বিয়ের লাইসেন্স
এই মৌ, ঐ দিকে যাচ্ছিস কেনো? হোটেলে ঢোকার দরজাটাতো অন্য দিকে - আপাদের ডাকে মৌটুসির বোধোদয় হলো।
কিন্তু ততক্ষণে যা ঘটার তা ঘটেই গেছে। মৌটুসি তাড়াহুড়া করে বাগানের অন্য প্রান্ত দিয়ে যেতে গিয়ে একেবারে কুকুরের ইয়ের উপর পাড়া দিয়ে দিয়েছে। কি বিশ্রী অবস্থা। ডান পায়ের স্যান্ডালের তলায় একেবারে মাখামাখি।
মৌটুসির নিজের উপর অনেক রাগ হলো। এরকম একটা বোকার মত কাজ সে করলো কি করে।
মৌটুসির খালাতো ভাই রাসেল দৌড়ে এসে হাসতে হাসতে বলল, কুকুরের ইয়েতে পাড়া দেয়ার মানে জানিস তো? একেবারে সাক্ষাত লক্ষ্মী দর্শন, সাইন অফ গুড লাক। একটা শুভ কাজ করে তুই তোর শুভ দিনটা শুরু করলি।
আসলেই তো আজ মৌ এর জীবনে এক
গুরুত্বপূর্ণ দিন। আজ তার বিয়ে, মানে বিয়ের লাইসেন্স করার দিন। দুনিয়ার সবচাইতে ব্যস্ততম
নগরী নিউইয়র্কের সিটি হলে গিয়ে এই রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করতে হবে। কারন মৌ থাকে নিউইয়র্কে।
ঠিক এগারো বছর আগে অগাস্ট মাসের এক পাতা ঝরা দিনে আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে বাংলাদেশ থেকে মৌ এর আগমন। সেই দিনটা ছিল উত্তেজনা ও আশংকায় ভরা। বহু প্রতীক্ষিত আমেরিকার মাটিতে পদার্পণ করে ঠিক যেমনটা ভেবেছিল সেরকম কিছুই মনে হয়নি মৌ এর। ওর চাচা/চাচী এসেছিলো ওকে নিতে জেএফকে এয়ারপোর্টে।
নব্বই দশকের জেএফকে এয়ারপোর্ট ছিল একেবারেই আলাদা। অনেক ছোটো ও মলিন, কোন জৌলুশ বা চাকচিক্যবিহীন। এয়ারপোর্ট কর্মীরাও ছিল সাংঘাতিক নিঃস্পৃহ ও চাঁচাছোলা। বিভিন্ন দেশ থেকে আসা যাত্রীদের প্রতি তাদের আচরণ একদম বন্ধুসুলভ ছিলোনা। বরঞ্চ তাদের হাবভাব ছিল ঠিক উলটা। যেন তারা আমেরিকার মাটিতে বিদেশীদের দেখতে চায়না।
ওদিকে বাইরে প্রকৃতিও ছিল দারুণ নারাজ। আকাশ
ছিল মেঘলা, থমথমে। টিপটিপ করে একটু পরপর বৃষ্টি হচ্ছিল। চারিদিকে ছিল বিষণ্ণতায় ঢাকা।
মৌ এর মনটা খারাপ হয়ে গেলো। প্লেন থেকে নেমে শুট দিয়ে এসে মৌ যখন এয়ারপোর্ট এর ভেতর প্রবেশ করলো, চারিদিকে তাকিয়ে দম ফেটে তার কান্না এসেছিলো। বুকের মধ্যে হু হু করে উঠেছিলো। মনে হয়ে ছিল, এক দৌড়ে আবার প্লেনে গিয়ে বসে। যাতে প্লেন তাকে আবার ফেরত নিয়ে যায় ফেলে আসা দেশের মাটিতে। ফেলে আসা নিজের বাড়িতে, বাবামা ও স্বজনদের মাঝে।
এরপর বহু দিন গড়িয়ে গেছে। আস্তে আস্তে আমেরিকার জীবনযাত্রায় মৌ অভ্যস্ত হয়েছে। জীবনের পথ পরিক্রমায় বহু চড়াই উতরাই পেরিয়েছে। কিন্তু আমেরিকায় আসা প্রথম দিনটার কথা সে এখনো ভোলেনি।
