষ্যৎ বংশ বৃদ্ধির কথা চিন্তা করে তারা এই বাড়িটা কিনে উঠলো।
ওরা যে এলাকায় থাকে সেটা আর পাঁচদশটা এলাকার মত ঘনবসতিপূর্ণ নয়। এই এলাকার বাড়িগুলো অনেক বড়। সামনে ও পেছনে ছড়ানো ছিটানো জায়গা বাগান করার জন্য। পুরো এলাকাটা দেখলে মনে হবে, যে বিল্ডার কোম্পানি এর বাড়িগুলো বানিয়েছে তারা খুব একটা নিশ্চিত ছিলোনা এখানে মোট কয়টা বাড়ি বানানো হবে। তাই অনেক করে খালি জায়গা বাড়ির সামনে ও পেছনে পড়ে রয়েছে। সবগুলো বাড়ি একই ধাঁচের তৈরি। নীচের তলায় রান্নাঘর, বসার ও খাবার ঘর। উপরের তলায় সবগুলো শোবার ঘর এবং দোতালায় ঝুল বারান্দা। এক বাড়ি থেকে পাশের বাড়ির দূরত্ব অনেক। ব্যাকইয়ার্ড বা পেছনের বাগানে দাঁড়িয়ে গলা ফাটিয়ে ডাকলেও পাশের বাড়ি থেকে কেউ শুনবেনা। এই এলাকাটা শহরের এক প্রান্তে অবস্থিত। এর পরের শহর প্রায় দশ, বারো মাইল দূরে।
হাসান যে বেতন পায় তাতে তাদের দুজনার ছোট্ট সংসার খুব ভালো মত চলে যায়। হাসান ওদের পাশের শহরে অবস্থিত একটি নামকরা হসপিটালের ক্যান্সার রিসার্চ ল্যাবে কাজ করে। সে বায়োকেমিস্ট্রিতে পি এইচ ডি করেছে। পি এইচ ডির থিসিস শেষ করতে না করতেই মোটা বেতনের এই গবেষণার কাজটা পেয়ে গিয়েছে। বাড়ি থেকে হাসানের কাজে যেতে তেমন একটা সময় লাগেনা। এদিককার রাস্তায় ট্র্যাফিক কম। হাসান সাধারণত তিরিশ মিনিটে কাজে পৌঁছে যায়। তাই সকালে উঠে হাসান ধীরে সুস্থে রেডি হয়ে, নাস্তা করে কাজে যায়। আর এলিনাও ভালোবাসে সময় নিয়ে হাসানের পছন্দের নাশতা তৈরি করতে।
নাশতা খেতে খেতে হাসান প্রায়ই এলিনাকে বলে, একা একা সারা দিন বাড়িতে থাকতে নিশ্চয় অনেক খারাপ লাগে তোমার। আশে পাশের স্কুলে বা লাইব্রেরিতে একটা কাজতো নিতে পারো।
এলিনার ঝটপট উত্তর, আমার সংসার করতে খুব ভালো লাগে। আমি বাড়ি থাকতেই বেশী স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি।
এ বাড়িতে উঠার পর থেকেই এলিনার কেমন যেন গা ছমছম করে। বিশেষ করে, হাসান যখন বাড়িতে থাকেনা। সে প্রায় বিভিন্ন ধরনের আওয়াজ শুনতে পায়। একদিন সে বাগানে গাছে পানি দিচ্ছিলো, হঠাত শুনতে পেলো কোথাও যেন একটা বাচ্চা কেঁদে উঠলো। অথচ পাশের বাড়িতে কোনো ছোটো বাচ্চা নেই, শুধু একজন স্বামীস্ত্রী দম্পতি থাকে। তারা অনেকদিন যাবত বাড়িতে নেই, ছুটিতে কোথাও বেড়াতে গিয়েছে। তাহলে বাচ্চার কান্না এলো কোথা থেকে?
