একুশ দিনের গল্প - ২য়

পাঠকের জন্য এর আগের পর্বের লিংকঃ   একুশ দিনের গল্প - ১ম

---------------------------------------------------------------------------------------------------------------

দোহা থেকে ঢাকা ফ্লাইটে আমার পাশে একজন অতীব বিনয়ী ও মিশুকে ভদ্রলোক বসেছিলেন। কথায় কথায় জানতে পারলাম, তিনি ম্যাসাচুসেটস স্টেটের বস্টন শহরে থাকেন এবং বহু, বহু বছর পরে দেশে বেড়াতে যাচ্ছেন। কাজেই বাংলাদেশের বর্তমান হালচাল সম্পর্কে ধারণা খুবই কম। পেশায় একজন ডাক্তার। ছোটবেলায় পরিবারের সাথে দেশ ছেড়ে ছিলেন। কিন্তু বাবামা ভাইবোন বেশীর ভাগই আমেরিকায় থাকায় আর দেশে যাওয়ার টান অনুভব করেননি। হঠাত করেই খুব ঘনিষ্ট একজন বন্ধুর কাছ থেকে বন্ধুদের রিইউনিয়ন এর আমন্ত্রন পেয়ে, আর দেশে যাবার লোভ সামলাতে পারেননি। ঢাকায় পৌছে তিনি চিটাগং এর উদ্দেশ্যে রউনা হবেন।

বাঙালি হিসেবে আমি ভদ্রলোকটিকে, আমাদের দেশ সম্পর্কে কিছু আপডেট দেওয়ার নৈতিক দায়িত্ব অনুভব করলাম। তিনি শুনে খুব অবাক হলেন যে ঢাকা শহর আর আগের মত নেই। বহুতলা অ্যাপার্ট্মেন্ট বিল্ডিং, শপিং মল, ভিন্ন দেশীয় কুজিন রেস্তোরা, অ্যামিউজমেন্ট পার্ক, বিদেশী ধাচের ক্যাফে, ফিটনেস জিম, বিউটি পার্লার অ্যান্ড স্পা, হাই এন্ড সোশ্যালাইযিং ক্লাব, কি নেই এখন ঢাকা শহরে। এই নয়া নগরে এখন সবাই ছুটে। জীবিকা উপার্জন, ভ্রমণ, কর্মসংস্থান, বিনোদন, সময় যাপন, রাস্তায় রাস্তায় স্লোগান মিছিল, সব কিছুই চলে পাশাপাশি এক কাতারে। প্রচণ্ড ট্রাফিক জ্যাম, অসহনীয় যানজট, মানুষের নিত্য দিনের সাথী। রাস্তায় নামলে মনে হবে মানুষের তুলনায় যানবাহন বেশী, সময়ের তুলনায় মানুষের তাড়া বেশী। সবাই পাল্লাপাল্লি করছে আগে যাওয়ার জন্য। যে পথচারী সেও যেতে চায় গাড়ীর আগে, হাঁটা দেয় চলন্ত গাড়ীর সামনে। 

তিনি খুব মন দিয়ে আমার কথা শুনছিলেন আর বললেন, উনার স্ত্রীও আসার আগে এমন ধারণা দিয়েছেন। কারন তিনি প্রতি বছর দেশে যান। তবে উনার স্ত্রীর কথা বিশ্বাস করতে অসুবিধা হচ্ছিল। ছোটোবেলায় ফেলে আসা ঢাকা শহরের চিত্রটাই উনার মনে গেঁথে আছে। আমি উনাকে বললাম আমি আমার মা'কে দেখতে প্রায় দেশে যাই। কাজেই ঢাকার এই পরিবর্তন আমার জন্য নতুন কিছু নয়।  এই ডিজিটাল যুগে, ডিজিটাল বাংলাদেশ যেন প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যকে একেবারে একই ঘরে বন্দী করে ফেলেছে। 

