ট্রিক অর ট্রিট

নিকষ কালো অন্ধকার। গাছপালা ও ঝোপঝাড়ের ভিতর দিয়ে সরু একটা রাস্তা বাড়িটার সামনে দিয়ে পেছন দিকে বাগান বা  ব্যাকইয়ার্ডের দিকে চলে গিয়েছে। সেই রাস্তা দিয়ে একদল বাচ্চা ছেলেমেয়ের দল হনহন করে হেঁটে চলেছে। তাদের পড়নে রূপকথার রাজ্যের পোশাক আশাক। সিনড্রেলা, স্নো হোয়াইট, সুপার ম্যান, ডাইনোসর, জলদস্যু, আলিবাবা । তাদের হাতে ছোট ছোট ক্যান্ডি ব্যাগ বিভিন্ন রং এর ক্যান্ডি দিয়ে টইটুম্বুর। কারো কারো ব্যাগ একদম উপচে পড়ছে। 

বাড়ীর প্রধান দরোজার সামনে এসে মাকড়সা, ঝুল, ভাঙ্গাচোরা বাক্স, আর পোকামাকড়ের স্তূপ সরিয়ে বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলো দরোজার কলিং বেল চাপলো।একটু পরেই দরোজা খুলতেই ছেলেমেয়ে গুলো স্বভাবসুলভ অভ্যাস বশত জোরে চিৎকার করে বলে উঠলো, 'ট্রিক অর ট্রিট'। অর্থাৎ, হয় আমাকে দাও অথবা আমাকে জব্দ করো। আস্তে আস্তে দরোজার ওপাশ থেকে বেরিয়ে এলো, অতিকায় লম্বা, শীর্ণ, হাড্ডিগুড্ডি অস্থি সম্বলিত একটি মানব কঙ্কাল যার হাতে একটি বিশাল ক্যান্ডি ভর্তি বস্তা এবং সে ক্যান্ডি দিতে প্রস্তুত। ভয়ে, আতংকে, বাচ্চাগুলো জোরে চিৎকার দিয়ে, কেউ কেউ ক্যান্ডি ব্যাগ ফেলে দিয়ে, যে যার মত প্রাণপণে দৌড় দিলো। পেছনে শুনতে পেলো খিক খিক করে কঙ্কালের অট্টহাসি।       

ছোটবেলা থেকেই  আমার গল্পের বই পড়ার অভ্যাস। ভূতপ্রেত, দৈত্য দানব, ডাইনি বুড়ির গল্প অসংখ্য বার পড়েছি। আমেরিকায় এসে জেনেছিলাম যে এগুলোকে স্মরণ করার জন্য বিশেষ দিবস পালন করা হয়। শুধু মাত্র স্মরণ নয়, রীতিমত ঘটা করে পালন করা হয়। আমার দেখা প্রথম হ্যালুইন ডে এর কথা এখনো মনে আছে। বিশ্বাসই হচ্ছিল না যে এরা এমন করে ভূতের বাড়ি সাজায়, বাড়ি সাজাতে অঢেল বুদ্ধি ও অর্থ খরচ করে। বাচ্চা ছেলেমেয়েরা বিভিন্ন ধরনের পোশাক পড়ে বাড়ি বাড়ি যায় ক্যান্ডি বা চকোলেট নিতে। তাদের হাতে থাকে রংবেরং এর ক্যান্ডি ব্যাগ। অনেকটা মাস্তান বাহিনী দিয়ে মহল্লায় চাঁদা তোলার মত ব্যাপার। তার উপর যদি ভয়ংকর কোনো পোশাক পরিহিত থাকে তাহলে তো কথাই নাই। তারা এক বাড়ি থেকে আর এক বাড়ি যায় আর বলে উঠে, ট্রিক অর ট্রিট। সেই বাড়ি থেকে ক্যান্ডি পেলে তার পরেরটাতে হানা দেয়।  

হ্যালুইন ডে আমেরিকান ইতিহাসে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে গেছে। তবে এর শুরু কিন্তু প্রথম আমেরিকার মাটিতে হয়নি। প্রায় দুই হাজার বছর আগে থেকেই ইংলিশ ও আইরিশ জাতিরা এই উৎসব পালন করতো।  তারা বিশ্বাস করতো যে অক্টোবরের ৩১ তারিখে ভয়ংকর, অন্ধকার রাজ্য থেকে জগতের মৃত ব্যাক্তিরা তাদের স্বজনদের দেখতে ফেরত আসে। এছাড়া, যত ভুতপ্রেত, পিশাচ, দানব, অশরীরী আত্মা আছে, যথাযথ মন্ত্র পড়ে কোনো প্রাণী বিসর্জনের মাধ্যমে রক্ত বলি দিয়ে যদি তাদেরকে ডাকা হয়, তাহলে তারা আবার জেগে উঠে এবং মাটির তলা থেকে বেড়িয়ে আসে। সে সময় ক্যাথলিক চার্চ এটা অনুমোদনও  করে। 