আবার সেই অগাস্ট মাসেই মৌ এর জীবনে আর একটি ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। ঘুরে ফিরে কেনো অগাস্ট মাসেই বিশেষ দিনগুলো আসে, মৌ ভেবে পায়না। অগাস্ট মাসের ১ তারিখ, মৌ এর বিয়ের রেজিস্ট্রেশন অর্থাৎ লাইসেন্স পাওয়ার দিন।
যার সাথে মৌ এর শুভ কাজটি সম্পন্ন হবে তার নাম সিয়াম। সিয়াম থাকে ক্যালিফোর্নিয়া স্টেটের বে-এরিয়ায় অবস্থিত ওকল্যান্ড শহরে। সে ওখানে একটি হাইটেক ফার্মে কর্মরত।বিয়ের কারনে এখন এসেছে নিউইয়র্কে। উঠেছে কুইন্সের একটি পাঁচতারা হোটেলে।
এই উইকেন্ডে সেও ভীষণ ব্যস্ত। অনবরত এয়ারপোর্টে যাওয়া আসা করছে, কাউকে না কাউকে রিসিভ করতে। বাবামা, বোনেরা, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব সবাই আসছে নিউইয়র্কে বিয়ে উপলক্ষে।
শুক্রবারে বিয়ের রেজিস্ট্রেশন, শনিবারে মৌ’দের বাড়ীতে কাজীর উপস্থিতিতে বিয়ে পড়ানো এবং রবিবারে মৌদের পরিবার থেকে রিসেপশন। সিয়ামের পরিবারের রিসেপশন হবে দুই সপ্তাহ পরে ওকল্যান্ডে।
সিয়াম অনুরোধ করেছিলো মৌ যেন লাইসেন্সের দিন সকালে ওরা যে হোটেলে উঠেছে সেখানে আসে, ওর বাবামা’র সাথে দেখা করতে। ওনারা সিয়ামের মুখে মৌ এর কথা অনেক শুনেছেন কিন্তু সামনাসামনি দেখা হবে এই প্রথম।
একই স্টেটে না থাকার কারনে এক বছর ধরে মৌ আর সিয়াম এর ফোনালাপ চলেছে। হয়েছে একে অপর সম্পর্কে জানাশোনা। বিয়ের বেশীর ভাগ প্ল্যানিংই হয়েছে ফোনে ফোনে।
বিয়েতে মৌ কি রং এর শাড়ী পড়তে চায়, কোন ব্র্যান্ডের
প্রসাধনী তার পছন্দ, বিয়ের আংটিতে হীরের সাথে হোয়াইট গোল্ড না ইয়েলো গোল্ড, হানিমুনে
কোথায় যেতে চায় তারা, সংসারটা কি করে সাজাতে চায়, এমন কত কিছু। এক বছর ধরে নিজের মত
করে সময় নিয়ে ওরা একে অপরকে চিনেছে, বিয়ের প্রস্তুতি নিয়েছে।
প্রথম যেদিন দেখা হয়েছিল সেদিন এক মজার কাণ্ড ঘটলো। মৌ চাকুরি করে জাতিসংঘের হেড কোয়ার্টারে। ওর অফিস ম্যানহাটানের ইস্ট সাইডের ৪৬ স্ট্রীটে। মৌ এর অফিসের ছুটির পরে তাদের প্রথম দেখা করার কথা একটা কফি শপে। সেখানে কফি খেয়ে কিছুটা আলাপচারিতা সেড়ে তাদের একটা রেস্টুরেন্টে যাওয়ার কথা ডিনারের জন্যে।
ক্যাফেতে মুখোমুখি বসে প্রথম যখন দু’জন কথা বলতে শুরু করলো, তখন দু’জনেই ছিল ভীষণভাবে নার্ভাস। কিভাবে শুরু করবে, কি জিজ্ঞেস করবে এসব ভাবতে ভাবতে মৌ একসময় কফির কাপ উলটে ফেললো। সেই কফি গড়িয়ে গিয়ে পাশে রাখা ব্যাগ, কাগজপত্র সব ভিজিয়ে দিলো। অনেক মোছামোছি করে ওগুলো শুকালো ঠিকই কিন্তু কফির গন্ধ গেলোনা। কি বিশ্রী সেই গন্ধ।
