কেমন হবে ওদের ঈদ


ঈদ মানেই একটা অন্য রকম ভালো লাগা। নতুন জামা, নতুন জুতো, ঘর সাজানোর জিনিস, হরেক রকম খাবার, আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া, পার্ক, রেস্তোরা, চিড়িয়াখানা ভ্রমণ, বাড়িতে অতিথিদের সরগরম, সর্বোপরি নিজ পরিবারের সাথে একত্রিত হয়ে খাওয়াদাওয়া আনন্দ, সিনেমা দেখা, সুন্দর একটা সময় কাটানো। ছোটবেলা থেকে বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত এই রকমই আমরা দেখে এসেছি। কি দেশে, কি বিদেশে , ঈদ আমরা পালন করি মনে অনেক আনন্দ ও উদ্দীপনা নিয়ে। ঈদ আমরা পালন করি সবার সাথে একাত্মতা অনুভব করে।

কিন্তু এমনটা না হয়ে যদি অন্য রকম হয়। ঈদ এর আনন্দ যদি হারিয়ে যায় মৃত লাশ আর ধ্বংসস্তুপের মাঝখানে। চারিপাশের পরিবেশটা যদি হয়ে যায় মৃত্যুপুরি। আর্তনাদ আর আহাজারিতে ভরা। সারি সারি লাশের মাঝে যদি মানুষ খুঁজে বেড়ায় তাদের মাবাবা, ভাই বোন, স্বামী স্ত্রী সন্তান। এমনটা ভাবতেই গায়ের মধ্যে কাঁটা দিয়ে উঠে। গিলতে গেলে গলার ভেতর খাবার আটকে যায়। এমন ঈদতো আমি দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারিনা। অথচ বাস্তবে এমনটা হতে চলেছে।

প্যালেস্টাইনের গাজা উপত্যকায় যে ধ্বংসযজ্ঞ চলছে, মুসলমান নিধনের প্রক্রিয়া চলছে, সারা দুনিয়া সেটা দেখে হতভম্ব, তাজ্জব, বিস্মিত। টিভিতে, খবরের কাগজে, সোশ্যাল মিডিয়াতে খবরগুলো পড়ে এবং ছবি ও ভিডিও ফুটেজ দেখে চোখের পানি আটকে রাখা যাচ্ছেনা। নিষ্পাপ, নিরপরাধ শিশুদের কান্না ও কষ্ট আর সহ্য করা যাচ্ছেনা। যে কোনো বিবেক সম্পন্ন মানুষের হৃদয় বিচলিত না হয়ে পারছেনা।  একবিংশ শতাব্দীতে বসে এটা কি করে সম্ভব? পৃথিবীর সবচাইতে উন্নত আর শক্তিশালী দেশ কেন চুপ করে বসে আছে? তাদের আয়ত্তের ভেতর এই যুদ্ধকে থামানো কোনো ব্যাপারই না। তবুও তারা নিশ্চুপ।

পৃথিবীর সবচাইতে শক্তিশালী দেশে আমি বসে আছি। গত সাত মাস ধরে এই যুদ্ধ দেখছি। দিনের পর দিন দেখে চলেছি  কেমন করে বড় বড় প্রভাবশালী দেশগুলো ও তাদের নেতারা মিটিং, আলোচনা, আর জরুরী কার্যক্রম বাতলাচ্ছে। তবুও যুদ্ধ থামছে না। অথবা তারা থামাতে চাইছে না। যুদ্ধ বন্ধের কোনো কথা তাদের মধ্যে এগুচ্ছেনা। এই যুদ্ধে কে ঠিক, আর কে বেঠিক সেটি আমার লেখার উদ্দেশ্য নয়। কে যুদ্ধ আগে শুরু করেছে আর কে পরে, সেটা নিয়েও আমি কিছু বলবো না।  কোনো রাজনৈতিক আলোচনা আমার লেখার প্রতিপাদ্য নয়।

আমি শুধু লিখতে চেয়েছি, গাজা উপত্যকার ঐ মানুষগুলো যারা এখনো বেঁচে আছে, তাদের ঈদটা কেমন হবে। আমি নিজেও জানিনা তাদের ঈদটা কেমন হবে। মনে মনে ভাবতে চেষ্টা করছি, মহান আল্লাহ্‌তালার দরবারে হাত তুলে তাদের ঈদ এর দোয়াটা কেমন হবে। একই পৃথিবীতে বসে আমাদের বাচ্চারা ঈদ এর দিন নতুন কাপড় পড়বে, ঈদ এর জামাতে শরীক হয়ে কোলাকুলি করবে, বাড়িতে বিশেষ খাবার খাবে। আর ঐ বাচ্চা গুলো কেঁদে কেঁদে ফিরবে তাদের মাবাবাকে খুঁজে, একটু খাবারের অন্বেষণে, একটু নিরাপত্তা আর আশ্রয়ের তাগিদে। 

