আমেরিকান মার্কার

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৪ জুলাই স্বাধীনতা দিবস পালন করা হয়। এটি আমেরিকান হলিডের সবচাইতে জনপ্রিয় এবং সমাদৃত সরকারী ছুটির দিবস। এই দিনটিতে আমেরিকায় ও এর বাইরে বসবাসকারী সকল নাগরিক জাতিগত ভাবে একাত্মতা অনুভব করে। এই দিনটিতে তারা পরিবার ও বন্ধুবান্ধব নিয়ে আনন্দ ফুর্তি করে। আমেরিকার বিভিন্ন শহরে ফায়ার ওয়ার্কস উদযাপিত হয়। ৪ জুলাই দিনটি বরাবর গ্রীষ্মকালিন ছুটির মধ্যে পড়ে এবং তার ফলে অনেক আমেরিকানরা এই ছুটির সাথে সপ্তাহন্ত লাগিয়ে সপরিবারে লং উইকেন্ড উপভোগ করে অথবা শহরের বাইরে বা অন্য কোন দেশে বেড়াতে চলে যায়। অনেক পরিবারের জন্য এটি চিরাচরিত বাৎসরিক প্র্যাকটিস। 

তবে মজার ব্যাপার হল, ১৭৭৬ সালের  ৪ জুলাই নয় বরং এর দুদিন আগে ২ জুলাই কন্টিনেন্টাল কংগ্রেস স্বাধীনতা ঘোষণার সিদ্ধান্ত নেয়। তার ও এক মাস আগে জুন মাসে টমাস জেফারসন স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য এর খসড়া লেখা শুরু করেন। আর এর এক মাস পরে ২ আগস্ট সরকারী ভাবে ঘোষণা পত্রে সই করা হয়। তাহলে ৪ জুলাই দিনটি এমন তাৎপর্য পেয়েছিল কেন? ২ জুলাই সেই খসড়া লেখার পর তার প্রতিটি শব্দ, অক্ষর ও বাক্য পরবর্তী দুই দিন ধরে সম্পাদনা করা হয়। অবশেষে ৪ জুলাই আমেরিকান কংগ্রেস সেই সংশোধিত ও পরিমার্জিত খসড়াটি সঠিক ও চূড়ান্ত বলে অনুমোদন করে। তাই এই দিনটিকে 'ডিক্লেরেশন অফ ইন্ডিপেন্ডেন্সের' মধ্যেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তবে এটি সরকারী ছুটির দিন হিসেবে পালিত হতে আরো সময় লেগে যায়। 

ডিক্লেরেশন লেখার পরবর্তী ১৫ থেকে ২০ বছর শুধু স্বাধীনতা দিবস কেন, আনুষ্ঠানিক ভাবে একটিও বিশেষ দিন পালিত হয় নাই। তখন রাষ্ট্র ছিল সম্পূর্ণ নতুন। নানা রকম দলাদলি ও মতবিরোধে ভরপুর। এমনকি ডিক্লেরেশন লেখা নিয়েও অনেক প্রশ্ন উঠেছিল, তর্কবিতর্ক হয়েছিল। তবে এই অবস্থা বেশীদিন স্থায়ী হয়নি। ১৮১২ সালের যুদ্ধের পর ফেডারেলিস্ট পার্টি ভাঙ্গতে শুরু করে এবং যেসব নতুন পার্টিগুলো গঠিত হয় তারা নিজেদের টমাস জেফারসনের উত্তরসূরি হিসেবে ভাবতে শুরু করে। ফলশ্রুতিতে, আবার নতুন উদ্যমে ডিক্লেরেশন অফ ইন্ডিপেন্ডেন্স ছাপা এবং সর্বত্র বিলি করা শুরু হয়। প্রতিটা ছাপা কাগজের শিরোনামে ৪ জুলাই ১৭৭৬ উল্লেখ করা হয়। এছাড়াও আমেরিকার দুইজন প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসন এবং জন অ্যাডামস একই দিনে ১৮২৬ সালের ৪ জুলাই মৃত্যু বরণ করেন। সব মিলিয়ে ৪ জুলাই সবার কাছে একটি স্মরণীয় ও গ্রহণযোগ্য বিশেষ দিন হিসেবে গৃহীত হয় এবং সেটা বেসরকারি ভাবে উদযাপিত হতে থাকে। ১৮৭০ সালে কংগ্রেস ৪ জুলাইকে জাতীয় ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা দিয়ে একটি বিল পাস করে।