সেই কথা মনে হলেই মৌ এর হাসি পায়। আর সিয়াম তো সবসময়ই মৌ এর সাথে ঠাট্টা করে যে সিয়ামকে প্রথম দেখে মৌ এতোই প্রেমে দিওয়ানা হয়েছিল, যে তার আশেপাশের দুনিয়াদারির কোনো খেয়ালই ছিলোনা।
এরপর সিয়াম বেশ কয়েকবার নিউইয়র্কে এসেছে মৌ এর সাথে দেখা করতে। মৌ সিয়ামকে নিয়ে নিউইয়র্কের বিভিন্ন টুরিস্ট জায়গায় ঘুরতে গিয়েছে। টাইমস স্কোয়ার, রকাফেলার সেন্টার, এমপায়ার স্টেট বিল্ডিং, স্ট্যাচু অফ লিবার্টি, ম্যাডিসন স্কোয়ার গারডেন, সেন্ট্রাল পার্ক, চায়না টাউন, এমন অনেক আকর্ষনীয় স্থানে।
তাইতো এক বছর ধরে জানাশোনার পর পুরোপুরি নিশ্চিত হয়েই সিয়াম ওর বাবামা’কে মৌ এর কথা বলেছে। ওর বাবামা দেশ থেকে এসে সিয়ামের বাড়ীতেই আছেন। সব কথা শুনে বিয়েতে উনারা মত দিয়েছেন তবে মৌ এর সাথে পরিচয় পর্বটা রাখা ছিল একেবারে বিয়ের সময় নিউইয়র্কে যাওয়ার পরে।
তাই ১লা অগাস্ট সকালে সিয়াম দাওয়াত করেছে মৌ ও তার
পরিবারকে হোটেলে এসে ওদের সাথে ব্রেকফাস্ট করার জন্য।
মৌ ওর হবু শ্বশুরশাশুড়ির সাথে দেখা করতে এসেছে তার বড় দুই আপু, এক দুলাভাই ও খালাতো ভাই রাসেলের সাথে। রাসেল ও সিয়াম আবার পূর্ব পরিচিত। ওরা দুজনই ওকল্যান্ডের বাসিন্দা, পূর্ব চেনা বন্ধু। মৌ ও সিয়ামের কথোপকথন স্টেজে রাসেলই দারুণ ক্যাটালিস্ট এর ভূমিকা পালন করেছে।
আজ যখন ওদের দুজনের দীর্ঘ জানাশোনা একটি স্থায়ী,
পরিপূর্ন সম্পর্কে রূপ নিতে যাচ্ছে, তখন এই মহাশুভ লগনে রাসেল উপস্থিত থাকবেনা তাতো
হতেই পারেনা।
সিয়ামের বাবামা’র সঙ্গে মৌ ও তার পরিবারের আলাপ পরিচয় খুব সুন্দর গতিতেই এগুলো। হাসিহাসি মুখ করে হবু শাশুড়ি তার হবু বৌমার গলায় সোনার লকেট ও কানের দুল পড়িয়ে দিলেন। এটা করে তিনি যেন তাদের পরিবারে মৌ এর আগমনের আরো একটি ধাপ সম্পন্ন করলেন।
মৌ এর দুলাভাই সিয়ামের বাবার সাথে দারুণ আড্ডায় মেতে উঠলেন। সিয়াম মহা
উৎসাহে মৌ এর বড় দুই আপুর সাথে শালীর মত ফাজলামি শুরু করে দিলো। আর সুযোগ পেলেই সে
আড় চোখে মৌ এর দিকে তাকাচ্ছিল আর দেখছিল যে মৌ লাজুক ভঙ্গীতে হাসছে।
বার বার ঘুরে ফিরে একটাই কথাই মৌ এর মনে হতে লাগলো।
কিছুক্ষণ পরেই তাদের দুজনের জীবনের আলাদা আলাদা দুটি পথ এক হয়ে মিলিত হয়ে যাবে। এক
অপারগ সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ জীবনের কথা ভেবে সে বিভোর হতে লাগলো। তবে একটি বারের জন্য
সে জানলোনা যে সামনে অনেকগুলো বাঁধা তাদের এই শুভকাজে বিঘ্ন হয়ে দাঁড়াবে।
