একুশ দিনের গল্প - ১ম

ব্লগাররা কোনো কাল্পনিক গল্প লিখে না। তারা তাদের নিজের জীবনের গল্প, আশেপাশের মানুষদের গল্প, সহজ সাবলীল ভাষায় আপন দৃষ্টিকোণ থেকে লিখে চলে। ব্লগিং এর মূল সৌন্দর্যই হল এর বাস্তবতা ও বাস্তব নির্ভর পরিবেশনা। হোক না সে আনন্দময় বা দুঃখজনক অথবা সম্পূর্ন আবেগবর্জিত। আমি আমার নিজের মধ্যে চিরকালই একজন ব্লগারকে খুঁজে পাই। অভিজ্ঞতালব্ধ লেখাই আমার লেখনীর মূল চালিকাশক্তি। 

প্রকৃত অর্থে আমার এই গল্পের শুরু অনেক দিন আগে এবং এর স্থায়িত্বকাল একুশ দিনেরও বেশী সময় ধরে। তাই মূল গল্প শুরুর আগে কিছু প্রাক কথা না বললেই নয়...

আমি প্রতি বছরই একবার বাংলাদেশে যাওয়ার চেষ্টা করি এবং দেশে যাওয়ার আগ দিয়ে সাধারনত খুব খুশী থাকি। মা বোনদের সাথে দেখা হবে, আত্মীয় পরিজনদের সাথে দেখা হবে, মজার মজার রান্না খাবো, অনেক জায়গায় ঘুরতে যাবো, দেশীয় জিনিসপত্র কিনবো, কত কিছুর সম্ভাবনায় মনটা আনচান করতে থাকে। গত বছরের শেষ দিকে হঠাত করেই আমার একমাত্র ভাগ্নির বিয়ে ঠিক হল। আমি খুবই আনন্দিত, বিয়ে অ্যাটেন্ড করতে দেশে যাবো। বাংলাদেশে বসে বিয়ের অনুষ্ঠান যোগ দেয়া একেবারেই অন্য রকম একটা অভিজ্ঞতা। আর তা যদি হয় আপন কারোর তাহলে তো কথাই নেই।

ডিসেম্বর মাস শুরু হতেই আনন্দময় সম্ভাবনাগুলো পাল্টাতে লাগলো। আমার রউনা হউয়ার দুই সপ্তাহ আগে ডিসেম্বর এর মাঝামাঝি, আমার খুব শরীর খারাপ করলো। প্রথমে জ্বর, গলা ব্যাথা, কানে ব্যাথা, তারপর শুরু হল প্রচন্ড রকমের কাশি। সেই কাশি বাড়তে বাড়তে এমন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকল যে আর সারলোই না। দেশে যাবার দিন প্রচন্ড কাশি নিয়ে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে রউনা হলাম। একদিকে দেশে আসার প্রবল উত্তেজনা, আর অন্য দিকে সাংঘাতিক অসুস্থতার ধকল, একেবারে দুই পরস্পরবিরোধী শক্তি আমার শরীরে কাজ করতে লাগলো। 

অস্টিন এয়ারপোর্টে চেক-ইন করার সময় প্রথম দুঃসংবাদটা পেলাম। আমার দীর্ঘ যাত্রাপথের প্রথম ফ্লাইটটি যা কিনা অস্টিন থেকে  ডালাস পর্যন্ত যাবে, তা অনির্দিষ্ট কালের জন্য বিলম্বিত। কাজেই আমার পক্ষে ডালাস পৌঁছে কাতার এয়ারলাইন্সের দোহাগামী ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইট ধরার সম্ভাবনা একেবারে ক্ষীণ। আমি যখন ডালাস গিয়ে পৌছাবো, ইতিমধ্যে কাতার এয়ারলাইন্স ছেড়ে দিয়ে থাকবে। তবে আমাকে চয়েস দেয়া হলো যে আমি ডালাসের পরিবর্তে অন্য কোনো শহর যেমন নিউইয়র্ক হয়ে যেতে পারি। তবে সেই ক্ষেত্রেও  দ্বিতীয় ফ্লাইটটির কোনো গ্যারান্টি নাই। 

আমেরিকান এয়ারলাইন্সের চেক-ইন ক্লার্ক খুব হাসি হাসি মুখ করে আমাকে জানালেন,  এই পরিস্থিতিতে আমার জন্য শ্রেয়, আজকের মত যাত্রা মুলতবি করে আগামী কাল রউনা হওয়া। কাজেই বাধ্য হয়ে আমার যাত্রা বিরতি ঘটালাম এবং পরের দিনের ভ্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমার ছেলেরা এই অপ্রত্যাশিত সংবাদে অতীব খুশী হয়ে গেলো এবং খুব খুশী মনে আমাকে নিয়ে তারা বাড়ী ফেরত এলো। 

