ম্যাজিক নাম্বার ১৮

ওরা বলে, ১৮ একটা ম্যাজিক নাম্বার বয়স যখন ১৮তে পরে, তখন এদেশের নাগরিকদের প্রাপ্তবয়স্কতা মিলে তারা পদার্পণ করে প্রাপ্ত বয়স্কের দোরগোড়ায়, অর্থাৎ তরুণ প্রাপ্তবয়স্ক আমেরিকার টিনএজাররা ১৮ হওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকে কারন ১৮ হলেই তারা পেয়ে যায় বেশ কিছু মূল্যবান ক্ষমতা দেশের একজন নাগরিক হিসেবে ভোট দেয়ার ক্ষমতা পায় আইনত বিয়ে করা এবং সংসার করার স্বাধীনতা পায় বাড়িঘর ও সহায় সম্পত্তির ব্যাপারে আইনত সিদ্ধান্ত নেয়া ও স্বাক্ষর করার অধিকার অর্জন করে সর্বোপরি, নিজের চিকিৎসার ব্যাপারে সকল সিদ্ধান্ত নেয়া এবং নিজের ব্যক্তিগত মেডিকাল রেকর্ড গোপন রাখার স্বাধীনতা পায় যাতে তার অনুমতি ছাড়া বাবামা বা অন্য কেউ তার শারিরীক অবস্থা বা চিকিৎসা সম্পর্কে জানতে না পারে

বয়স ১৮ হলে সবথেকে বড় যে ব্যাপারটা করতে পারবে বলে ছেলেমেয়েদের অসীম আনন্দ হয়, তা হলো বাবামা'র সংসার ত্যাগ করা বা তাদের বাড়ী ছেড়ে চলে যাওয়া এক কথায়, নিজের জীবন নিজে চালানোর পরীক্ষায় তারা সম্মুখীন হয় পরীক্ষা পর্বে কখনো সফলতা বা কখনো বিফলতা, এরই মধ্যে দিয়ে তারা খুঁজে পায় তাদের আসল ঠিকানা, পৌঁছে যায় তাদের গন্তব্যে এরই মধ্যে দিয়ে তারা আবিষ্কার করে নিজেদের আর এগুলো করতে করতেই তারা তরুণ সাবালকটি প্রাপ্তবয়স্কতার ধাপ পার করে হয়ে যায়, পরিপূর্ণ সাবালক

বাবামা থেকে এই বিচ্ছেদের একটি বড় কারন হলো, হাইস্কুল পাশ করে টিনেজাররা যখন কলেজে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়, বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই কলেজটি হয় অন্য কোনো শহরে বা অন্য কোনো স্টেটে অনেক সময়, একই শহরে ইউনিভার্সিটি হলেও ছেলেমেয়েরা বাড়িতে না থেকে হোস্টেল বা (আমেরিকান) ডর্মে থাকার সিদ্ধান্ত নেয় পরিপূর্ন ভাবে এদের স্বাধীনতা উপভোগ করতে চায় বাবামা চাইলেও আইনত ভাবে ১৮ বছর বয়সী সন্তানকে বাড়ীতে আটকে রাখতে পারবেনা তাই কোনরকম বাঁধা বা নিষেধ ছাড়াই তারা সন্তান এর ইচ্ছেটাকে পরিপূর্ণ ভাবে সমর্থন করে এটাই আমেরিকান সমাজ ব্যবস্থা, স্বাভাবিক রীতিনীতি যা বহুযুগ ধরে হয়ে আসছে পরিপূর্ন স্বাধীনতা লাভ বা ফ্রিডম পাওয়া, আমেরিকানদের বেঁচে থাকার খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ

আমাদের বাঙালি সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে চিন্তা করলে মনে হবে, এটা কি ধরনের পাগলামি? ১৮ বছরের ছেলেমেয়েরা আবার বড় নাকি, তারা তো বাচ্চা আসল দুনিয়াদারির বিচারে একেবারে নাদান শিশু সবেমাত্র কলেজ(আমেরিকান হাইস্কুল)পাশ করেছে জীবনে কি করতে চায়, না চায় এখনো ভালো করে জানেইনা জীবনের বেশীর ভাগ গুরুত্বপূর্ন সিদ্ধান্ত গুলো তাদের হয়ে তাদের বাবামা'রা নিয়ে দেবে তবেই না তারা ঠিক পথে এগুবে কাজেই বাবামা'র বাড়ি ছাড়ারতো প্রশ্নই ওঠেনা সত্যিকার অর্থে, বাঙালি সমাজে অনেক সময় তিরিশোর্ধ সন্তানদেরও বাপমায়ের বাড়িতে একসাথে থাকতে দেখা যায় এটা কারো কাছে দৃষ্টিকটুও হয়না