ঠিক করা হল, মৌ, সিয়াম ও সিয়ামের বন্ধু তানভীর যে কিনা বিয়ের রেজিসট্রেশন এর সাক্ষী হবে, ওরা তিনজন মেট্রো ট্রেন ধরে ওদের হোটেল থেকে কুইন্স কোর্টের উদ্দেশ্যে রউনা হবে। আর মৌ এর পরিবারের বাকি সদস্যরা গাড়ীতে করে আলাদা ঐ একই জায়গায় আসবে।
হোটেলের নিকটবর্তী ট্রেন স্টেশন থেকে কুইন্স কোর্টের স্টেশন পর্যন্ত,
৭ নম্বর সাবওয়ে লাইনে, পাঁচটি স্টপ।
এগারো বছর ধরে মৌ নিউইয়র্কের বাসিন্দা। মেট্রোরেলে চড়া তার নখদর্পনে। সে ভাবলো সে নিজেই সিয়াম ও তানভীরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে। এটার মত সহজ কাজ আর হতেই পারেনা।
এক এক করে তাদের সেভেন ট্রেন যখন চার নম্বর স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে
এসে দাঁড়ালো, তখন কন্ডাক্টরের কাছ থেকে ঘোষণা এলো যে পরবর্তী স্টেশনে যাওয়ার রাস্তায়
ট্রেনের ট্র্যাকে, কোনো সার্কিট সংক্রান্ত জটিলতায় আগুন লেগেছে। তাই এই ট্রেনটা আর
কোথাও এগুবেনা। এই স্টেশন থেকে আবার পুরানো স্টেশনে ফেরত যাবে।
তড়িঘড়ি করে ওরা তিনজন ট্রেন থেকে নেমে হাঁটা দিলো। এই স্টেশনের পরের স্টেশনটি অর্থাৎ ওদের গন্তব্যস্থল মাত্র দুই ব্লক দূরে। কাজেই হেঁটে কুইন্স কোর্টে পৌঁছানো কোনো সমস্যা নয়।
কাছাকাছি এসে একে, তাকে জিজ্ঞেস করে ওরা সহজেই কোর্ট ভবনে পৌঁছে গেলো এবং যথারীতি একটি লাইনে দাঁড়ালো।
প্রায় তিরিশ মিনিট ধরে লাইনে দাঁড়ানোর সময় তারা লক্ষ্য করলো যে লাইনটি খুব ধীর গতিতে এগুচ্ছে। একটু পর একজন হোমরাচোমড়া গোছের ক্রিষাঙ্গ মহিলা ভেতরের অফিসঘর থেকে বেরিয়ে এসে ঘোষণা দিলো যে তাদের কম্পিউটার সিস্টেম এখন ডাউন। এবং কখন আবার এটা চালু হবে তা তাদের জানা নেই।
তাই সবার অবগতির জন্য
জানানো যাচ্ছে যে কারো যদি কোনো অতি আবশ্যকিয় জরুরী কাজ থাকে যেটা আজকেই সম্পন্ন করতে
হবে তাহলে যেন তারা অনুগ্রহ করে ম্যানহাটানের প্রধান সিটি হলে গিয়ে সম্পন্ন করে।
মৌ ও সিয়াম এর মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। আজকের মধ্যেই তাদের বিয়ের রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করতে হবে। তা করতে না পারলে পরের দিন তাদের ধর্মীয় বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হবে না। আর তা না হলে তার পরের দিন অর্থাৎ রবিবার তাদের রিসেপশন অনুষ্ঠান ক্যান্সেল করতে হবে।
বিয়েতে যোগ দিতে আমেরিকা ও আমেরিকার বাইরে থেকে দুই পক্ষের এতো লোকজন এসেছে, তাদেরকে কি বলা হবে?
