মনের উপর জোর চলেনা

সেদিন স্কুল থেকে একটা ইমেইল পেলাম যে আমরা যারা প্রাইমারি বা সেকেন্ডারি স্কুলে কাজ করি, আমাদের সকলকে একটা আবশ্যকীয় ট্রেনিং নিতে হবে মানসিক সুস্থতা সংক্রান্ত। এটা টেক্সাস স্টেট থেকে বাধ্যতামুলক করা হয়েছে সকল কর্মীর জন্য, যারা প্রতিদিন স্কুলের ছেলেমেয়েদের সাথে কাজ করে বা স্কুলের কোনো কাজের সাথে সম্পৃক্ত। এই ভিডিও ট্রেনিং এর মাধ্যমে স্কুলের সাথে সংশ্লিষ্ট সকলকে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে, যাতে তারা প্রাথমিক ভাবে স্কুলের ছেলেমেয়েদের মধ্যে মানসিক অসুস্থতার লক্ষণ দেখলে তা সনাক্ত করতে পারে এবং পরবর্তীতে তাদেরকে স্কুলের কাউন্সেলর বা বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে পরামর্শ দিতে পারে। 

ছেলেমেয়েদের মধ্যে যে সব অস্বাভাবিকতা বিশেষ ভাবে লক্ষ্যণীয় সেগুলো হল বিষণ্ণতা, মানসিক অবসাদ, চড়া মেজাজ, ক্লাসের কোনো কাজে অনীহা, অন্যের প্রতি ভীতি, সর্বদা আশংকা ও উদ্বেগ প্রকাশ। এছাড়া বাড়িতে কোনো শারীরিক বা মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে বোঝা গেলে অথবা আত্মহত্যা করার মত কোনো বার্তা বা সংকেত দিয়ে থাকলে তা সঠিক সময়ে সনাক্ত করাও বিশেষ ভাবে জরুরি।

প্রতি বছর বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস পালিত হয় ১০ই অক্টোবার। বিশ্ব জুড়ে এই দিনটি পালনের মাধ্যমে মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা হয় এবং পরিচিতজন ও আশেপাশের মানুষের মধ্যে মানসিক সমস্যায় আক্রান্তদের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে উদ্বুদ্ধ করা হয়। বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসের এই বছরের প্রতিপাদ্য, বিশ্বব্যাপি কোনো জরুরি বা দূর্যোগপূর্ণ অবস্থার সৃষ্টি হলে সবাই যেন তাদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার সুযোগ ও সাহায্য পায়। যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দূর্যোগ, পুনর্বাসন, এরকম বিভিন্ন বৈশ্বিক সংকটের সময় সাধারন মানুষ যাতে মানসিক ব্যধির চিকিৎসা পেতে পারে তার কথা মনে রেখেই এই বছরের প্রতিপাদ্য নির্বাচন করা হয়েছে।  

মানসিক অসুস্থতা ইদানিং কালের সবথেকে আলোচিত বিষয় । এটা এমন একটা ব্যাপার যা চোখে দেখা যায়না, ছোঁয়া যায়না, শুধু অনুভব করা যায় - নিজের মধ্যে, অন্য কারোর মধ্যে, অথবা আশেপাশের কোনো চেনা মানুষের মাঝে। আর সে কারনেই বর্তমানে মানসিক অসুস্থতাকে শারীরিক অসুস্থতার চাইতেও বেশি প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। 

শরীরে কোনো কাটাছেড়া, জ্বরজারি, মাথা ব্যথা, গলা ব্যথা হলে আমরা নিজেরাই বাড়িতে তার উপশমের ব্যবস্থা নেই।  বড় ধরনের কোনো অসুখ হলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হই। কিন্তু মানসিক কোনো যন্ত্রণা  যখন আমাদের পিড়া দেয় তখন প্রথমেই আমাদের মাথায় যে চিন্তাটা আসে তা হলো, চেপে যাওয়া বা লুকিয়ে রাখা। আমরা মন খুলে কারো সাথে এটা নিয়ে আলাপ করতে ভয় পাই। পাছে আমাদের কেউ পাগল ভাবে। 

আমাদের বাঙালি সমাজে পাগল হিসেবে চিহ্নিত হওয়াটা খুব গর্হিত একটি কাজ। ছোটবেলা থেকেই এটা আমাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া হয়। কথাবার্তায়, ব্যবহারে কোনো ধরনের অস্বাভাবিকতা দেখা দিলেই বলা হবে, তুমি পাগল। কথায় কথায় বলা হবে, তোমাকে পাবনার পাগলা গারদে পাঠিয়ে দেয়া উচিত। এই কথাটা শুনতে আমরা বাঙ্গালিরা ভীষণ ভাবে অভ্যস্ত। তাই আমরা আমাদের মানসিক পীড়ার কারণটা খুব সাবধানে লুকিয়ে রাখতে চাই। আর সেটা যদি কোনো ভাবে বের হয়ে আসে তাহলে আমরা তা অস্বীকার করি বা ডাক্তারের কাছে যেতে অস্বীকৃতি জানাই।