মার্কিন সেনাবাহিনীর ত্রান তৎপরতা অব্যাহত আছে। ওদের হেলিকপ্টারগুলি যখন আকাশ থেকে বাক্সে ভরা খাদ্য, পানীয় ও চিকিৎসা সামগ্রী ড্রপ করে,  বাচ্চাগুলো দৌড়ে সেগুলো ধরার চেষ্টা করে। ঐ বাচ্চাগুলো অদৃশ্য এক প্রতিযোগিতায় সামিল হয়ে কে কার আগে পৌঁছাবে, সেই চেষ্টায় মত্ত থাকে। যারা প্রাণপণে দৌড়ে লক্ষ্যস্থলে পৌঁছুতে পারে, তারা ত্রানের বাক্স বা বস্তা হাতে পায়। আর সেই আনন্দ, আমাদের সাজানো ড্রইং রুমে বসে ঈদ এর সেমাই খাওয়ার আনন্দের চাইতে অনেক বেশী। যখন মানুষের অস্তিত্বই বিলীন হওয়ার পথে যায়, তখন ধর্মীয় রীতিনীতি বা ধর্মীয় উৎসব পালনের উচ্ছাস ফিকে হয়ে যায়। 

গাজা উপত্যকার  শতকরা আশি ভাগ জনসংখ্যা অর্থাৎ প্রায় আড়াই মিলিয়ন মানুষ এখন উদ্বাস্তু। দূর্ভিক্ষ ওদের দোরগোড়ায় এসে উপস্থিত, উঁকিঝুঁকি করছে। ক্ষুধা নিবারণের জন্য ওরা মাঠের ঘাস, আগাছা সেদ্ধ করে খাচ্ছে।  অথবা পশু পাখির খাদ্য পরিবারের সবার সাথে ভাগযোগ করছে। ক্যানের খাবার পাওয়া গেলেও বাজারে চড়া মূল্যে সেগুলো বিক্রি হচ্ছে। যা সবার পক্ষে কেনা সম্ভব নয়। ইট, পাথর, কংক্রিট আর হাড়, খুলির ধ্বংসস্তুপের পাশে বসেই তারা নামায পড়ছে। এ যেন প্রতিদিন কার বাস্তবতা। এ যেন ওদের অমোঘ নিয়তি।

সারা পৃথিবীর মুসলিম জনগোষ্ঠী এক হয়ে ওদের জন্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে। অর্থ, সেবা, প্রার্থনা দিয়ে চলেছে। বিশ্বের মানবাধিকার সংস্থাগুলো এবং তাদের ত্রান কর্মীরা অবিরাম কাজ করে চলেছে। তবে অসহায় মানুষগুলোর কাছাকাছি পৌঁছুতে এখনো অনেক সময় বাকি। আমেরিকাবাসী মুসলিম ও আরব জনগোষ্ঠীর লোকেরা এবার কোনো ঘটা করে রমজান বা ঈদ পালনের প্রস্তুতি নিচ্ছেনা। ঈদ উপলক্ষে বাহারি পোশাক বা নিত্য ব্যবহার্য জিনিস কেনার প্রতি তাদের কোনো ঝোঁক নেই। কেউ কেউ পুরা রমজান মাসে একবার ও কোন ইফতার পার্টিতে সামিল হয়নি। শুনেছি আমাদের বাংলাদেশে, ছোটো ছোটো স্কুলের শিশুরা তাদের টিফিনের টাকা থেকে বাঁচিয়ে ফিলিস্তানিদের সাহায্যে দান করছে। আহা, শিশুদের জন্য শিশুদের কি মায়া, কি উদারতা। এটাই বুঝি প্রকৃত ঈদ।      

ঐসব মানুষগুলোর চোখে, মুখে ঈদ এর কোনো আনন্দ নেই। নেই উৎসব পালনের ঘনঘটা। নিজের দেশে বড় হওয়ার অধিকার নেই ওদের। নেই জীবনকে গড়ে তোলার নিশ্চয়তা। আমাদের মুসলমানদের সবচেয়ে প্রিয় আনন্দের উৎসব ঈদ এর অর্থ ওদের কাছে হবে আলাদা। হয়তো ওদের ঈদটা হবে শুধু নামে মাত্র। ঈদ এর দিন সকালে ওরা নামায পরে ভাববে, আমি আর কত দিন বাঁচবো? আমার পরিবারকে কি আমি আর কোনো দিন দেখতে পাবো? 

ইতিহাস কি বদলে দেবে তার বিবরণ? সময় কি পাল্টে দেবে তার ফলাফল? ওদের ঈদ হবে ক্ষুধা, গুলি আর বোমা হামলাকে সাথী করে।       

Comments

  1. Excellent Writting.Very Heart touching
    Be blessed.

    ReplyDelete
  2. Profound and thought provoking

    ReplyDelete
  3. Beautiful reflection on Eid, how starvation is being used as a weapon to destroy humanity in this new world

    ReplyDelete
  4. It's tax season in the US. Sickening to realize that muted media created an apathetic yet unwilling people to have their government spend their hard earned tax dollars to supply the bombs, bullets, tanks that are used to conduct this slaughter.

    ReplyDelete

Post a Comment