আবার ওদিকে রিসেপশন এর পরের দিন ওদের হানিমুন ট্রিপও ঠিক করা আছে। সোমবার দুপুরে মৌ ও সিয়াম এর লাস ভেগাস এর উদ্দেশ্যে রওনা দেয়ার কথা। সেখান থেকে ক্যালিফোর্নিয়ার স্যানফ্রানসিস্কোতে একদিন থেমে সোজা হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ।
মৌ এর বহু দিনের
স্বপ্ন, হাওয়াই যাবার। তাই সিয়াম যখন একদিন জিজ্ঞেস করেছিলো, মৌ হানিমুনে কোথায় যেতে
চায়, মৌ একটুও দেরী করেনি বলতে তার স্বপ্নের কথা। দুজনের মনের মাধুরী মিশিয়ে প্ল্যান
করা এই ট্রিপটাও তাহলে ক্যান্সেল করতে হবে।
মৌ আর সিয়াম দ্রুত ভাবতে থাকলো কি করা যায়। তারা এখান থেকেই ট্রেনে করে ম্যানহ্যাটানের উদ্দেশ্যে রউনা হতে পারে। আর গাড়ীর গ্রুপ তাদের নিজেদের মত করে সিটিতে আসতে পারে। কুইন্স থেকে ম্যানহ্যাটান যেতে গাড়ীতে ট্র্যাফিক জ্যামের কারনে অনেক বেশী সময় লাগে। ট্রেনে করে ওরা তিনজন অনেক আগেই পৌঁছে যেতে পারবে।
প্ল্যান ঠিক হতেই তারা দ্রুত বেরিয়ে পড়লো। এবার ট্রেন পেতে কোনো অসুবিধা হলোনা। কুইন্স থেকে ৭ নম্বর ট্রেন ধরে টাইম স্কোয়ার আর সেখান থেকে এফ ট্রেন নিয়ে সোজা ম্যানহ্যাটানের সিটিহল স্টেশন।
সিটিহল স্টেশনে এসে রাস্তায় বেড়িয়ে মৌ আর সিয়াম যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। এবার দিন শেষ হওয়ার আগে বিয়ে করার লাইসেন্স পাওয়া গেলেই হলো।
সিটিহলে ঢোকার মুখে আবার লাইনে দাঁড়াতে হল। মৌ, সিয়াম আর তানভীর ধৈর্য ধরে লাইনে দাঁড়ালো আর একটু একটু করে লাইন এগুতে লাগলো।
খুব কড়াকড়ি নিয়মে সিকিউরিটি গেইটে তাদের ব্যাগ, আইডি এবং শরীর তল্লাশি করা হল। নাইন-ইলেভেন এর পর থেকে যে কোনো সরকারী ভবনে এই কঠিন ব্যবস্থা চালু ছিল। এরপর এলিভেটরে চেপে পাঁচতলায় পৌঁছে ম্যারেজ ডিভিশনে এসে তারা আবার একটা ছোট লাইনে দাঁড়ালো।
এবার দুরুদুরু বুকে মৌ আর সিয়াম লাইনে অপেক্ষা করছে আর ভাবছে, আর যেন কোনো ঝামেলায় পড়তে না হয়। লাইনে দাঁড়ানোর আগে তারা দুজনে রেজিস্ট্রেশন ফর্ম পূরণ করে নিয়েছে।
কাউন্টারে পৌঁছাতেই অন্য পারে বসা মহিলা হাসি মুখ করে ওদের হাত থেকে ফর্মটা নিয়ে বলল, ‘আর ইয়ু টু গেটিং ম্যারিড? মানি অর্ডার প্লিজ’।
সর্বনাশ, ওরা তো কোনো মানি অর্ডার বানায়নি। ভেবেছে নগদ টাকা প্রদান করবে। তাহলে কি হবে?
ঘড়িতে এখন তিনটা বাজছে। চারটার সময় এই সার্ভিস কাউন্টার বন্ধ হয়ে যাবে।
এখান থেকে বেরিয়ে বিল্ডিং এর বাইরে গিয়ে তিন ব্লক হেঁটে নিকটবর্তী পোস্ট অফিসে পৌঁছে মানি অর্ডার তৈরি করে ফেরত আসতে, এবং পুনরায় আবার সিকিউরিটি লাইনে দাঁড়িয়ে বিল্ডিংএ ঢুকে এই কাউন্টারে পৌঁছাতে, ঘন্টা খানেকের মত সময় লাগবে বা তার বেশীও লাগতে পারে। তাহলে কি আজ আর কাজটা হবেনা?