আর একদিন দুপুরে এলিনা একটা দোলনার শব্দ শুনতে পেলো। কে যেন দোলনায় বসে অনেকক্ষণ ধরে দোল খাচ্ছে। মাঝে মধ্যে সে সাইকেলের ঘন্টার শব্দ শুনতে পায়। অথচ এই নির্জন এলাকায় স্থানীয় বাসিন্দা ছাড়া তেমন একটা কেউ আসেনা। সাইকেল নিয়ে এখানে আসবে কে? মেইলম্যান বা পার্সেল ডেলিভারি করতে এলে তারা গাড়ি করে আসে এবং বাড়ির সামনে মেইল বক্সে রেখে যায়।
আর একদিন আর একটি ঘটনা ঘটলো। বিকেলে এলিনা পার্কে হাঁটতে গিয়েছে। গত এক সপ্তাহ ধরে প্রায়ই বৃষ্টি হচ্ছে। ঘাসের দিকে তাকালেই তা বোঝা যায়। বৃষ্টির পানি পেয়ে আশেপাশের গাছপালার রঙ আরো সবুজ বর্ণ ধারণ করেছে। চারিদিকে তাকালে এক ধরনের সতেজতা অনুভব করা যায়। পার্কে এসে বেঞ্চিতে বসতেই এলিনার মনটা প্রশান্ত হয়ে গেলো। একটু দূরেই বাচ্চাদের প্লে স্কেপ, খেলার জায়গা। স্লাইড, দোলনা, মাঙ্কি বার, সবগুলোতেই কোনো না কোনো বাচ্চা লাফাচ্ছে, ঝুলছে, দোল খাচ্ছে। আর একটু পরপর খিলখিল করে হাসিতে ভেঙ্গে পড়ছে। প্লে স্কেপের কাছে দুইজন মা দাঁড়িয়ে গল্প করছে।
এলিনার মনে হলো, একবার ওদের সাথে গিয়ে পরিচিত হয়। আর সেই উসিলায় ওদের সাথে গল্পও করা যাবে। এলিনা একটু হেঁটে এগিয়ে যেতেই একজন মা বলে উঠলো, আর ইউ নিউ ইন দা নেইবারহুড?
এলিনা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলতেই সে জিজ্ঞেস করলো, উইচ ব্লক ইজ ইউর হাউস ইন?
এলিনা হাত উঁচু করে পার্কের উত্তর পাশের রাস্তা দেখিয়ে বলল, টু ব্লক্ স ডাউন অন দা নর্থ সাইড অফ দা পার্ক।
উত্তরটা শুনে মা দুজন একে অন্যের দিকে তাকিয়ে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো। তারপর টুকটাক একথা সেকথা বলে মা দুজন তাদের বাচ্চাদের নিয়ে আলাপ শুরু করলো। ছোটো বাচ্চার মা’দের সাথে কথা বলার একটা নেতিবাচক দিক হলো, ওরা ওদের বাচ্চাদের নিয়ে সারাক্ষণ আলাপ করে। দুনিয়াতে এত কথা বলার টপিক থাকতে ওদের মাথায় আর যেন কিছু আসেনা। এসব মা’দের সাথে কথা বলতে গেলে এলিনা খুব তাড়াতাড়ি বোর হয়ে যায়।
এলিনা দ্রুত চিন্তা করলো, কি করা যায়। পার্কের অন্য পাশে হাঁটতে গেলে কেমন হয়? যেদিকটা নিরিবিলি তেমন একটা কেউ যায়না, সেই দিকটাতে। ভাবামাত্রই এলিনা উঠে উল্টা দিকে ঘুরে হাঁটতে শুরু করলো।
