ঠিকানার আহবানে
এই গ্রীষ্মের ছুটিতে ঠিক করেছিলাম পরিবার নিয়ে নিউইয়র্ক বেড়াতে যাবো। বিশেষ করে নিউইয়র্কের বই মেলায় যাওয়ার ইচ্ছা ছিল। আর বাচ্চারাও নিউইয়র্ক শহরের আকর্ষনীয় সব ট্যুরিস্ট স্পটগুলো দেখতে চাইছিলো। তাই ভাবলাম, এক সফরে অনেকগুলো ইচ্ছা পূরণ হয়ে যাবে। যাওয়ার তারিখ ঠিক হতেই ঠিকানা পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি শাহীন ভাই এর সাথে যোগাযোগ করলাম। ইচ্ছা ছিল নিউইয়র্কে এলে উনার সাথে দেখা করবো।
শাহীন ভাই তখন বাংলাদেশে অবস্থান করছিলেন। তিনি জানালেন
অল্প ক’দিনের মধ্যে তিনি আমার সাথে পুনরায় যোগাযোগ করবেন। কিছুদিন পরে উনার কাছ থেকে
একটা ফোন পেলাম। তিনি আমাকে সাদরে আমন্ত্রণ করলেন, ঠিকানার পূণর্মিলনী অনুষ্ঠানে যোগ
দেয়ার জন্যে। আমি সাদরে গ্রহণ করলাম সেই আমন্ত্রণটি। ঠিকানা পরিবারের সাথে পরিচয় হবে
এই আনন্দেই হলাম বিভোর।
তার কিছুদিন পরে এলো আরো একটি বিস্ময় করা খবর। আমাকে
ইমেইল করে জানানো হলো, ঠিকানা সম্মাননা গুণীজন বাছাই কমিটির রায়ে সাহিত্যে বিশেষ অবদান
রাখার জন্য আমাকে নির্বাচন করা হয়েছে Thikana Best Literary Award-2022 এর জন্য। আমি
প্রচণ্ড ভাবে বিস্মিত ও আনন্দিত হলাম। এতো বড় সম্মাননা পাওয়ার যোগ্যতা রাখি ভেবে বোধ
করলাম গভীর কৃতজ্ঞতা।
ঠিকানার সাথে সম্পর্ক বহু দিনের। নব্বই দশকের শুরুর
দিকে আমি বাংলাদেশ থেকে নিউইয়র্কে আসি আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ডিগ্রী করতে। সাত সমুদ্র তেরো
নদীর ওপারে আমার জন্মভূমিকে ছেড়ে আসলেও, তার মায়া ত্যাগ করতে পারিনি। দেশের জন্য সব
সময় মন কাঁদত। দেশে কি ঘটছে না ঘটছে তা জানতে মন চাইতো। সেই সময় কোনো স্মার্ট ফোন ছিলোনা,
ছিলোনা কোনো ফেসটাইম, ভাইবার বা ওয়াটস অ্যাপ। কার্ড ব্যবহার করে দেশে ফোন করতে হতো
যা ছিলো কলেজ পড়ুয়াদের জন্য খুবই ব্যয়বহুল। পাঁচ মিনিট এর জন্য ফোন করে পরিবারের সবার
খোঁজ খবর নিতেই সময় শেষ হয়ে যেত। দেশের কথা আলাপ করার সময় হতোনা। সেই একাকীত্বের প্রহরে,
সেই মন খারাপ করা বিকেলে, আমার বাংলাভাষী সঙ্গী হয়েছিলো ‘ঠিকানা’।
সেই সময় বাঙালী গ্রোসারি দোকানে বা নিউজস্ট্যান্ডে ঠিকানা পত্রিকা বিক্রি হতো। কলেজ থেকে বাড়ি ফেরার পথে সাবওয়ে ট্রেন থেকে নেমে দোকান থেকে প্রতি সপ্তাহে আমি সংগ্রহ করতাম ঠিকানা। প্রথম পাতা থেকে শেষ পাতা পর্যন্ত খুঁটে খুঁটে আমার সবগুলো পছন্দের খবর পড়তাম, তবে আমার শান্তি হতো। এক নিমেষে ফিরে পেতাম আমার বাংলাদেশকে। বাংলার মাটি থেকে দূরে থেকেও যেন মাটির গন্ধ পেতাম। দূরে থেকেও কাছে পেতাম বাংলার জীবনবৃত্তান্ত। কাছে পেতাম আমার শিল্প, সাহিত্য, ভাষা, সংস্কৃতি। স্বদেশে, প্রবাসে এবং বিশ্ব চরাচরে কি কি ঘটছে তা নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ ভাবে ও বিশ্বস্তমানের খবর প্রদান করতো ঠিকানা। যতদিন নিউইয়র্কে ছিলাম ততদিন ঠিকানা ছিল হাতের নাগালের মধ্যেই। নিউইয়র্ক ছেড়ে টেক্সাসে চলে আসার পর ঠিকানাকে পেয়েছি অনলাইনে, সোশ্যাল মিডিয়াতে। তবে সেটা পাঠক হিসেবে।