আমেরিকার স্বাধীনতার ইতিহাস নিয়ে অনেক লেখালেখি হলো। এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি যদিও এটা আমেরিকানদের ব্যাপারেই। সেদিন একটা আর্টিকেল পড়ছিলাম। কিভাবে এক সমুদ্র মানুষের মধ্যে আমেরিকায় থাকা মানুষদের বিশেষ ভাবে আলাদা করে চিহ্নিত করা যায়। সবাই জানে যে আমেরিকানদের বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। যার ফলে, দুনিয়ার যে প্রান্তেই যাক না কেন, তাদের বিশেষ বৈশিষ্ট্যই বলে দেয় যে তারা মার্কিন মূলকের বাসিন্দা। তাদের স্বভাব, আচার আচরণ, কথাবার্তার ধরণ এতোটাই মার্কিনী যে তাদেরকে চিনতে খুব বেশী বেগ পেতে হয়না। যারা জন্মসূত্রে আমেরিকান তারা যেমন এই থিওরিতে পরে, তেমনি আমরা যারা বহু দশক ধরে এই দেশে বাস করছি, আমরাও কোনো না কোনো ভাবে এই মার্কারগুলো কমবেশী বহন করি। 

এই অভিজ্ঞতা আমার বেশ কয়েকবার হয়েছে। পরিবার নিয়ে ছুটিতে কোন দেশে বেড়াতে গিয়েছি এবং হয়তো কোনো টুরিস্টি স্পটে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছি টিকেট কাটার জন্য বা দর্শনস্থলের ভিতরে ঢোকার জন্যে। ঠিক তখনই লাইনের দিকে তাকিয়ে দিব্যি বলে দিতে পেড়েছি যে লাইনে দাঁড়ানো কোন কোন পরিবারগুলো আমেরিকা থেকে এসেছে। তাদের কথাবার্তা, আচরণ, কাপড়চোপড়, পারস্পরিক মন্তব্য সবকিছু একবাক্যে জানান দিয়েছে যে তারা সুদূর আমেরিকা থেকে আগত। কৌতূহল দেখিয়ে যখন তাদের সাথে আলাপ জুড়ে দিয়েছি তখন দেখেছি যে আমার ধারণা একদম ঠিক। 

আমার পড়া আর্টিকেলটিতে এমনই কিছু মার্কারের কথা বলা হয়েছিল যেটা দেখে চেনা যাবে কারা আমেরিকান। 

- এরা অতিরিক্ত উচ্চস্মরে কথা বলে এবং হাতপা নাড়িয়ে, চোখ ঘুরিয়ে, তাদের মনের জোরালো অভিব্যাক্তি প্রকাশ করে।   

- ভিনদেশে গিয়ে পাবলিক প্লেসে অজানা, অচেনা মানুষদের দিকে তাকিয়ে এরা এমন একটা হাসি দেয় যে যেন কত দিনের চেনা। আবার এটাও আশা করে যে ওই জায়গার সবাই ইংরেজিতে কথা বলতে পারবে। 

- কারো সাথে নতুন পরিচয় হয়ে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই অকপটে এরা জানিয়ে দেয় যে আমেরিকায় কোন শহরে তাদের জন্ম এবং কোন শহরে তারা থাকে। 

- আমেরিকান খাদ্যাভ্যাসের কথা কে না জানে। রেস্টুরেন্টে গিয়ে বিশাল বড় বা মেগা সাইজের খাবারের আইটেম তারা মেনু থেকে অর্ডার করে এবং সেটা শেষ করতে না পারলে 'টু গো' বক্স বা 'ডগি ব্যাগের' সহায়তায় বাড়ি নিয়ে যায়। এরা তাদের পানীয় বা ড্রিংকে অতিরিক্ত বরফ যুক্ত করে থাকে এবং আশা করে যে শেষ হলে ওগুলোর ফ্রি রিফিল করতে পারবে। 

- রেস্টুরেন্টে সাধারনত এরা মোটা অংকের টিপ দিয়ে এদের দরাজ দিলের পরিচয় দিয়ে থাকে। 