কেন মৌ এর জন্যই যত ঝামেলা অপেক্ষা করে? এখন পর্যন্ত একটা জিনিসও ঠিক মত ঘটেনি আজকে। কি হবে যদি মৌ আর সিয়াম আজ রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করতে না পারে। এতো সব ভাবতেই মৌ এর মাথা ঘুরতে লাগলো।
মনের মধ্যে অনেক চিন্তা এসে ভিড়
করতে লাগলো। তবে কি বিধাতা চাইছেন না যে মৌ আর সিয়ামের বিয়ে হোক? এতোগুলো বাঁধা কি
কোনো অশুভ ঘটনার আলামত?
এমন সময় বন্ধু তানভীর বীরদর্পে এগিয়ে এসে বলল যে কোনো ভয় নেই। সে নিজে গিয়ে মানি অর্ডার বানিয়ে নিয়ে আসবে। মৌ আর সিয়াম যেন এখানেই অপেক্ষা করে।
এই বলেই তানভীর দ্রুত বেরিয়ে গেলো। মৌ আর সিয়াম একে অপরের দিকে অসহায়ের মত তাকিয়ে রইলো।
বিশ মিনিটের মাথায় আশ্চর্যজনক ভাবে তানভীর এসে উপস্থিত। তার হাতে পয়ত্রিশ ডলারের মানি অর্ডার। ঠিক বিয়ে করতে যা লাগবে।
চোয়াল বিস্তৃত বিশাল হাসি হেসে সে সিয়ামের দিকে তাকিয়ে বলল, 'নে এবার তোরা বিয়ে করে ফেল্। আর কোন ঝামেলা নেই'।
মৌ এর মুখ থেকে অজান্তেই বেরিয়ে
এলো, 'এতো তাড়াতাড়ি, কি করে সম্ভব'?
আর কোনো রকম বিপত্তি ছাড়াই ওদের বিয়ের রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন হল। মৌ ও সিয়াম পেলো বিয়ে করার লাইসেন্স।
ইতিমধ্যে গাড়ীর গ্রুপও এসে পড়েছে। ওরা কুইন্স থেকে ম্যানহ্যাটান আসতে গিয়ে রাস্তা হারিয়ে ফেলেছিল। বহু কষ্টে ট্রাফিক পুলিশ ও রাস্তায় পথচারীদের সাহায্য নিয়ে ডাউন টাউনের সিটিহল খুঁজে বের করেছে। এসে তারা মৌ এর কাছ থেকে বাকি ঘটনা শুনলো।
সব কাজ সম্পন্ন করে সবাই সিটি হলের বাইরে এসে দাঁড়িয়ে ছবি তুলল। এই
স্মরণীয় দিনটির কথা তারা মনে রাখবে আজীবন। বিশেষ করে মৌ আর সিয়াম।
দুটি সন্তান নিয়ে মৌ আর সিয়াম আজ সুখে সংসার করছে। ফেলে আসা নিউইয়র্কের দিনগুলোর কথা মৌ এর ভীষণ মনে পড়ে। আর যেদিন বিকেলে ওরা দু’জন মগ ভর্তি চা নিয়ে সাগর পাড়ে আসে আর সমুদ্রের পানিতে সূর্যাস্ত দেখে মুগ্ধ হয়, সেদিনও মৌ তার মনের গভীরে চেপে রাখা এক প্রশ্নের অজানা উত্তর খুঁজে।
১লা অগাস্টের সেই দিনটিতে ঘটা ওগুলো কি ছিল নিছক কাকতালীয় ঘটনা, নাকি ওদের দুজনের মিলনের পথে ছিলো প্রকৃতির কোনো গোপন বাঁধা, দুরভিসন্ধি?
সে কথা কোনো দিন আর জানবেনা মৌটুসি।
Comments
Post a Comment