একটি ফুটবল খেলার গল্প
আর দুই দিন পরেই ফুটবল বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলা। চরম উত্তেজনায় অপেক্ষা করছে ফুটবল প্রেমী বাঙালি এবং সারা বিশ্বের দর্শক। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে আমরা ক্রমাগত বিভিন্ন সংবাদ চ্যানেলে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে দেখে চলেছি ফুটবল নিয়ে বাংলাদেশীদের চরম উত্তেজনা, উন্মাদনা। যারাই আমরা দেশে থাকি বা বাংলাদেশে বড় হয়েছি, তারাই এই দৃশ্যগুলির সাথে কমবেশী পরিচিত।
বাড়িতে
বাড়িতে বিশাল পতাকা টাঙ্গানো, ফুটপাথে
মার্কেটে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, জার্মানির
জার্সি বিক্রয়, ব্রাজিল আর্জেন্টিনার পতাকার রঙে বাড়ি
রাঙানো, প্রিয় দলের ব্যানারে ঢেকে ফেলা, শহর থেকে গ্রাম
সর্বত্র। পছন্দের দলের সমর্থনে ঝড় ওঠে হোটেলে, মোড়ের
চায়ের দোকান গুলিতে, মিছিল আর স্লোগানে ভরে যায় মুখরিত
জনপদ।
তবে আমার এই লেখাটা বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে নয়। গত বছর(২০২১) অক্টোবার মাসে অস্টিন শহরের লোকাল বাঙালি কম্যুনিটিতে অনুষ্ঠিত হয় এক অসাধারণ ফুটবল ম্যাচ। সেটা নিয়ে একটা লেখা লিখেছিলাম। সেই লেখাটা এখানে ব্লগে পোস্ট করলাম।
**একটি ফুটবল খেলার গল্প**
রবিবার বিকেলে যখন খেলা দেখার জন্য গাড়িতে উঠছিলাম তখন মনে হচ্ছিল, খেলা শেষে আজকে একজনের টিম চ্যাম্পিয়ন হবে, অন্য জনেরটা রানার্স আপ। কিন্তু কার টিম চ্যাম্পিয়ন হবে তা এখন আমাদের জানা নেই। যদিও আমার দুই ছেলে খুব স্বাভাবিক এবং শান্ত ভঙ্গীতে গাড়িতে উঠেছিল। খেলার চূড়ান্ত ফলাফল নিয়ে তাদের দু’জনের উত্তেজনা ছিল, তবে আতংক নয়। খেলায় রেজাল্টের চাইতে পারফরম্যান্স এ তারা বেশী মনোযোগী ছিল।
আমার দুই ছেলে জানে, শুধু খেলার সময়টাতেই তারা প্রতিদ্বন্দ্বী,
একে অন্যের বিপরীতে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাবে। খেলার বাইরে তারা ভাই-ভাই, অসম্ভব
কাছের দু’জন বন্ধু। যারা একই বাড়ীতে থাকে, লেখাপড়া করে, একসাথে বেড়ে উঠে, হাসি-আনন্দের
গল্পগুলো শেয়ার করে। আবার অনেক সময়, তারা দু’জন একত্রে প্ল্যান করে আব্বু-আম্মুর কাছে
একে অন্যের জন্য সুপারিশ করে।
অস্টিনে, বাঙালীদের সকার(ফুটবল) চ্যাম্পিয়নশীপ টুর্ণামেন্ট খুবই জনপ্রিয় একটি ব্যাপার। তাই এবারের আয়োজন ও প্রস্তুতি ছিল অনেক বেশী জোরালো, অনেক বেশী প্রফেশনাল। প্যান্ডেমিকের কারনে প্রায় দু’বছর আটকা থাকার পর অস্টিন বাঙালী কম্যুনিটিতে ফুটবল খেলোয়াড় এবং খেলা পিপাসু জনগণের ঢল নেমেছিল। অস্টিনের ইতিহাসে এবার প্রথম দুই প্রজন্মের খেলোয়াড়দের অংশ গ্রহনের প্রস্তুতি ছিল। তাদের মধ্যে প্রায় বিশ জনের বয়স ছিল বিশের নীচে। এদের মধ্যে আমার দুই ছেলেও অংশ নেয়।
মোট ছয়টি গ্রুপে মোট খেলোয়াড় দের ভাগ করা হয় এবং গ্রুপ গুলির সব কয়টিকে একটি করে নাম দেয়া হয়। এইসব গ্রুপের মধ্যে নির্বাচনী ম্যাচ হওয়ার পর, ফাইনাল রাউন্ডে উঠে আসে সবচেয়ে বেস্ট দুইটা দল – অস্টিন পাওয়ারস ও টেক্সাস থান্ডারস।