২০২০ সালে নতুন করে আবার ঠিকানার সাথে যোগাযোগ – এবার
লেখক হিসেবে। লেখালেখির জগতে ফেরত আসার পর অনেকটা কৌতূহলের বশে একদিন আমার একটি লেখা
পাঠাই ঠিকানায় ছাপানোর জন্যে। ঠিকানার ২৫শে ডিসেম্বর, ২০২০ সংখ্যায় ছাপা হয় আমার লেখা
‘বলুন তো আমি কি?’, যা ছিলো আমাদের অতি পরিচিত ফেইসবুক সম্পর্কে। এই লেখাটি আমেরিকাবাসী
পাঠকের মনে দারুণ সাড়া জাগায় এবং ভীষণভাবে সমাদৃত হয়। শাহীন ভাই আমাকে ফোন করে অভিনন্দন
জানান। তিনি বলেন, আপনি আরো লিখতে থাকুন, পাঠাতে থাকুন। এরপর আর একটি লেখা যা প্রবাসের
বাঙালি নারীদের মাঝে ভীষণভাবে জনপ্রিয় হয়, সেটি ছিলো ‘মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ’। তারপর
থেকে ঠিকানা পত্রিকার বিভিন্ন সংখ্যায় সমকালীন ও সমাজ সচেতনতামূলক বিষয় নিয়ে আমি নিয়মিত
কলাম লিখে চলেছি।
দিনটি ছিল ১৬ জুলাই, রবিবার। ৩৪ বছরে পদার্পণ উপলক্ষে আয়োজন করা
হয়েছিল বিশ্বে সর্বাধিক প্রচারিত বাংলা সংবাদপত্র ঠিকানার পূণর্মিলনী অনুষ্ঠান।
সেই সাথে পত্রিকাটির বিশিষ্ট লেখকদের সম্মাননা প্রদান। খুব দারুণ ও প্রাণবন্ত একটি
আয়োজন করেছিলো ঠিকানা। নিউইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ফেয়ার মেরিনা রেস্টুরেন্টের মনোরম
প্রাকৃতিক পরিবেশ ও বর্ণিল সাজসজ্জার মাঝে মিলিত হয়েছিল মূলধারার রাজনীতিবিদ,
কমিউনিটির বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, কবি-সাহিত্যিক, লেখক-প্রকাশক, সাংবাদিকসহ প্রবাসের
বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। সেই দিন দুপুরে আমার একান্ত পরিবার ও ‘ঠিকানা’
পরিবারের সাথে এক স্মরণীয় সময় কাটিয়েছি। শাহীন ভাইয়ের অকৃত্রিম আন্তরিকতা ও অশেষ
আতিথিয়তায় বার বার মনে হয়েছে, আমি নতুন কেউ নই, বহু দিন ধরেই এই পরিবারের সদস্য।
আমেরিকা জীবনের খুব বড় একটা সময় কেটেছে নিউইয়র্ক শহরে। এখন থাকি
টেক্সাস অঙ্গরাজ্যে। টেক্সাস থেকে নিউইয়র্কে বেড়াতে গিয়ে ঠিকানা পরিবারের কাছ থেকে
এমন অসামান্য একটি সাফল্য-উপহার পেয়ে মনে হয়েছে, এই বন্ধন কখনো ভাঙ্গার নয়….হাজার
মাইলের দূরত্ব কোন ব্যবধান নয়।
অভিনন্দন। আমি সত্যিই আপনার প্রতি গর্বিত। আপনার লেখাগুলো শুধু লেখাই না একটি অনুপ্রেরণাও। সবসময় এভাবেই লিখে যান ও সবাইকে অনুপ্রাণিত করে যান। আপনার এই অবদান দেখে আমি বিশ্বাসের সাথে বলতে পারি যে, একদিন আপনি বাংলাদেশের ১ নাম্বার ব্লগার এবং লেখক হয়ে যাবেন।
ReplyDeleteতোমাকে জানাই অশেষ ধন্যবাদ। আমার লেখাগুলো পড়ে দূরে কোথাও কেউ অনুপ্রাণিত হচ্ছে জেনে খুব ভালো লাগলো। শুভকামনা।
Delete