পাশ্চাত্য দুনিয়ায় এই রকম একটি ব্যাপার কল্পনা করা যায় না প্রাচ্যের এই চিন্তাধারাগুলো পাশ্চাত্যের দুনিয়ায় একদমই সেকেলে প্রাচ্যের মানুষগুলো যখন ভাবে, তরুণদের জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে পিতামাতা বা গুরুজন সঠিক রাস্তা দেখাবে, ভুল করা থেকে প্রতিনিয়ত রক্ষা করবে পাশ্চাত্যের মানুষগুলো তখন ভাবে, ছেলে মেয়েরা যে যার নিজ পথে এগুবে, ভুল করবে এবং ভুল করতে করতেই শিখবে, নিজের ভুলের মাশুল নিজে দেবে কোন ধারাটি সম্পূর্ন ঠিক আর কোনটি বেঠিক, এই মতামত একেক জনের কাছে একেক রকম আমরা যে যেই সমাজে বসবাস করি, সে সেই সমাজেরই রীতিনীতি গুলো মানতে বাধ্য হই

এবার আসি নিউরোবিজ্ঞানী এবং মনোবিজ্ঞানীদের কথায়, ১৮ বছর সম্পর্কে তারা কি বলে তাদের মতে, মানুষের শারিরীক পরিপক্কতা আর মানসিক পরিপক্কতা কোনো ভাবেই একই গতিতে চলেনা কাজেই একটি ছেলে বা মেয়ে শারিরীক ভাবে বিকশিত হয়ে গেলেও মানসিক বৃদ্ধি এমন একটি প্রক্রিয়া যা ক্রমাগত চলতেই থাকে কোনো কোনো গবেষনায় দেখা গিয়েছে, একজন তরুণ এবং একজন পূর্নবয়স্ক যুবকের বুদ্ধিমত্তা এক মাপের হলেও, সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে তরুণেরা বুদ্ধির চাইতে আবেগকে বেশী প্রাধান্য দেয় যুক্তি বা বাস্তবতার বদলে তাদের আবেগই তাদের সকল চিন্তাধারাকে নিয়ন্ত্রন করে বিজ্ঞানীদের মতে, ১৮ নয় বরঞ্চ বিশ উর্ধো কোনো বয়স যেমন ২৪ বা ২৫ বছর বয়সে একজন মানুষের প্রাপ্তবয়স্ক বুদ্ধিমত্তা আসে

বর্তমান সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রচার প্রসার টিনএজার বা তরুণদের জন্য এই ব্যাপারটাকে আরো কঠিন করে দিয়েছে খুব অল্প সময়ে বিরাট কিছু করা বা তাড়াতাড়ি বড় হয়ে অন্যদের মত কিছু করে দেখানোর এক প্রচন্ড চাপ টিনএজাররা সর্বদা অনুভব করে মানসিক বুদ্ধির পরিপক্কতার স্বাভাবিক গতি তরান্বিত করার যে চেষ্টায় তারা উপনীত হয়, তাতে করে ব্রেইনের সকল অংশ সমান ভাবে ম্যাচিউর হয় না আর সেই জন্যই, উনিশ কুঁড়ি বছর বয়সীরা জীবনে কিছু কাজ ঠিক করে, আবার কিছু ভুল সিদ্ধান্তের বিরাট মাশুলও দেয়

আমার বড় ছেলেটা এবছর হাইস্কুল পাশ করেছে এবং ১৮তে পড়েছে টেক্সাস এ অ্যান্ড এম ইউনিভার্সিটিতে অ্যাডমিশন পেয়ে সে বর্তমানে কলেজ জীবনে ঢোকার জন্য প্রস্তুত সন্তান চলে যাবার মন খারাপের মাঝে আমার বারবার মনে পড়ছিল, আঠারো বছর আগের সেই দিনটার কথা ছেলেটা জন্মানোর তিনদিনের মাথায় আমি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলাম ছোট্ট শিশুটা প্রথম বেবিক্যারিয়ারে শুয়ে বাড়িতে এলো বাবা মায়ের দুই পরিবারের সে যে কি আনন্দ নতুন অতিথিকে বরণ করতে কত ধরনের আয়োজন সম্পন্ন হলো কে আগে কোলে নিবে এই আনন্দে সবাই ছিলো বিভোর একটু কান্নার আওয়াজ শুনলেই, কি হলো কি হলো করে সবাই চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়ছিল

সেই শিশুটি এবছর সাবালক হলো তরুণ প্রাপ্তবয়স্কতার ছাড়পত্র পেয়ে সে বাড়ি ছাড়ার জন্য প্রস্তুত হলো আমার ছেলেটা তার মাবাবার স্নেহ মমতায় তিল তিল করে গড়ে তোলা, চিরপরিচিত আবাসস্থল ছেড়ে রউনা হলো নতুন এক গন্তব্যস্থলের দিকে তার সামনে এখন অপেক্ষা করছে অফুরন্ত সম্ভাবনা এবং এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা 

সে এখন এক নতুন পথের পথিক যদিও পথটি হবে বন্ধুর আর বিপদসংকুল তবুও আশা রাখি, সাহস আর আত্মপ্রত্যয় নিয়ে সে ঠিক‌ই পৌঁছে যাবে তার ঠিকানায় এই ১৮ সংখ্যাটি তাকে ধীরে ধীরে নিয়ে যাবে, নিজেকে চেনার আর স্বপ্ন পূরনের বাস্তবতার পথে ম্যাজিক নাম্বার ১৮

Comments

Post a Comment