বাড়ী এসে প্রথমে দেশে ফোন করে জানালাম যে অবস্থা খুবই বেগতিক। আমি একদিন পরে রউনা হবো এবং একদিন পরে ঢাকায় পৌছাবো। বড় আপা হায় হায় করে উঠলেন। ঢাকায় পৌঁছে একটু বিশ্রাম নিয়েই আমাকে প্রস্তুতি নিতে হবে, বরের হলুদ এর অনুষ্ঠানে সামিল হওয়ার জন্য। কিন্তু কি আর করা। মনে মনে ভাবলাম, দেরী করে পৌঁছালেও আমার সুটকেসগুলো যেন আমার সাথে সাথে পৌছায়। নাহলে বিয়েতে পরার কোনো কাপড়ই থাকবেনা।

৩১শে ডিসেম্বর রাতে প্লেনের সিটে বসে আধশোয়া হয়ে ঘুম দেয়ার পরিবর্তে, ৩১শে ডিসেম্বর রাতে আমি আমার বাড়ীর ড্রইংরুমে ছেলেদের সাথে বসে টিভিতে, নিউইয়র্ক এর টাইম স্কয়ারে বলড্রপ আর লন্ডন, অস্ট্রেলিয়ার আকাশে আতশবাজি দেখলাম। আমাদের জীবন থেকে বিদায় নিল ২০২২ সাল। আমরা সবাই হ্যাপি নিউ ইয়ারস এর আমেজে অভিভূত হলাম। 

২০২৩ সালের ১লা জানুয়ারি সকালে, প্রথম ঘুম থেকে উঠলাম কাশির দমকে। কাশি কমার কোনো লক্ষণই নেই। সারা সকাল ও সারা দুপুর কাটলো একটু পরপর ফ্লাইট স্ট্যাটাস চেক করতে। অস্টিন থেকে ডালাসগামী ফ্লাইট বিলম্ব হলো কিনা এই ভয়ে। দিনের শেষে বিকেলবেলা আমার ফ্লাইট এবার সময় মত ছাড়ল। বছরের প্রথম দিনে আমার দুই পুত্র ও তাদের বাবাকে ছেড়ে আমি ঢাকার উদ্দেশ্যে প্লেনে চড়ে বসলাম। 

আমার সাথে সাথে আর একজন যাত্রায় যোগ দিলেন - কাশি। কাশি আমার সঙ্গ ছাড়ল না। কাশি নিয়েই প্লেনে উঠতে হলো। সারাটা রাস্তা যক্ষ্মার রোগীর মত খুক খুক করে কাশতে লাগলাম। প্রতিবার কাশি দিতেই আমার পাশের সীটে বসা ভদ্রমহিলাটি নড়েচড়ে বসে, এবং তার আর আমার মাঝখানের ক্ষুদ্র দূরত্বটা বাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে। কিন্তু বিধি বাম। বর্তমান সময়ে উড়োজাহাজের আয়তন-দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতায়-ক্রমাগত কমেই চলেছে। দুটো সীটের মাঝখানে এতোই কম ব্যবধান যে কাঁধের সাথে কাঁধ না মিলিয়ে দু'জন যাত্রীর পাশাপাশি বসা কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। আমি মনে মনে আকাশ পাতাল ভাবলাম।

ডালাস থেকে দোহা-কাতার এবং দোহা থেকে ঢাকাগামী ফ্লাইট ঠিক সময় মতই ছাড়ল। তবে ঢাকার কাছাকাছি পৌঁছে শুরু হলো আর এক মজার ঘটনা.........(চলবে)


পাঠকের জন্য এর দ্বিতীয় পর্বের লিংকঃ একুশ দিনের গল্প - ২য়   

Comments

  1. পরের পর্বের অপেক্ষায় আছি ।

    ReplyDelete
  2. লেখিকার দীর্ঘপথ কি দীর্ঘতর হবে? বিয়ের অনুষ্ঠানের বিরিয়ানী কি শেষপর্যন্ত ফ্রিজ থেকে নিয়ে গরম করে পরিবেশন করতে হবে? এসব প্রশ্নের জবাবের জন্য আর কতকাল অপেক্ষায় থাকব আমরা?

    ReplyDelete
  3. খুব উপভোগ করছি এই ধারাবাহিক গল্প।

    ReplyDelete

Post a Comment