কয়েক পা হাঁটতেই মনে হলো চারিদিকের গাছপালা জঙ্গল একটু ঘন হতে শুরু করেছে। ঝোপঝাড়ের মধ্য দিয়ে একটা ছোট পায়ে চলার পথ তৈরি হয়েছে। এলিনা সেই পথ ধরে এগুতে থাকলো। হাঁটতে হাঁটতে সে আকাশ পাতাল ভাবছে। হঠাত এলিনার মনে হলো, পেছন পেছন কার যেন পায়ের শব্দ। এলিনা পেছনে ফিরে তাকালো। পেছনে কেউ নেই। এলিনা আবার হাঁটতে শুরু করলো। আবার একটা পেছন পেছন আসার পায়ের শব্দ পাওয়া গেলো। এলিনার মনে হলো, পিছে তাকালে কাউকে দেখা যাবে না। এলিনা ভয়ে ভয়ে পেছনে তাকালো। পেছনে কেউ নেই।
এবার সে সত্যি সত্যি ভয় পেলো। তার মনে হলো, খুব গরম পড়েছে। কারন সে ঘামতে শুরু করেছে। এলিনা জোরে জোরে পা ফেলে হাঁটতে শুরু করলো। পেছনের পায়ের শব্দটাও জোরে জোরে আসছে শোনা গেলো। এলিনা প্রাণপণে দৌড়াতে লাগলো। পেছনে কারো দৌড়ানোর শব্দ শুনতে পেলো। যে করেই হোক এলিনাকে পার্কের অন্য প্রান্তে বড় রাস্তাটায় গিয়ে উঠতে হবে। পায়েচলা পথের শেষ প্রান্তে সে যখন বড় রাস্তাটা দেখতে পেলো, তখন একপ্রকার হুড়মুড় করে রাস্তার উপর গিয়ে দাঁড়াতেই একটা গাড়ি এসে তার সামনে বিশাল জোরে ব্রেক কষে থামলো।
জানালা নামিয়ে একজন মাঝবয়সী ভদ্রলোক মাথা বেড় করে বলে উঠলো, আর ইউ অলরাইট মিস? আই ওয়াস অল মোস্ট গইং টু রান ওভার ইউ।
এলিনা মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, আই অ্যাম সো সরি স্যার। আই ওয়াস লস্ট ইন দা উডস।
ভদ্রলোক তৎক্ষণাৎ বলে উঠলো, নো প্রবলেম ইয়াং গার্ল। ক্যান আই গিভ ইউ আ রাইড ব্যাক হোম?
এলিনা হেসে বলল, দ্যাট উড বি গ্রেট। থ্যাংক ইউ।
কথায় কথায় এলিনা জানতে পারলো, বয়স্ক ভদ্রলোক এই এলাকার বাসিন্দা নয়। তিনি তার বোনের বাড়িতে কাজের ছুটিতে বেড়াতে এসেছেন। এলিনা বাড়ি এসে দেখে হাসান ততক্ষণে কাজ থেকে চলে এসেছে।
এলিনা হাসানকে পুরো ঘটনা খুলে বলল। হাসান ভুরূ কুঁচকে এলিনার দিকে তাকিয়ে বলল, কি সাংঘাতিক কথা। তুমিতো আর একটু হলে গাড়ি চাপা পড়তে।
এলিনা অবাক হয়ে বলল, তোমার কাছে খালি গাড়ি চাপা পড়ার কথা মনে হল। অন্য ব্যাপারটা চোখেই পড়লো না।
হাসান বলল, আমি সেটা নিয়েও ভাবছি। একজন সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে গেলে কেমন হয়?
