কেমন আছেন মা
মা কথাটি ছোট্ট অতি, কিন্তু জেনো ভাই
ইহার চেয়ে নামটি মধুর তিন ভুবনে নাই। (কাজী কাদের নেওয়াজ)
ইহার চেয়ে নামটি মধুর তিন ভুবনে নাই। (কাজী কাদের নেওয়াজ)
একটি ছোট্ট শব্দ 'মা'। এরই মাঝে লুকিয়ে আছে জাগতিক মায়া, মমতা, স্নেহ, ভালোবাসা আর আদর ভরা শাসনের মধুর সুধা। মানুষ এই পৃথিবীতে জন্মিয়ে প্রথম যে মানুষটির সান্নিধ্য লাভ করে সেই মানুষটি তার মা। দুনিয়ায় মায়ের চাইতে বড় আর কেউ নেই। জীবনের নানান দুঃখ, কষ্ট, হতাশা, ব্যর্থতার সময়ে মায়ের কথাই সবার মনে পড়ে। সন্তানের কাছে মায়ের কোল সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়। সন্তান যত বড় হোক না কেনো, মায়ের চোখে সেই শিশুই থাকে। আবার জীবনের সকল হাসি, কান্না, আনন্দ, বেদনার মাঝে মা তার সন্তানকেই খুঁজে ফিরে। সন্তানের জন্যে মায়ের আবেগ অনন্ত কালের।
আগেকার সময়ে মা বলতেই, একজন স্নেহময়ী, মমতাময়ী, বহু গুনের আধার, সংসারের কাজে পটু, ধীরস্থির, পাকা গৃহিণীর মুখ মনে পড়ত। যিনি বাইরের দুনিয়াতে পা রাখুক আর না রাখুক, নিজের ঘর সংসারকে সামলে রেখেছেন এক হাতে, সুনিপুণ ভাবে। বাড়ির প্রতিটি ব্যাপারে তিনি নিজ মুখে হয়তো তার মতামত জানিয়েছেন, হয়তো বা না। সংসারের প্রতিটি সদস্য যে কোন সিদ্ধান্তের ব্যাপারে তার মতামত নিক বা না নিক, প্রচ্ছন্ন ভাবে তারা মায়ের মতামতের উপরই নির্ভর করেছে। এমনকি বাড়ির একরোখা, অসম্ভব রাগী বাবাও কোনো এক দুর্বল মূহুর্তে মায়ের সাথে আলাপ আলোচনা সেরেছে কি করা যায়। মা যেন এক দূর্নিবার চুম্বক শক্তি। পরিবারের সকলে ঘুরে ফিরে তার কাছেই বার বার ফিরে এসেছে। স্নেহ, মমতা, আদর, ভালোবাসা থেকে শুরু করে যত্ন আত্তি, সেবা শুশ্রূষা, আতিথিয়তা, অশেষ সহযোগিতা, অনন্ত শুকামনা, সবই আসে সেই মায়ের কাছ থেকে।
বর্তমান যুগে মা’দের দৃষ্টিভঙ্গি যেমন পাল্টেছে, তেমনি পাল্টেছে তার প্রতিচ্ছবি। বর্তমান সময়ে মা বলতে ঘরে বাইরে সমান পারদর্শী, বাক স্বাধীনতায় বিশ্বাসী, স্বাধীনচেতা, স্বাবলম্বী নারীর চেহারা চোখের সামনে ভেসে উঠে। বর্তমান সময়ের মা’রা পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতার প্রতি বিশেষ ভাবে নজর দেন। সংসারের আয় উন্নতির ব্যপারে স্বামীর পাশাপাশি নিজেরাও অবদান রাখেন। বিয়ের পরও বাবামা ও ছোট ভাই বোনদের আর্থিক ভাবে সাহায্য করেন। এই সময়ের মা’রা সন্তান লালন পালনের ক্ষেত্রে মতামত দেন। সন্তানের বাবার সাথে বনিবনা না হলে নিজের আলাদা জীবন ও জগত গঠনের ক্ষেত্রে মনযোগী হন। অনেক সংসারে একা মা’ই চাকুরী করে সংসার চালিয়ে যান।