আমাদের সময় অর্থাৎ আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন ওয়েস্টার্ন ওয়ার্ল্ড ছিল একটা 'ধারণা' মাত্র। হয়তো ছিল অনেকের 'স্বপ্ন', ওখানে পাড়ি জমানোর। বর্তমান সময়ে দেশের নাগরিকেরা পাশ্চাত্যের দুনিয়া সম্পর্কে প্রায় সবই অবগত। ইন্টারনেট, সোশ্যল মিডিয়া এখন সব ধারণাকেই করে দিচ্ছে বাস্তবের মত পরিষ্কার। তারা আমেরিকার জীবনযাত্রা এবং আমেরিকান রীতিনীতি, সংস্কৃতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। অনেক অবস্থাপন্ন, উচ্চবিত্ত পরিবার এর সদস্যেরা আমেরিকায় প্রতি বছর ছুটি কাটাতে আসে। অনেকের আছে আমেরিকার কোন স্টেটে ভ্যাকেশন হোম। আমেরিকায় থাকা বাঙালীরা অনেক বছরের সাধনায় আর পরিশ্রমে যা অর্জন করে, তা ঢাকায় থাকা এক শ্রেণীর বাঙালিদের জন্য করা খুবই সহজ একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছি। 

ভদ্রলোক মাথা নেড়ে অনেক ব্যাপারেই আমার সাথে পুরোপুরি একমত হচ্ছিলেন। আর ভাবছিলেন, বন্ধুদের পার্টিতে তার জন্য কি কি বিস্ময় অপেক্ষা করছে। উনি উনার স্ত্রীর কাছ থেকে জেনেছেন, দুটি সম্পুর্ন বিপরীতধর্মী শ্রেণী এখন ঢাকা শহরে সহঅবস্থান করে। অতি রক্ষণশীল এবং অতি আধুনিক। তারা যে যার অবস্থান থেকে তাদের দৈনন্দিন কার্যকলাপ করে নিয়মিত আকারে অথবা অতিমাত্রায়। আর তা হতে পারে খাওয়াদাওয়া, পোশাকআশাক, কথাবার্তা, আচার ব্যবহার, পরিবার গঠন, সন্তানসন্ততি পালন অথবা সকলের সাথে সামাজিকতায় । এই পর্যায়ে আমি আর না বলে থাকতে পারলাম না যে আমার চোখে কিন্তু আরো একটি তৃতীয় শ্রেণী ধরা পড়েছে।

আরো একটি দল যারা এই দুই দলের মাঝখানে পড়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগে এবং বুঝে উঠতে সক্ষম হয়না যে কোন দিকে যাওয়া ঠিক হবে। অথবা তারা কোনো একটা চরম পথে যাওয়াটা বাঞ্জনীয় মনে করে না। তারা মাঝামাঝিই থাকতে চায়। তাদের অবস্থা যাই হোক, আমরা যারা আমেরিকা বা বিদেশের কোনো দেশ থেকে আসি, আমাদের অবস্থা হয় আরো বেগতিক। না ঘারকা, না ঘাটকা। আমরা কোনো দলেই নিজেদেরকে ভেড়াতে পারিনা। ভাবতে খুব অবাক লাগে যে একই ভাষা বলেও, একই খাওয়া খেয়েও, গায়ের রং একই হয়েও, আমরা দেশে এসে নিজেদেরকে খাঁটি বাঙালি ভাবতে পারিনা। আমরা চিরকালই হয়ে থাকি প্রবাসী বাঙালি। 

যে দিন স্বদেশ ছাড়ি, সেদিন থেকেই হয়ে যাই প্রবাসী। আর যে দেশে আবাস গড়ি, সে দেশে আসার পর থেকে হয়ে যাই, ফার্স্ট জেনেরেশন ইমিগ্র্যান্ট। আমাদের আসল জায়গাটা তাহলে কোথায়?  

হঠাত মাইক্রোফোনে ক্যাপটেনের গলার আওয়াজ ভেসে এলো। আমরা ঢাকা শহর থেকে আধা ঘন্টা দূরে অবস্থান করছি। আর তিরিশ মিনিটের মধ্যেই আমরা অবতরন করবো। একটা চাপা উত্তেজনায় মনটা ভরে গেলো। হাজার হাজার মাইল দূরত্ব অতিক্রম করার পর শেষ আধা ঘন্টা আর মন মানেনা। ঘড়িতে সময় দেখাচ্ছে সকাল নয়টা। আরো টুকটাক কথাবার্তা বলতে বলতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। হঠাত করে মনে হল আমরা অনেক ক্ষণধরে আকাশে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি। কিছু দূর নামার পর কই আর নীচে তো নামছিনা। ঘড়িতে আবার সময় দেখলাম। সকাল নয়টা পঞ্চাশ। সর্বনাশ, আমরা কেন অবতরণ করছি না? 