পরের দুই সপ্তাহে এলিনার আওয়াজ শোনার ঘটনাগুলো ঘনঘন হতে থাকলো। সে সারাক্ষনই কোনো কোনো আওয়াজ শুনতে পায়। বারান্দায় কেউ হাঁটছে, গ্যারাজে কেউ গাড়ি স্টার্ট নিচ্ছে আবার বন্ধ করছে, বাচ্চাদের ছোটো খেলনা গাড়ী চলছে, রান্নাঘরে কেউ সবজি কাটছে, ড্রইং রুমে বসে কেউ পিয়ানো বাজাচ্ছে, দরজায় কেউ কলিংবেল চাপছে। এলিনা সারাদিন বাসায় অস্থির হয়ে ছটফট করে আর হাসানকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে বলে।
এর মধ্যে হাসান দুদিন ছুটি নিয়ে সারাদিন বাড়ি থাকলো। এলিনা সেই দুদিন খুব খুশি থাকলো। এবং সে কোনো ধরনের আওয়াজ শুনতে পেলো না।
হাসান এলিনাকে একজন মানসিক বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে গেলো। বয়স্ক ভদ্রলোক খুব ধীরস্থির স্বভাবের। উনি খুব মনোযোগ দিয়ে এলিনার সব কথা শুনলেন। সেই সাথে তার জীবনের সব আদ্যোপান্তও জিজ্ঞেস করলেন। পরিশেষে তিনি এই সিদ্ধান্তে আসলেন যে এলিনা খুব সম্ভবত ডিপ্রেশনে ভুগছে। সারাদিন বাড়িতে একা থাকার কারনে তার ডিপ্রেশন হচ্ছে। ডিপ্রেশনের কারনে তার অনেক টেনশন ও অ্যাংজাইটিও হচ্ছে। যার ফলে তার মস্তিষ্ক বিভিন্ন ধরনের অডিটরি হ্যালুসিনেশন তৈরি করছে।
তিনি এলিনাকে নার্ভ শান্ত করার কিছু ওষুধ প্রেস্ক্রাইব করলেন। সেই সাথে এও বললেন, কিছুদিন অন্য কোথাও থেকে ঘুরে আসলে বা জায়গা বদল হলে তার মানসিক অবস্থার উন্নতি হবে। প্রথমে এলিনা কিছুতেই বাসা ছেড়ে, হাসানকে ছেড়ে যেতে রাজি হলোনা। পরে হাসানের চাপাচাপিতে এবং অনেক করে বোঝানোর ফলে সে অন্য স্টেটে তার বোনের বাসায় দু’তিন সপ্তাহের জন্য যেতে রাজি হলো।
এর মধ্যে একদিন এলিনা দুপুরে লাঞ্চ সেরে কিছুক্ষন টিভি দেখে তারপর বিছানায় গিয়ে শুয়েছে। নার্ভ রিল্যাক্সার ওষুধ খাওয়ার কারনে তার ঘন ঘন ঘুম পায়। কতক্ষণ ঘুমিয়েছে এলিনা জানেনা। হঠাত একটা জোরে হাঁচির শব্দে তার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। হাঁচির শব্দটা মনে হলো পাশের রুম থেকে আসছে। এলিনা বিছানায় শোয়া অবস্থাতেই চোখ বন্ধ করে কান পেতে শুনতে চাইলো।
পাশের রুমে কে বা কারা কথা বলছে। একজন মহিলার কণ্ঠস্বর, সেই সাথে দুইজন বাচ্চা ছেলে ও মেয়ের গলার স্বর। বাচ্চাগুলো কিসের যেন বায়না ধরেছে। মায়ের কাছে আবদার করে চাইছে। আর মা বার বার না বলছে। এক সময় মা জোরে করে একটা ধমক দিলো। আর বাচ্চা মেয়েটা কাঁদতে শুরু করলো। বাচ্চা মেয়েটার কান্নার শব্দ এলিনা পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছে।
ভয়ে এলিনার বুকের ভেতর কিছু একটা জোরে জোরে বাড়ি দিতে থাকলো। সে অনেক কষ্টে বিছানা থেকে নেমে আস্তে আস্তে হেঁটে পাশের রুমের দিকে রওনা হলো। ওষুধের কারনে তার মাথাটাও একটু একটু ঘুরছে। এলিনা দেখতে চায় পাশের রুমে কারা কথা বলছে। পাশের রুমে ঢুকার দরজার কাছে এসে দাঁড়াতেই এলিনার মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো। চোখের সামনে সে পুরা অন্ধকার দেখলো। এলিনা জ্ঞ্যান হারিয়ে মাটিতে লুটিতে পড়লো।
