হুমায়ূন আহমেদ স্যার - কিছু স্মৃতি
মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে আমরা শুনছিলাম , তিনি তার জীবন থেকে নেয়া একটি অসাধারণ গল্প আমাদের বলে চলেছেন আর সেই সাথে বোর্ডের উপর আকিঝুকি করছেন ভৌত রসায়ন এর সূত্র। যুবক বয়সে তিনি যখন টিউশনি করতেন তখন তাঁর এক ছাত্রীর সাথে কি আলাপচারিতা হয়েছিল তারই এক রোমাঞ্চকর বর্ণনা আমরা শুনছি। ক্লাসের ভিতর সম্পূর্ণ নীরবতা। ক্লাসের সারি সারি বেঞ্চে বসা, আমরা রসায়ন ডিপার্ট্মেন্টের প্রথম বর্ষের টগবগে তরুণ ছাত্রছাত্রীরা কি আবেগেই না তাড়িত হচ্ছি গল্পের শেষটা শোনার জন্য। অন্য দিকে, কোনো রাসায়নিক বিক্রিয়ার বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ পরিবর্তন, বিভিন্ন মৌলিক সূত্র প্রয়োগ করে ব্যাখ্যা করে যাচ্ছেন তিনি। খুব কঠিন একটি বিষয়কে খুব সহজ একটি পদ্ধতিতে, খুব দারুণ একটি গল্প সহকারে উপস্থাপন করে চমৎকার ভাবে বুঝিয়ে দেয়ার এক অভাবনীয় ক্ষমতা ছিল আমাদের হুমায়ূন স্যারের।
গত ১৩ই নভেম্বর ছিল এই গল্পের জাদুকরের ৭৫তম জন্মদিন। স্মরণ করছিলাম বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, চলচ্চিত্র নির্মাতা, গীতিকার ও শিক্ষক শ্রদ্ধেয় হুমায়ূন আহমেদ স্যারকে। নব্বই দশকের শুরুর দিকে, আমি যখন এইচ এস সি পরবর্তী ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে ভর্তি হই, তখন আমার সৌভাগ্য হয়েছিল ফার্স্ট ইয়ারে হুমায়ূন স্যারের সাথে ক্লাস করার। কার্জন হলে আমাদের রসায়ন বিভাগ ছিল আর তিনি আমাদের ফিজিকাল কেমিস্ট্রি বা ভৌত রসায়ন পড়াতেন। তিনি ক্লাসে আসতেন, কঠিন কঠিন বিষয়গুলোকে তরলীভূত করে চমকপ্রদ উদাহরণ ও গল্পের মাধ্যমে বোঝাতেন, আর আমরা গল্প শুনতে শুনতে চট করে বুঝে ফেলতাম রাসায়নিক ক্রিয়া-বিক্রিয়া। মাথার ভেতর বসে যেত ব্যাখ্যাগুলি, সূত্রগুলি।
মনে আছে, একবার তিনি আমাদের শিখিয়ে ছিলেন কি করে রাসায়নিক প্রক্রিয়ার সুষ্ঠ ধাপ অনুসরণ করে ঘরে চা বানানো যায়। তিনি বলেছিলেন, প্রথমে চায়ের পানি ফুটতে দেয়ার সময় তাতে একই সঙ্গে চিনি মিশিয়ে দিতে হবে। পরে পানির তাপমাত্রা ১০০ ডিগ্রী সেলসিয়াস হলে বা পানি ফুটতে শুরু করলে তখন তাতে চায়ের পাতা মেশাতে হবে। এতে করে চায়ের স্বাদ বেড়ে যাবে কয়েক গুণ।আমি বরাবরই আমেরিকায় উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য আগ্রহী ছিলাম। আমাদের সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচুর সেশন জট হতো। দেশে থেকে পড়াশোনা করতে আমার ইচ্ছাই করতো না। তাই রসায়নের ফার্স্ট ইয়ারে থাকতেই আমেরিকার নিউইয়র্কের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে অ্যাপলাই করা শুরু করি। যথারীতি কয়েকটা কলেজে আমার অ্যাডমিশনও হয়ে যায়। অ্যাডমিশনের পরে বিভিন্ন কাগজপত্র ও ভিসার প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে আরো কয়েক মাস লেগে যায়। ততদিনে ফার্স্ট ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা ঘনিয়ে আসে।