ভাগ্যচক্রে আমার দুই ছেলে ছিল, এই দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দলের প্লেয়ার। কাজেই, মুখোমুখি খেলা। ফিল্ডে তাদের
পজিশন এমনই ছিল যে ওরা একে অন্যকে ক্রমাগত কাউন্টার করে যাচ্ছিল। বড় ছেলে তার দলের টিম 'ডিফেন্ডার' হিসেবে তার ছোট ভাই, অপোনেন্ট দলের 'ফরওয়ার্ডকে' অনেকবার বাধার মুখে ফেলে দিয়েছে।সাইড লাইনে দাঁড়িয়ে, প্রচণ্ড সহ্য ও ধৈর্যের সাথে নিজেকে সংযত করে এই হাড্ডাহাড্ডি লড়াই উপভোগ করছিলাম। আমাকে অনেকেই প্রশ্ন করেছিলো, আমি কোন টিমকে সাপোর্ট করছি। হাসি মুখে আমার উত্তর ছিল, দুটো টিমকেই।
এটা অনেকটা এরকম একটি ব্যাপার। একজন মা’কে প্রশ্ন করা হল, তুমি কোন সন্তানকে বেশী ভালোবাসো? বাবা-মা তাদের সব সন্তানকেই সমান ভালোবাসে। এখানে কোন পক্ষ পাতিত্ত চলেনা, কোন রেষারেষি চলেনা। মনে মনে ভাবছিলাম, এই খেলাটা ড্র হলে মন্দ হয়না।
আমার ছোটবেলার একটা স্মৃতি মনে পড়ে গেলো। আবাহনী-মোহামেডান খেলা। মনে আছে, খেলার আগ দিয়ে সমগ্র বাংলাদেশ দুই ভাগে ভাগ হয়ে যেতো। আশংকার প্রহর, অপেক্ষার পালা, নিদ্রাহীন রাত, কোনটাই যেন শেষ হতো না। অবশেষে ম্যাচের দিনে এসে টেনশনে অনেকের খাওয়া, ঘুম পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যেত।
খেলা শেষ হলে আবার গোটা দেশ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যেত। আবেগপ্রবণ
বাঙালীরা তাদের ইমোশন দেখাতে কার্পণ্য করতো না। এক দলের ঝগড়াঝাঁটি, কান্নাকাটি, কথা
বন্ধ, বহু দিনের বন্ধুত্বে ভাঙ্গন, মুখ দেখাদেখি বন্ধ, মনের কষ্টে ঘুমের ওষুধ সেবন, আরো কত কি। আর অন্যদিকে অন্য
দলের বিজয় মিছিল, পাড়ায় পাড়ায় মিষ্টি বিতরণ, বাড়ীর ছাদে ফ্ল্যাগ উত্তলোন, বাজির টাকা দিয়ে রেস্টুরেন্টে
খেতে যাওয়া, আরো অনেক কিছু। খেলার ফলাফলকে কেন্দ্র করে দৈনন্দিন জীবনে নাটকীয়তার কোন
শেষ ছিলোনা।
এই সব করতে করতে আমরা সাধারণ জনতারা গুনাক্ষরেও টের পেতাম না, যে খেলার বাইরে আবাহনী–মোহামেডানের খেলোয়াড়েরা ভীষণ ঘনিষ্ট বন্ধু। তারা একসাথে আড্ডা মারে, বেড়াতে যায়, আনন্দ ফুর্তি করে,পা রিবারিক অনুষ্ঠানে সকলকে নিমন্ত্রন করে, বিরিয়ানি খায়। খেলার ফলাফল তারা খেলার মাঠেই রেখে দিয়ে আসে, নিজের সাথে নিয়ে নয়।
আমার ছেলেদের খেলাটি সেদিন ড্র হয়নি। সত্তুর মিনিটের মাথায় ভাগ্য নির্ধারণ হয়েছে। ছোট ছেলের টিম চ্যাম্পিয়ন, আর বড় ছেলের টিম রানার্স আপ। দুটা প্রচণ্ড শক্তিশালী টিমের একটি চমৎকার ফুটবল ম্যাচ আমরা অস্টিনের বাঙালীরা উপভোগ করেছি।
আমার দুই ছেলেই খুশীমনে গাড়ীতে উঠেছে, বাড়ী ফেরার উদ্দেশ্যে। একজনের হাতে চ্যাম্পিয়নশীপ ট্রফি, অন্যজনের হাতে রানার্স আপ ট্রফি। বাড়ী গিয়ে তারা একসাথে এই চমকপ্রদ খেলার গল্প করবে। হাসাহাসি করবে, একে অপরকে নিয়ে মজা করবে। কৈশোরের এই অসম্ভব সুন্দর স্মৃতিটি তারা সযতনে রেখে দেবে মনের গহীনে।
What an interesting story. Totally got intrigued by the beautiful illustrations of the impact a football tournament can make on us not only as a family but also as a nation
ReplyDelete