হাসান অফিস থেকে বাড়ি এসে অনেকক্ষণ ধরে বেল বাজিয়ে এক সময় চিন্তায় পড়ে গেলো। নিশ্চয় এলিনার কিছু হয়েছে। সেদিন সে বাড়িতে ঢোকার চাবিটা ভুল করে রেখে গেছে। প্রায় তিরিশ মিনিট ডাকাডাকি ও দরজা ধাক্কানোর পরও যখন কেউ খুললনা তখন সে বাধ্য হয়ে পুলিশ কল করলো। পুলিশ এসে দরজা ভেঙ্গে ঘরে ঢুকে আবিষ্কার করলো, এলিনার অচেতন দেহ। জ্ঞ্যান আসার পরে এলিনা কিছুই মনে করতে পারলো না যে তার কি হয়েছিলো।
ব্যস আর দেরি নয়, হাসান পরের দিনই এলিনাকে তার বোনের বাড়িতে পাঠিয়ে দিলো।
এর প্রায় আট দশ দিন পরে হাসান তাদের বাড়ির সামনের মেইলবক্স থেকে সব চিঠি তুলে নিয়ে বাসায় এসেছে। সে দেখলো নীল রঙের খামে একটা চিঠি। কিন্তু সেখানে শুধু প্রাপকের নাম লেখা, কোনো প্রেরকের নাম নেই। শুধু একটা পোস্ট বক্স নাম্বার দেয়া। সে খাম খুলে চিঠিটা পড়তে শুরু করলো।
হাসান সাহেব,
আপনি আমাকে চিনবেন না। আমিও আপনাকে ব্যাক্তিগত
ভাবে চিনিনা তবে একটা ব্যাপারে আপনাকে কিছু কথা জানানোর প্রয়োজন মনে করছি।
আপনি ও আপনার স্ত্রী যেই বাড়িতে থাকেন তিন
বছর আগে সেই বাড়িতে আমি ও আমার স্ত্রী ছিলাম। আমরা দু’জনে প্রথম এই বাড়িতে এসে খুব
খুশী ছিলাম। আমি ওখানকার একটা স্কুলে অংকের শিক্ষকের চাকরি নিয়ে আসি। আমার স্ত্রী রেবেকা
বাড়িতেই থাকতো। সে আশেপাশে ছোটখাটো কাজ খুঁজছিল। প্রথম প্রথম সব কিছু ভালোই চলছিলো।
আমি স্কুল ছুটির পর বাড়ি চলে আসি। আমার স্ত্রী সারাদিন রান্নাবান্না, ঘর পরিষ্কার,
বাগান করা নিয়ে ব্যস্ত থাকে।
রেবেকা একদিন আমাকে বলল, সে যখন বাড়িতে একা
থাকে তখন বিভিন্ন ধরনের আওয়াজ শুনতে পায়। আমি জানতে চাইলাম, কি ধরনের শব্দ। রেবেকা
আমাকে বলল, সে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের শব্দ শুনতে পায়। কখনো বাচ্চার কান্নার শব্দ,
কখনো সাইকেলের ঘন্টার শব্দ, কখনো বারান্দায় কারোর হাঁটার শব্দ।
আবার কখনো কখনো গ্যারাজে গাড়ি স্টার্ট নেয়ার
শব্দ, কল থেকে পানি পড়ার শব্দ, দোলনায় দোল খাওয়ার শব্দ শুনতে পায়। মাঝে মাঝে দরজায়
কলিংবেলের শব্দ সে শোনে এবং দরজা খুলে দেখে কেউ নেই।
প্রথম প্রথম আমি ওর কথা কানে তুলতাম না। ওকে
বলতাম, ওগুলো তার মনের ভুল।
এরপর যত দিন যেতে লাগলো, তার ঐ আওয়াজ শোনার
তীব্রতা ক্রমাগত বাড়তে থাকলো। প্রতিদিন নানা ধরনের শব্দে তার কান ঝালাপালা হয়ে যেতো।
অবাক
ব্যাপার হলো, আমি বাড়ি থাকলে সে কোনো আওয়াজ শুনত না। কিন্তু সে একা থাকলেই বিভিন্ন
আওয়াজ শুনতে পেতো। আমি বাড়ি ফিরলেই দেখতাম কেমন পাগল, উদ্ভ্রান্তের মত চেহারা করে রেবেকা
বসে আছে আর ছটফট করছে। মাঝে মাঝে বিড়বিড় করে কি যেন বলছে।
আমি কোনো উপায় না দেখে তাকে একজন সাইকিয়াট্রিস্টের
কাছে নিয়ে যাই। উনি কিছু ঘুমের ওষুধ দেন কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়না। সে ঘুমের মধ্যে
চমকে চমকে জেগে উঠত। আর একজন সাইকোলজিস্ট তাকে জায়গা বদলের পরামর্শ দেয়। রেবেকা এই
বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতে চায়। আমিও সেই রকমটাই ভাবতে শুরু করি।
কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য। আমাকে দুই দিনের জন্য
অন্য শহরে একটা টিচারস ট্রেনিং ওয়ার্কশপে পাঠানো হয়। সেখান থেকে ফিরে এসে দেখি, আমার
সব শেষ।
কোনো এক অজ্ঞাত কারনে আমার রেবেকা আত্মহত্যা
করেছে। পুলিশ তার মৃতদেহ বাড়ির সামনে রাস্তায় আবিষ্কার করে। খুব সম্ভবত সে দোতালার
বারান্দা থেকে ঝাঁপ দিয়েছিল। দোতালা থেকে পড়ে তার মৃত্যু হওয়ার কথা নয় তবে তার মাথায়ও
একটা বড় আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়।
শোকে, দুঃখে আমি পাথর হয়ে যাই। বাড়ি বিক্রি
করে ঐ শহর ছেড়ে চলে যাই।
একটা কথা আমার মনে সব সময়ই খচখচ করতে থাকে।
রেবেকা সাংঘাতিক রকম মানসিক চাপের মধ্যে ছিলো ঠিকই। কিন্তু সে আত্মহত্যা করলো কেন?
আমি মনে মনে কিছুতেই মানতে পারলামনা।
স্কুলে টিচার হিসেবে কাজ করার কারনে লাইব্রেরিতে
আর্কাইভ সন্ধান করার এবং ডাটাবেসে তথ্য ঘাটার সুযোগ আমার ছিলো। আমি ঐ শহরের ইতিহাস
এবং পুরোনো তথ্যাদি খোঁজা শুরু করি। আমি যা খুঁজে পাই তাতে এক রকম বাক্রুদ্ধ হয়ে যাই।
আঠারোশো শতাব্দীর শেষের দিকে একটা ভয়াবহ দুরারোগ্য ব্যাধি এই অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। অসংখ্য নারী, পুরুষ, বৃদ্ধ, শিশু তাতে মৃত্যুবরণ করে। আপনাদের বাড়ি যেই লোকালয়ে, সে সময় সেখানে কোনো বাড়িঘর ছিলো না। তাই ঐ জায়গাটিতে একটি কবরস্থান বা সেমেটারি তৈরি করা হয় যেখানে রোগে আক্রান্ত মৃত মানুষদের গণকবর দেয়া হয়।
মানুষগুলোর অকাল মৃত্যুতে ওদের আত্মা কখনই শান্তি পায়নি। তাই মৃত্যুর পরে ওরা ওখানেই ঘোরাফেরা করে। ওরা মনে করে, এটা ওদের জায়গা। ওদের বাসস্থানে অনাহূত অতিথি এলে ওরা পছন্দ করেনা। বিভিন্ন রকম আওয়াজ করে ওদের উপস্থিতি জানান দেয়। জানিয়ে দেয়, অন্য কাউকে ওরা এখানে থাকতে দেবেনা। ওদের কবরের উপর দাঁড়িয়ে থাকা ঐ বাড়িটা অভিশপ্ত। ঐ বাড়ির আশেপাশ দিয়ে যাওয়ার সময় অনেকে নানা রকম আওয়াজ শোনার কথা বলে।আমি ঐ শহরের খুব বয়স্ক ও অভিজ্ঞ একজন পাদ্রীর
সাথে এটা নিয়ে আলাপ করি। উনি বলেন, অন্ধকার জগতের বাসিন্দারা খুশি না হলে, অসন্তুষ্ট
হলে, অনেক কিছুই করতে পারে। এমনকি তারা আমাদের ইহজগতের মানুষদের তাদের জগতে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা
করে। জীবিত মানুষদের অন্ধকার, অশুভ জগতে প্রবেশ করার অনুমতি তখনি মেলে, যখন তাদের অপঘাতে
মৃত্যু হয়।
রেবেকার কি হয়েছিল আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না। আমি চলে যাওয়ার পর ঐ বাড়িটা বহুদিন পরিত্যক্ত ছিলো। যিনি বাড়ি কিনেছিলেন তিনি অন্য শহরে থাকেন। তিন বছর পর তিনি ঐ বাড়িটা খুব কম দামে বিক্রির চেষ্টা করেন। এর পরের টুকু আপনার আর অজানা নয়। আমার অনুরোধ, যদিও এটা পুরাপুরি আপনাদের সিদ্ধান্ত, তবে সম্ভব হলে আপনারা বাড়িটা বিক্রি করে অন্য কোথাও চলে যান।…..