পাশের ভদ্রলোক আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমরা কি আকাশে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি? আমি বললাম, আমারোতো তাই মনে হচ্ছে। ব্যাপারটা কি? আমি উনাকে বললাম, চলুন আমাদের ফ্লাইটের লোকেশন ম্যাপটা ফলো করি। এই হাইটেকের যুগে আমরা সবাই জানি, এখনকার সব ফ্লাইটেই, প্লেনের যাত্রা পথ, সময় এবং ফাইনাল ডেস্টিনেশন সহ একটা ম্যাপ সিটের পেছনে বা সামনের স্ক্রিনে দেখতে পাওয়া যায়। লোকেশন ম্যাপ অন করতেই লক্ষ্য করলাম, আমাদের প্লেনের রুটটি ঢাকার কাছাকাছি এসে ঘুরে অন্য দিকে চলে যাচ্ছে এবং ফাইনাল গন্তব্যস্থল দেখাচ্ছে 'ম্যান্ডালে'। বুকের মধ্যে ধপাস করে একটা বাড়ি পড়লো। ম্যান্ডালে কোথায়? আমরা ঢাকায় যাচ্ছি না কেনো?

সিট বেল্ট খুলে উঠে দাঁড়ালাম। ফ্লাইট অ্যাটেন্ডেন্ট কে জিজ্ঞেস করা দরকার আমরা কোথায় যাচ্ছি। পর্দা সরিয়ে ওদের ক্যাবিনে ঢুকে ইংরেজীতে জিজ্ঞেস করলাম, ম্যান্ডালে কোথায়? আমরা কি ঢাকায় যাচ্ছিনা? ফ্লাইট অ্যাটেন্ডেন্ট যাকে জিজ্ঞেস করলাম সে কম বয়সী, খুব মিষ্টি চেহারার একজন মধ্যপ্রাচ্যের মহিলা। হাসি হাসি মুখ করে সে বলল, ম্যান্ডালে খুব সম্ভবত ঢাকা থেকে দূরে চিটাগং এর কাছাকাছি একটি শহর। 

আমি হেসে বললাম, হতেই পারেনা। ম্যান্ডালে কোনো বাংলা শব্দ নয়। সে খুব অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কি বাঙালি? আমি মাথা নেড়ে বললাম, হ্যাঁ। তুমি কি একটু ক্যাপ্টেনকে জিজ্ঞেস করবে, এখন কি হচ্ছে? এরই মধ্যে যাত্রীদের ক্যাবিন থেকে একটা চাপা গুঞ্জন শুনতে পেলাম। সকলেই বুঝতে পেরেছে আমরা ঢাকায় অবতরণ না করে আবার ঘুরে চলেছি। সিটে এসে বসলাম। অসহায় মনে ভাবলাম, এই যাত্রা কবে শেষ হবে?  আদৌ কি পৌছাবো?

একটু পরই ক্যাপ্টেনের কণ্ঠ আবার ভেসে এলো। তিনি যা বললেন তা সারমর্ম করলে দাঁড়ায়, অতিরিক্ত কুয়াশার কারনে আমাদের প্লেনটি ঢাকায় অবতরণ করার পারমিশন পাইনি। অনেক ক্ষণ ধরে আকাশে চক্কর দিতে দিতে জ্বালানি ও শেষ হয়ে আসছিলো। ক্যাপটেনের হাতে অপশন ছিল দুইটা, কলকাতা ও ম্যান্ডালে, যা কিনা মিয়ানমারে অবস্থিত একটি শহর। অতিরিক্ত ভিড়ের কারনে যখন কলকাতা থেকেও ক্লিয়ারেন্স মেলেনি, তখন বাধ্য হয়েই মিয়ানমারের দিকে রউনা হতে হয়েছে।  ম্যান্ডালে গিয়ে জ্বালানি নিয়ে ঢাকায় ফেরত আসতে আরো দুঘণ্টা সময় লাগবে। 