এই একবিংশ শতাব্দীতে, নারী স্বাধীনতা এবং নারী অগ্রায়ন নারীদের মা সত্ত্বাকে ভিন্ন ভাবে উপস্থাপন করছে। একজন মা শুধু সন্তান জন্ম দিয়ে বা সন্তানকে বড় করেই থেমে থাকছেন না। তিনি ঘরে বাইরে সমান তালে এগিয়ে চলছেন। দেশ ও দশের উন্নয়নে, সমাজ পরিবর্তনে তার অমূল্য অবদান রাখছেন। রাস্তার পাশে ইটভাঙ্গা দিন মজুর থেকে শুরু করে, গার্মেন্টস কর্মী, হস্তশিল্প, চাষবাস, এমনকি নিজের ছোট ব্যবসা পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত আছে আমাদের গ্রামগঞ্জের মা’রা। শহুরে জীবনে শিক্ষকতা থেকে শুরু করে কর্পোরেট সি ই ও, ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার থেকে শুরু করে ফ্যাশন মডেল এমন বহু ধারার পেশায় সর্বত্রই মা’দের আনাগোনা। মা দায়িত্ব থেকে ছুটি নিয়ে নয়, এই কাজগুলো তারা মা হয়েই করছেন।
বর্তমান সময়ের মা’রা প্রযুক্তি ব্যবহারেও পিছিয়ে নেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তারা দারুণ ভাবে সোচ্চার। দৈনন্দিন জীবনযাপন প্রণালী, সামাজিক সচেতনতা, দাম্পত্য সম্পর্ক, সন্তান লালন পালন, বিনোদন, এমন বহুবিধ বিষয়ে তাদের নিজস্ব বার্তা, সুচিন্তিত মতামত ও স্বার্থহীন পরামর্শ পৃথিবীর মানুষের ভাণ্ডারে পৌঁছে দিচ্ছেন। এই প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে দেশে বিদেশে বহু মা’রা পোশাক আশাক, অলংকার ও গৃহ সামগ্রীর অনলাইন ব্যবসা করছেন। ঘরকন্না, শিল্প সংস্কৃতিতে তাদের মেধা ও মননের বিকাশ ঘটাচ্ছেন। ব্লগার, ইউটুবার, টিক টকার, সামাজিক ইনফ্লুএন্সার, নারী উদ্যোক্তা, অ্যাকটিভিস্ট, আমাদের মা'দের এখন অনেক রূপ। মা দায়িত্ব থেকে ছুটি নিয়ে নয়, এই কাজগুলো তারা মা হয়েই করছেন। সফল ও সার্থক মাদের নিয়ে এখন মেধা ও সুন্দরী প্রতিযোগিতাও হয়।
আমেরিকায় প্রতি বছর মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার বিশাল করে মা’ দিবস পালন করা হয়। এই একটি দিনে,সবচেয়ে ব্যস্ত মানুষটিও কাজ ফেলে তার মা’র কথা স্মরণ করে। ফুল, কার্ড, কেক, চকোলেট, শুভেচ্ছে বার্তা, অথবা নিজেই হাজির হয়ে মা’কে তার পছন্দের জায়গায় খেতে নেয়া বা পছন্দের জিনিশটা কিনে দেয়া, এগুলো এ দেশের খুব প্রচলিত নিয়ম। মা'রা তাদের মন প্রাণ উজার করে এই দিনে তাদের প্রতি দেয়া বিশেষ মনোযোগ উপভোগ করেন। শুনেছি আমাদের দেশেও মা’ দিবস এর দিনটি বিশেষ তাৎপর্য পায়। মা’কে নিয়ে পারিবারিক আনন্দ, উৎসব এর মধ্য দিয়ে ঘটা করে পালন করা হয়। স্কুল, কলেজে কবিতা আবৃত্তি, রচনা ও চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা হয়। মানুষের জীবনে তাদের মায়ের অপরিসীম অবদানের কথা গুরুত্ব সহকারে আলোচনা করা হয়।