মানসিক অসুস্থতা অনেকের কাছে প্রতিদিনের  যুদ্ধ, অনেকের কাছে এটা নিত্যবাস। অনেকে নিজের মধ্যে ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে দিনের পর দিন পার করছে, কাউকে বলতে পারছেনা। অনেকে তার পরিবারের কোনো সদস্যের মধ্যে মানসিক সমস্যা দেখতে পাচ্ছে, তার সাথে দিনের পর দিন কাটাচ্ছে, কাউকে বলতে পারছেনা। তাই এই ব্যাপারে আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন খুবই জরুরী।   

আমাদের জীবন ব্যস্ত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। পারিবারিক দায়িত্ব, চাকরি বাকরি, পড়াশোনা, সামাজিক সম্পর্ক, নৈতিক দায়িত্ব সব কিছুর ভারে আমরা ক্রমাগত নুয়ে পড়ছি। অনেকে বিভিন্ন স্তরের চাপ সহ্য করতে না পেরে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে। এমতাবস্থায় এই মানসিক পীড়া আমাদের কখনই অবহেলা করা উচিত নয়। বিশ্বাস করা যায় বা খুব নিকটের কারোর সাথে আমাদের সমস্যার ব্যাপারে আলাপ করা উচিত। বাবামা, শিক্ষক, কাছের কোনো বন্ধু, অথবা স্বামীস্ত্রী একে অন্যের সাথে খোলাখুলি আমাদের সমস্যার কথা আলাপ করতে পারি। তবে ব্যক্তি নির্বাচন করার আগে আমাদের জানতে হবে বা বোঝার চেষ্টা করতে হবে, সেই ব্যক্তিটি কতটা উদার মনে আপনার সব কথা শুনবে এবং উপযুক্ত গোপনীয়তা রক্ষা করে সঠিক পথে এগুনোর পরামর্শ দান করবে। 

কম বয়সী ছেলেমেয়েদের ক্ষেত্রে এটা একটা বিরাট সমস্যা। এরা কাউকেই বিশ্বাস করে তাদের সমস্যার কথা পুরোপুরি বলতে পারেনা। কারন ভুলের সমাধান দেয়ার আগে তাদের কেনো ভুল হয়েছে, এই ব্যাপারেই বড়দের থেকে তাদের বেশি লেকচার শুনতে হয়। তখন তারা নিজেদেরকে আরো গুটিয়ে ফেলে। বিভিন্ন ধরনের মানসিক সমস্যায় ভুগে। অনেকে অতিরিক্ত হতাশাগ্রস্ত হয়ে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে, অনেকে নিজের জীবন শেষ করে দেয়ার মত চরম সিদ্ধান্ত নেয়।

প্রতি বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, প্রতি পাঁচজনে একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ মানসিক অসুস্থতায় ভুগে। ৬ থেকে ১৭ বছর বয়সীদের মধ্যে প্রতি ছয়জনে একজন তরুণতরুনী কোনো ধরনের মানসিক রোগে আক্রান্ত। শতকরা পঞ্চাশ ভাগ মানসিক সমস্যা শুরু হয় ১৪ বছর বয়স থেকে। আর শতকরা পচাত্তুর ভাগ শুরু হয় ২৪ বছর বয়স থেকে। ১০-১৪ বছরের ছেলেমেয়েদের মধ্যে আত্মহত্যা, দ্বিতীয় প্রধান কারন হিসেবে মৃত্যুর জন্যে দায়ী। এই ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে দুঃখজনক। বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলা এতো সহজেই নিজেদের জীবন কেড়ে নেয়ার কথা ভাবে।

আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, পুরা দুনিয়াটাই কি মানসিক অসুস্থতার শিকার? 

সোশ্যাল মিডিয়াতে গেলে, টিভি খুললে, খবরের কাগজ পড়লে খালি চোখে পড়বে চারিদিকের খারাপ, ভয়াবহ, অবিশ্বাস্য খবর। সন্তানের বাবামা কে খুন করার খবর, মা'র নিজের শিশুকে মেরে মাটির নিচে পুঁতে ফেলার ঘটনা, কাউকে কুপিয়ে হত্যা করার স্টোরি, কারো মাথা কেটে দেয়ার ভিডিও পোস্ট, মেয়ের ছোটবেলার স্মৃতিতে নিজের বাপ দ্বারা শারীরিক নির্যাতন, আত্মহত্যা করার আগে ধারাবাহিক বর্ণনা, কাউকে আগুন দিয়ে পুরিয়ে মারার দৃশ্য, সোশ্যাল ইনফ্লুএন্সারকে খুনের লাইভ স্ট্রিম, এমন কতশত খবর প্রতিনিয়ত আমাদের সামনে আসছে, মনের ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে এবং কোথায় যেন একটা প্রভাব ফেলে যাচ্ছে। যারা এগুলো পোস্ট করছে তারা মানসিক ভাবে নিঃসন্দেহে অসুস্থ। মানুষের দৃষ্টি আকর্ষনের চেষ্টায় এইসব সাংঘাতিক পোস্ট করছে। 