আমদের নিয়ম ছিল লিখিত পরীক্ষার পরে একটা মৌখিক পরীক্ষা বা ভাইভাও দিতে হবে। ভাইভা ব্যাপারটা চিরকালই আমার কাছে খুব ভয়ংকর মনে হতো। জৈব, অজৈব ও ভৌত রসায়ন, প্রতিটি বিভাগের স্যারদের সামনে বসে তাদের প্রশ্নের উত্তর দেয়া। ভাইভার দিন আমি ভয়ে অস্থির। জৈব ও অজৈব রসায়নে কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে পেরেছিলাম কিনা মনে নেই। তবে ভৌত রসায়ন এর সময় আমি সম্পুর্ন ভয় কাটিয়ে উঠেছিলাম স্যারের প্রশ্ন করার ধরনে। তিনি আমাকে অনেক নির্ভয় ও সাহস দিয়ে ভৌত রসায়নের খুব বেসিক একটি থিওরি ব্যাখ্যা করতে বলেছিলেন। আমি খুব সহজেই স্যারের বলা গল্পগুলোর যোগসূত্র মনে রেখে থিওরিটা ব্যাখ্যা করেছিলাম। পরে জেনেছি, ফুল মার্ক্স পেয়েছিলাম ওটাতে।
আমার অ্যাডমিশনের খুব গুরুত্বপূর্ন একটি অংশ ছিল, আমার তৎকালীন শিক্ষকদের কাছ থেকে সুপারিশ পত্র বা রেকমেন্ডেশন লেটার নেয়া। হুমায়ূন স্যার তখন পরিবার নিয়ে থাকতেন শহীদুল্লাহ হলের ইউনিভার্সিটি কোয়ার্টারে। আমি আমার সুপারিশ পত্র নিতে উনার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। ক্লাসের বাইরে ঐ প্রথম দেখা উনার সাথে। যতদূর মনে পড়ে, দোতালার বারান্দার খোলা অংশটিতে উনি বসতে বলেছিলেন আমাকে। কারন উনি অনেক ধূমপান করতেন। খুব বেশী না, মাত্র বিশ তিরিশ মিনিটের কথোপকথন.....আবারো সেই মন্ত্রমুগ্ধতা, সেই আচ্ছন্নতা।
সেই সময় খুব বেশী মেয়েরা বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পড়তে আসতে চাইতো না। কেমিস্ট্রি বা রসায়নে শক্ত ভিত থাকার কারনে আমার অ্যাডমিশন হয়েছিল কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ। উনি আমাকে অনেক উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন আমেরিকায় এসে লেখাপড়া করতে। খুব খুশি হয়েছিলেন আমার এই দেশের বাইরে পড়তে আসার সাহসী পদক্ষেপ দেখে। আফসোস, সেই যুগে ফেসবুক বা স্মার্ট ফোন ছিলোনা। নাহলে স্যারের সাথে কাটানো ঐ দারুণ মুহুর্ত গুলির অসংখ্য ছবি ও সেলফি এই স্মৃতিচারণে যুক্ত করতাম।
আমেরিকায় এসে স্যারকে পেয়েছি তাঁর রচিত গল্পে, নাটকে, সিনেমায়, গানে। খবরের কাগজে, টিভি স্ক্রিনে। প্রায় তিন দশক পরে হুমায়ূন আহমেদ স্যারের কথা লিখতে বসেছি। অথচ মনের স্মৃতিকোঠায় প্রতিটা দৃশ্য জ্বলজ্বলে, জীবন্ত।
শিল্প মাধ্যমে যে কোন সৃষ্টিরই দুটি প্রধান দিক থাকে - প্রকাশ ও প্রভাব। বেশীরভাগ গুনী শিল্পীরা প্রথমটাতে পারদর্শী হয়। কিন্তু দ্বিতীয়টা আয়ত্তে আনা সব শিল্পীর জন্যে সহজ হয়না। মানুষের মনে খুব সহজে প্রভাব বিস্তার করা, আমাদের হুমায়ূন আহমেদ স্যার তা করতেন অনায়াসে।
What an excellent experience, still missing those days. Very lovely writing. Khub valo laglo.
ReplyDeleteঅসংখ্য ধন্যবাদ আমার প্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে লেখার জন্য। এটা আসলেও আপনার একটি বড় সৌভাগ্য যে আপনি তাঁর ছাত্রী ছিলেন। সত্যিই ওনাকে খুব মনে পড়ে।
ReplyDelete