অনেকে মা দিবস পালনের ক্ষেত্রে বিশাল আপত্তি তুলে। কেন ঘটা করে শুধু একটি দিনে মা’দের কথা স্মরণ করা হবে যেখানে প্রতিদিনই মা’দের নিয়ে ভাবা উচিত, তাদের প্রতি মনোযোগী হওয়া উচিত, এমন কিছু যুক্তি তাদের পক্ষে আছে। তাদের কথা অবশ্যই গুরুত্ব বহন করে। তবে আমার ভাবনাটা একটু অন্য রকম।
আমাদের পৃথিবীটা খুব জোরে দৌড়ুচ্ছে। এই দৌড়ানো প্রতিযোগিতায় পৃথিবীর মানুষগুলো সবাই সামিল। সবাই খুব ব্যস্ত, নিজের চিন্তায় মগ্ন। এই ব্যস্ত সময়ে প্রতিদিন নিজেকে বাদ দিয়ে কেউ অন্য কাউকে নিয়ে ভাবেনা। তা সে হোক মাবাবা, ভাই বোন, বন্ধুবান্ধবী বা বিশেষ কেউ। তাই ঘটা করে একটি বিশেষ দিন নির্ধারন করে যদি আমরা মা’দের কথা স্মরণ করি, তাদের আনন্দ দেই, অথবা মা হয়ে আনন্দ পাই, তাতে ক্ষতি কি? এই মনোযোগটুকু আমরা ছাড়বো কেন? মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হতে কার না ভালো লাগে। হয়তো মা হিসেবে সন্তানের প্রতি আমাদের অবদান অনেক অনেক বেশী। কিন্তু চাওয়া পাওয়ার হিসাব কি সবসময় সমান হয়?
মা খুব ছোট্ট একটা শব্দ কিন্তু এর গভীরতা, এর বিশালতা, এর প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা অসীম। তাই মায়ের প্রতি আমাদের ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা হওয়া উচিত অসীম থেকে অসীমতর। সন্তান জন্মের প্রসব বেদনা জানেন একমাত্র তিনিই।
প্রতিটি নারীর মধ্যে একটি ‘মা’ সত্তা বিরাজমান। সৃষ্টিকর্তা আমাদের এভাবেই তৈরি করেছেন। এমনকি আমাদের প্রিয় ধরিত্রীকেও সুজলা, সুফলা, আবাদি নারী(মা) হিসেবে কল্পনা করা হয়। যারা মা হতে যাচ্ছেন, যারা মা হতে পেরেছেন, অথবা কোনো কারনে যারা মা হতে পারেননি - এই মা দিবসে কাছে দূরে সকলের প্রতি আমার অফুরান ভালোবাসা ও শুভকামনা।
আমি আপনার এই লেখাটা পড়ে সত্যিই মুগ্ধ। আপনার প্রতিটা প্রজন্মের মায়েদের নিয়ে চিন্তাধারা বিশেষভাবে প্রশংসার দাবিদার। বিশ্বের সব মায়েদেরকে জানাই বিলম্বিত শুভ মা দিবস।
ReplyDeleteInteresting piece on Mother's day. Wish the entire world would celebrate in one particular day
ReplyDeleteTomar lekhata khub bhalo legeche. Thank you for sharing.
ReplyDeleteখুব সুন্দর লিখেছো। তোমার লেখার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল যে তুমি একাধিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ কর। তারপর পাঠকরা যা বেছে নেওয়ার নেয় বা নিজের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে। এতে লেখক এবং পাঠক দুজনেরই স্বাধীনতা থাকে।
ReplyDelete