কিন্তু আমরা যারা অধীর আগ্রহে, গভীর মনোযোগে এইসব পড়ছি, দেখছি, শুনছি, তারা কতটা সুস্থ? নাকি সমাজ বিজ্ঞানীদের প্রাচীন থিওরিটা বারবার প্রমাণ হচ্ছে যে, খারাপ জিনিসের প্রতি মানুষের ভালো লাগা বা ঝোঁকার একটা আদি প্রবণতা বিদ্যমান। 

বর্তমান কালে পশ্চিমা দুনিয়ায় 'ডুমস্ক্রলিং' বলে একটা বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছে। যদিও বিষয়টা কোনো অংশেই ভালো বা আশাব্যাঞ্জক নয়। আমরা সবসময় আমাদের মুঠোফোনে স্ক্রল করি এবং প্রতিনিয়ত অনলাইন নিউজ বা খবরের মধ্যে ডুবে থাকি। এভাবে সর্বক্ষণ খারাপ নিউজ দেখা ও পড়ার কারনে আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ক্রমাগত অবনতি ঘটছে। এই বিষয়টাই তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ডুমস্ক্রলিং বলে পরিচিত। সমাজ বিজ্ঞানীরা এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের কিছু উপায় বাতলে দিয়েছে। প্রাত্যাহিক একটা নির্দিষ্ট সময় নির্ধারন করে সোশ্যাল মিডিয়াতে যাওয়া, হাতের কাছ থেকে ফোনটা মাঝে মাঝে সরিয়ে রাখা, দিনের একটা নির্দিষ্ট সময়ে খবর দেখা, প্রতিদিন কিছুক্ষণ শারিরীক ব্যায়াম করা, ভালো সঙ্গ ও ভালো বন্ধু নির্বাচন করা, প্রতিদিন একটা ভালো কাজ করা, ইত্যাদি ছোট ছোট ব্যাপার আমাদের দৈনন্দিন তালিকায় যুক্ত করা যেতে পারে।       

মানসিক অসুস্থতা একটা ধারাবাহিকতার মধ্যে বিভিন্ন স্তরে, তার তীব্রতা ও উপসর্গের ভিত্তিতে ওঠানামা করে। কেউ মাথায় সামান্য আউলা হতে পারে। কেউ হতে পারে বদ্ধ পাগল। আবার কেউ হতে পারে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক, কিন্তু মানসিক চাপ সহ্য করার পরে ভারসাম্যহীন। সমস্যা যেই লেভেলের বা যেই প্রকৃতির হোক না কেন সেটা টের পাওয়ার সাথে সাথে নিজের জন্যে বা অন্য কারো জন্যে তার সমাধানের উদ্দেশ্যে এগিয়ে আসা উচিত। 

আর এই ব্যাপারে আমার জেন যি, জেন আলফা ছেলেমেয়েদের কথাই মনে পড়ে। জীবন যুদ্ধ মোকাবেলা করতে সবচেয়ে বেশি সাহসের প্রয়োজন আমাদের তরুণ সমাজের। তাই বড়দের উচিত, তরুণ প্রজন্মের কাছ থেকে আস্থা ও বিশ্বাস অর্জনের উপায় বের করা এবং তাদেরকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করা। আমাদের সকলের মনোবৃত্তি হওয়া উচিত সাহায্য, সহযোগিতা, সহমর্মিতা। সবার মনে রাখতে হবে যে এই যাত্রায় আমরা একা নই। জীবনের কোনো না কোনো সময়ে আমরা কিছু মানসিক সমস্যা বা চাপের মুখোমুখি হবো। তখন যেন আমরা হাল ছেড়ে না দেই। 

মনের উপর কখনই জোর জবরদস্তি চলে না। মনের তরঙ্গ ওঠানামা করে। মনকে চাই সঠিক উপায়ে, সঠিক দিকে পরিচালিত করা। যাতে সে এই জগতের সব সুন্দর আর সব ভালোর দিকে আকর্ষিত হয়। সুন্দর সুন্দর চিন্তা, ভালো ভালো কথা, দারুণ কিছু উপলব্ধি, এই যেন হয় আমাদের প্রতিদিনকার মন্ত্র।  

Comments

  1. ইয়াসমীন রহমানOctober 11, 2025 at 1:42 PM

    এটি একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা নিয়ে আমরা খুব একটা সচেতন নই। এ ব্যাপারে সচেতন হওয়ার জন্য লেখাটি অতি মুল্যবান। ধন্যবাদ লেখিকাকে।

    ReplyDelete
  2. It is very encouraging to see that the state of Texas is taking initiative to take Mental Health seriously and promoting awareness. Hope that it brings a positive change into the society

    ReplyDelete
  3. Good write bondhu. It is scary to see your statistics. It’s heartbreaking to see how much pressure kids face these days — emotionally and mentally.
    We really need to prioritize open conversations, emotional support, and mindful parenting.
    A healthy mind in childhood builds the foundation for a strong, confident future. Good luck to you and keep writing..

    ReplyDelete

Post a Comment