- এদের কাপড়চোপড়ও বলে দেয় যে এরা আমেরিকান। যেই ঋতুতে বা আবহাওয়ায় এরা থাকুক না কেনো, বেড়াতে গিয়ে যে কোনো জায়গায় এরা হাওয়াইয়ান শার্টের সাথে কার্গো শর্টস পড়ে, এবং সেই সাথে বেইসবল হ্যাট এবং কাঁধে একটা বড় ব্যাক প্যাক নিয়ে ঘুরাঘুরি করে। 

- সারা পৃথিবীতে যে খেলাটিকে ফুটবল ডাকা হয়, আমেরিকানরা নির্দিধায় সেই খেলাটিকে 'সকার' ডাকে। আর ফুটবল বলতে এরা একটি ভিন্ন খেলাকে বোঝায়। আমেরিকায় কলেজ ফুটবল খুব জনপ্রিয় একটি ব্যাপার এবং যে যেই কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েট করেছে সে সাধারণত সেই ফুটবল টিমকে সাপোর্ট করে। তাই নিজেদের কলেজ ফুটবল টিম নিয়ে আলাপচারিতা এদের জন্য খুব প্রিয় একটি ব্যাপার।

- কথায় কথায় ক্রেডিট কার্ড চার্জ করে জিনিস কেনা বা খাবার কেনা এদের জন্য খুব সাধারণ একটি ব্যাপার।বেড়াতে গিয়ে বিল পরিশোধের ব্যাপারটি খুব বেশী করে এরা মাথায় আনে না। 

- এরা তারিখ লেখে মাস/দিন/বছর এই ফরম্যাটে যেটা অন্যান্য দেশীদের কাছে খুবই গোলমেলে হতে পারে।

- এরা বহু দিনের পুরানো ব্রিটিশ ইম্পেরিয়াল সিস্টেমে অভ্যস্ত এবং মেট্রিক সিস্টেম শিখতে খুবই নারাজ। তাই সব সময় দোকানে গিয়ে সবকিছু পাউন্ড, টন, ইঞ্চি, ফারেনহাইট এ রুপান্তর করে থাকে। 

- কোনো ব্যাপারে রাজী হলে বা কোনো কিছুতে খুশী হলে এরা বৃদ্ধাঙ্গুলি উঁচিয়ে 'থাম্বস আপ' প্রদর্শন করে। 

- যেখানে রাত সেখানেই কাত, এমন একটা প্রবাদ বাক্য আমাদের দেশে প্রচলিত আছে। বলা হয়ে থাকে, আমেরিকানরা কোনো নতুন জায়গায় গিয়ে খুব সহজেই নিজেদের অভ্যস্ত করে ফেলে। এটি এদের একটি বিশেষ গুণ। ইউরোপ, এশিয়া, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, যে কোনো মহাদেশ বা দেশের সংস্কৃতি, ভাষা, পরিবেশ, খাদ্যাভাসে, এরা খুব সহজেই নিজেদের রপ্ত করে ফেলে এবং এদের অর্জনকৃত নতুন অভিজ্ঞতাকে সাদরে বরণ করে নেয়।

লেখাটিতে আরো অনেক অনেক আমেরিকানদের খেয়াল বা পার্থক্যের কথা উল্লেখ ছিল। আমি কিছু বেসিক বা  প্রধান বৈশিষ্ট্যের কথা বললাম। এমন কিছু বৈশিষ্ট্য যেগুলো খুব সহজেই চোখে পড়ে। আশেপাশের পরিচিত মানুষগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়। তবে এমন না যে সবাই এক রকম হবে। তবুও কোথাও যেন একটা প্রচ্ছন্ন মিল থাকে যেটা দিয়ে সব আমেরিকানদের অন্যান্য দেশী মানুষদের থেকে আলাদা করা যায়। এরপর কোথাও বেড়াতে গিয়ে দেখুনতো, মার্কিন দেশের মানুষগুলোকে চিনতে পারেন কিনা।  

আমেরিকার ২৪৮তম স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা জানাই সকলকে ~~    

Comments

  1. Thank you for choosing to write on this topic. I feel enlightened by this informative piece of writing

    ReplyDelete
  2. অসাধারণ হয়েছে লেখাটা! আমেরিকানদের চেনার সময় এসব জিনিস লক্ষ্য করব ভবিষ্যতে।

    ReplyDelete

Post a Comment