চিঠি পড়তে পড়তে হাসান একসময় ঘুমিয়ে পড়েছিলো। হঠাত একটা কান্নার শব্দে তার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। কোথায় যেন একটা নারী কণ্ঠে কান্নার শব্দ। শব্দটা কি পাশের ঘর থেকে আসছে নাকি বারান্দা থেকে হাসান ঠিক বুঝতে পারলোনা।
হাসান বিছানায় ঘাপটি মেরে, প্রায় দম বন্ধ করে, শব্দটা শোনার চেষ্টা করছে। গলাটা শুকিয়ে আসছে পানির তেষ্টায়। কতক্ষণ পার হয়েছে জানে না। একটুপর মনে হলো, কেউ খুব জোরে তার মাথা দেয়ালে ঠুকছে। এরপর মেয়েটার কান্নার শব্দ আরো তীব্র হতে থাকলো। ভয়ে হাসান শোয়া অবস্থাতেই দুই হাত দিয়ে তার কান চাপা দিলো। একটু পরে সে শুনতে পেলো, কেউ একজন দৌড়াতে দৌড়াতে ঘরের দরজা খুলে বারান্দায় গেলো এবং বারান্দা থেকে প্রচণ্ড জোড়ে একটা কিছু নীচে পড়ার শব্দ হলো।
ঠিক এই সময় হাসানের মুঠোফোন বেজে উঠলো, স্ক্রিনে এলিনার ছবি। হাসান কাঁপতে কাঁপতে ফোনটা ধরে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে এলিনার কণ্ঠস্বর। “হাসান, তুমি কি ঠিক আছো?”
“আর এক মূহুর্ত এ বাড়িতে নয় এলিনা, আমি ঠিক
করে ফেলেছি।“ হাসান হড়বড় করে বলে উঠলো।
পরের দিন ভোরের আলো ফুটতেই হাসান তার রিএল্টার
এজেন্টকে ফোন দিলো। দু’দিনের মধ্যেই বাড়ি ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। গোছগাছ করতে করতে
হাসানের একবার মনে হলো, ঐ ভদ্রলোকের পাঠানো চিঠিটাতো শেষ করা হয়নি। হাসান পড়তে শুরু
করলো।
“হাসান সাহেব, শেষ একটা কথা। রেবেকার যেহেতু
আত্মহত্যা থেকে অপঘাতে মৃত্যু হয়েছিলো, তার আত্মাও কখনো শান্তি পায়নি। তাই সে এই বাড়ি
ছেড়ে যেতে পারেনি। নিশুতি রাতে কোনো মহিলার চাপা কান্না ও আর্তনাদ যদি শুনতে পান, সে
আমার রেবেকা।
সাবধানে থাকবেন।
ইতি, আপনার শুভাকাঙ্খি বন্ধু।"

খুবই চান্চ্ঞল্যকর - এক নিশ্বাসে পড়ার মত গল্প।
ReplyDeleteNicely written. It was thrilling and interesting. Thanks for sharing.
ReplyDeleteInteresting story. Enjoyed reading it
ReplyDelete