টেক্সাসের নীল ঐতিহ্য

ব্লুবনেট(Bluebonnet) ফুল, টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের জাতীয় ফুল। প্রতি বছর বসন্ত এলেই এই নীল রঙের ফুলটি ঝাঁকে ঝাঁকে ঘাসের মধ্যে থেকে বেড়িয়ে আসে এবং দূর থেকে দেখলে নীল রঙের আস্তরণ বা কার্পেট মনে হয়।  

১৯০১ সালে প্রথম টেক্সাস এর আইন প্রণয়নকারী কর্মকর্তারা ভেবেছিলো যে কোন ফুলকে জাতীয় ফুল হিসেবে ঘোষণা করা হবে। ক্যাকটাসের ফুল নাকি আদিম বুনো ফুল ব্লুবনেট। পরবর্তীতে ব্লুবনেটের অপার ও অকৃত্রিম সৌন্দর্য বিবেচনা করে তারা এটিকে জাতীয় ফুল হিসেবে নির্বাচন করে।

সারা টেক্সাস ব্যাপী যেখানে বালু ও পাথুরে মাটি দিয়ে ভরপুর সেখানে ব্লুবনেট খুব সহজেই জন্মায়। টেক্সাসের রুড় আবহাওয়া ও গরম তাপমাত্রায় এটি অনায়াসে টিকে থাকতে পারে। আর তাইতো ছোট্ট নীল রঙের এই জাতীয় ফুলটিকে কঠোরতা, দৃঢ়তা ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হয়।

ব্লুবনেট দেখতে গারো নীল রঙের এবং মাথার কাছে উপরে সাদা রঙের হয়। মজার ব্যাপার হল এদের নাম নীল বা ব্লুবনেট হলেও শুধু নীল নয়, বরং বেগুনী, গোলাপি ও সাদা রঙেও এদের দেখা মেলে। বিজ্ঞানীরা বলে থাকে এটি জেনেটিক মিউটেশনের মাধ্যমে রং পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়।

এই ফুলটি মাটি থেকে খুব বেশী উঁচুতে উঠে না। এদের দৈর্ঘ্য হয় প্রায় দুই ফিটের মত। এদের গাড়, উজ্জ্বল নীল রং এবং সুমিষ্ট মধু প্রজাপতি, মৌমাছি এবং অন্যান্য কীটপতঙ্গকে সহজেই পরাগায়নে আকৃষ্ট করে। তবে এটির পাতা ও ফুল মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীদের জন্য খুবই বিষাক্ত। এরা মাটিতে রাসায়নিক দ্রব্য যেমন নাইট্রোজেনের সমতা রক্ষায় সহায়তা করে থাকে। তাই ইকোসিস্টেম বা প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় এদের অবদান অনসীকার্য।

ব্লুবনেট কি করে প্রথম টেক্সাসে এলো তা নিয়ে বিভিন্ন কথার প্রচলন আছে। কেউ কেউ বলে স্পেন থেকে বসতি স্থাপনের উদ্দেশ্যে আসা স্প্যানিয়ার্ডরা প্রথম এর বীজ নিয়ে আসে এবং বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে দেয়। আবার কেউ কেউ মনে করে, ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে আসা একদল মানুষ জেরুযালেমের পাহাড় থেকে এই ফুলের বীজ প্রথম নিয়ে আসে। 

নেটিভ আমেরিকানদের মধ্যে একটি প্রচলিত লোকগল্প আছে। একবার কোনো এক পাহাড়ি সম্প্রদায়ের মানুষেরা ভীষণ ভাবে খরায় আক্রান্ত হয়। দিনের পর দিন বৃষ্টি না হওয়ায় সেই অঞ্চলের মানুষের জীবনে দূর্দশার শেষ ছিলোনা। তখন একটি ছোট মেয়ে যার হৃদয় ছিলো নিষ্কলুষ ও পবিত্র সে পাহাড়ের মাথায় গিয়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে বৃষ্টি প্রার্থনা করে। দিনের পর দিন সেখানে বসে প্রার্থনা করতে করতে মেয়েটি একসময় অজ্ঞান হয়ে পড়ে এবং মারা যায়। ব্যস, তার পরপরই বৃষ্টি শুরু হয় এবং মেয়েটি যেখানে মারা যায় পাহাড়ের সেই অঞ্চল থেকে নীল রঙের ফুল জন্মাতে শুরু করে।

আমেরিকার প্রাক্তন ফার্স্ট লেডি বার্ড জনসন ভীষণ রকম বুনোফুল ভালবাসতেন। তিনি প্রকৃতির সৌন্দর্য বর্ধন ও প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় দারুণ ভাবে বিশ্বাসী ছিলেন। টেক্সাসের বিভিন্ন হাইওয়ে বা বড় রাস্তার দুই ধার দিয়ে রংবেরঙের ফুল ও গাছপালা লাগানোর পদক্ষেপ তিনিই প্রথম নেন। ক্ষমতায় থাকাকালিন সময় তারই নিরলস প্রচেষ্টায় টেক্সাসের বিভিন্ন হাইওয়ে রাস্তার দুই ধার দিয়ে ব্লুবনেট এর বীজ ছড়িয়ে দেয়া হয়। যার ফলশ্রুতিতে বছরের পর বছর ধরে আমরা টেক্সানরা প্রতি বসন্তে ব্লুবনেটের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে লালন করে আসছি। 

মার্চের শেষ থেকে এপ্রিলের শেষ পর্যন্ত ব্লুবনেটের প্রাধান্য দেখা যায়। তবে প্রতি বছর আবহাওয়া পরিবর্তনের সাথে সাথে এটার আবির্ভাব ও স্থায়িত্ব কালেরও পরিবর্তন ঘটছে। যেসব বছরে বসন্তের আগে তেমন একটা বৃষ্টি হয়না সেসব বছর ব্লুবনেট খুব বেশি হারে বের হয়না বা বের হলেও এর নীল রঙের গাড়োতা কম থাকে। 

প্রতি বসন্তে, দিগন্ত বিস্তৃত মাঠের মধ্যে বা বড় রাস্তার চারিধার দিয়ে অসংখ্য অগণিত ব্লুবনেট যখন দলবদ্ধ হয়ে বিছিয়ে থাকে, তখন চারিদিকে ছবি তোলার হিড়িক পড়ে যায়। সারা টেক্সাস জুড়ে  পরিবারের বিভিন্ন সদস্যরা মিলে, ছোট শিশু এমনকি পোষা প্রাণীদের নিয়ে সেই গভীর নীল সমুদ্রের মাঝে দাঁড়িয়ে, বসে, দৌড়িয়ে, শুয়ে ফটোসেশন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

এপ্রিল মাসে ব্লুবনেট ফেস্টিভ্যাল টেক্সাসের একটি প্রচলিত ট্র্যাডিশন। শুধু লোকাল জনগোষ্ঠী নয় বরং আশেপাশের স্টেট থেকেও বহু মানুষ এই নীল সৌন্দর্য দর্শনে সামিল হতে ছুটে আসে। খুব অল্প সময় এরা বাঁচে, খুব ক্ষণস্থায়ী এদের জীবন। তবে একবার এই নীল ফুলের অপরূপ শোভা দেখলে তা যে কারো মনে দাগ কেটে যাবে আজীবন।

Comments

  1. চমৎকার লেখা। একটি নতুন জ্ঞান পেলাম এই লেখার থেকে, তবে সেই পাহাড়ি মেয়ের ঘটনাটা সত্যিই হৃদয়বিদারক। আপনাকে অভিনন্দন।

    ReplyDelete

Post a Comment