হায় আল্লাহ্‌, বলে কি? তার মানে আমাদের ল্যান্ডিং টু ঢাকা আরো দু থেকে তিন ঘন্টা পরে। ভাবলাম, আমি কি হলুদের অনুষ্ঠান ধরতে পারবো? তার উপর আবার কাশির যন্ত্রণা। যতদূর মনে পড়ে, আমাদের আকাশপথে যাত্রার প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর অনুভব করলাম যে প্লেনটি আবার ঘুরতে শুরু করেছে। ক্যাপ্টেন এবার আমাদের জানালেন যে ঢাকা থেকে এখন ক্লিয়ারেন্স মিলেছে। অর্থাৎ কুয়াশা হটে গিয়েছে। অর্থাৎ আমরা এখন মিয়ানমারে না গিয়ে ইউ টার্ন মেরে আবার ঢাকার উদ্দেশ্যে রউনা দিয়েছি। যাক বাঁচা গেলো।

আকাশে ভেসে ভেসে এই সাপলুডু খেলা খেলতে খেলতে আমাদের ফাইনালি ঢাকায় অবতরণ করা হল, যা পুরোনো সময় ছিল তার দুঘন্টা পর, অর্থাৎ সকাল সাড়ে এগারোটায়।  এয়ারপোর্টে নেমে বিশাল লম্বা ইমিগ্রেশন এর লাইন, ঘন্টা ধরে লাগেজের অপেক্ষা, মোবাইলের সিম কার্ড অ্যাকটিভেট করা, রাস্তায় নেমে ট্রাফিক জ্যামে আটকানো, সব মিলিয়ে বাড়ী পৌছালাম দুপুর দুইটায়। এর মধ্যে মা, বোনদের অসংখ্য বার ফোন করে আমার খোঁজ নেওয়া, তাদের দীর্ঘ অপেক্ষা ও আমার অপরিসীম ধইর্য্যের শেষ সীমা অতিক্রম করে বত্রিশ ঘন্টার জার্নি শেষে ধুকতে, ধুকতে, কাশতে, কাশতে, বাড়ীর দরজায় এসে হাজির হলাম। 

কি আনন্দ, কি আনন্দ! বিয়ে বাড়িতে সাজ সাজ রব। আজ পাত্রের হলুদের অনুষ্ঠান। তাই কনে বাড়ীতে ডালা,

কুলা সাজানো হচ্ছে। পাত্রের জন্য কেনা সুট, পাঞ্জাবী, শাল, জুতো, ঘড়ি, প্রসাধনী। সেই সাথে হাতের রাখি, ফুল, হরেক রকম মিষ্টি, নকশী করা পিঠা। 

আমি সাথে করে আনা বিদেশী কাশির ওষুধ আর মা'র কাছ থেকে নেয়া দেশি কাশির ওষুধ, সব গুলো খেয়ে একটা ঘুম দিলাম। ঘুম থেকে উঠে জেট ল্যাগ এর সাথে যুদ্ধ করে আবার হলুদ অনুষ্ঠানের জন্য সাজগোজ করে রেডি হতে হবে.....(চলবে)  


পাঠকের জন্য এর পরের পর্বের লিংকঃ একুশ দিনের গল্প - ৩য়            

Comments

  1. চমৎকার লেখা ।

    ReplyDelete
  2. Very interesting story. Waiting for the third part.

    ReplyDelete
  3. ঘুমাতে গিয়ে না হলুদ মিস্ হয়ে যায়। কি সর্বনাশ!! রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষায় থাকলাম একুশ দিনের প্রথম দিনে।

    ReplyDelete
  4. আকাশে ওড়া আমার কাছে সবসময় একটা ভয়মিশ্রিত আনন্দের ব্যপার। সেই সাথে সহযাত্রীর সাথে আলাপ এবং সেই আলাপে একটি গল্পের ধারা। এ সবই সুন্দর ভাবে প্রতিফলিত হয়েছে এই লেখায়।

    ReplyDelete

Post a Comment