১৮৪০ এর দশকে আইরিশ ও ইংলিশ ইম্মিগ্র্যান্টরা যখন প্রথম কলোনি গড়ার উদ্দেশ্যে আমেরিকায় আসে তখন থেকে আমেরিকায় এর প্রচলন হয়। এর প্রথম শুরু নিউ ইংল্যান্ড অঙ্গরাজ্যে যেখানে কিনা অক্টোবারের শেষ দিনে ভূত তাড়ানোর উদ্দেশ্যে তারা বিভিন্ন ধরনের পোশাক ও মুখোশ পড়ে মিলিত হতো এবং তাদের হারভেস্ট বা নবান্ন উৎসব পালন করতো। আমেরিকায় সেপ্টেম্বর-অক্টোবার মাস বিভিন্ন ফল ফসলাদি উৎপাদনের মাস। নবান্ন উৎসবে আগুন জ্বালিয়ে এর চারিদিকে বসে তারা বিভিন্ন ধরনের ভয়ংকর গল্পও পাঠ করতো।

হ্যালুইন ডে'তে প্রধানত পাঁচ ধরনের রীতি অনুসরন করা হয়। ১)জ্যাক-ও -ল্যান্টার্ন তৈরি করা। এটা করার জন্য আমেরিকানরা পাম্পকিন বা মিষ্টি কুমড়ার ক্ষেতে দিয়ে সবচেয়ে উপযুক্ত কুমড়াটি বেছে নেয় অথবা দোকানে গিয়ে একটা পছন্দ মত কুমড়া কিনে আনে। এরপর গর্ত করে কুমড়ার ভেতর থেকে সব চেঁচে ফেলে দিয়ে কুমড়ার গায়ে ছুরি দিয়ে কেটে চোখ, নাক, মুখ খোদাই করে ও এর ভেতর একটা মোমবাতি বসিয়ে দেয়। রাতের বেলা এই মোমবাতি যখন জ্বলে তখন আলো আধারির খেলায় সেটি একটি ভয়ংকর দানবের মুখে পরিণত হয়।

২)অন্য জগতের বাসিন্দাদের মুখ বা চেহারা সম্বলিত কোনো পোশাক পড়া। হতে পারে তা কোনো ভুত, প্রেত, দৈত্যদানব, ডাইনি বুড়ি, ড্রাকুলা, রক্তপায়ী পিশাচ, বাদুড় বা বিড়াল এর মুখওয়ালা কোনো কস্টিউম বা পোশাক। খুব ছোট বাচ্চারা ভয়ঙ্করের পরিবর্তে কোনো রুপকথা গল্পের চরিত্রের পোশাক পড়ে থাকে।

৩)পাড়ার ভেতর বাড়ি, বাড়ি গিয়ে চকলেট বা ক্যান্ডি সংগ্রহ করা। এটা ছোট বাচ্চাদের সবচাইতে প্রিয় বা শখের কাজ। ঘোরাঘুরি শেষে বাড়ি ফেরে তারা প্রবল আনন্দে চকলেট গুনে এবং প্রিয় বন্ধুদের সাথে দেয়া নেয়া করে। এরপর সারা সপ্তাহ ধরে মনের আনন্দে ক্যান্ডি খায়। ৪)পাড়ার মধ্যে কেউ ভূতের বাড়ি সাজালে সেটা পরিদর্শনে যাওয়া। ৫)বন্ধুবান্ধব বা পরিবারের সদস্যরা একত্রিত হয়ে পিলে চমকানো মুভি বা সিনেমা দেখা।

উনিশ শতকের শুরুর দিকে টেলিফোন আবিষ্কারের আগে, আমেরিকায় হ্যালুইন কার্ড পাঠানোর প্রচলন ছিল। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে চকলেট প্রস্তুতকারক বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গুলো, অ্যাডভার্টাইজিং এর মাধমে হ্যালুইন উৎসবে চকলেট বিলানোর অভিনব কৌশল মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেয়। পরবর্তীতে সময়ের বিবর্তনে, আমেরিকায় হ্যালুইন একটি জাকজমনপূর্ণ ও অত্যন্ত ব্যবসাভিত্তিক দিবসে পরিণত হয়। 

২০২১ সালে করা এক জরীপ অনুযায়ী, একেকজন আমেরিকান নাগরিক এই হ্যালুইন উৎসবে পোশাক, চকলেট এবং গৃহসজ্জার সামগ্রী বাবদ প্রায় একশো ডলার পর্যন্ত খরচ করে থাকে। বিভিন্ন শহরে হ্যালুইন ডে প্যারেড অনুষ্ঠিত হয়। স্কুলে, অফিসে, পাড়ার ভিতর  হ্যালুইন পোশাক পরিধানের প্রতিযোগিতা হয়। জ্যাক-ও-ল্যান্টার্ন তৈরিরও প্রতিযোগিতা হয়। ২০২০ সালের অক্টোবারে ক্যালিফোর্নিয়ায় অনুষ্ঠিত সর্বোচ্চ ভারী জ্যাক-ও-ল্যান্টার্ন প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরুষকার পাওয়া কুমড়াটির ওজন ছিল দুই হাজার তিনশ পঞ্চাশ পাউন্ড। 

মজার ব্যাপার হল, যেই আইয়ার ল্যান্ডে এই উৎসবের উৎপত্তি, সেখানে কিন্তু মিষ্টি কুমড়ার পরিবর্তে টারনিপ বা শালগম ব্যবহার করার প্রচলন ছিল। আর হ্যালুইন এর দিনে আইরিশ জাতিরা কস্টিউম পড়ার পরিবর্তে আকাশে ফায়ারওয়ার্ক্স  বা আতশবাজি দেখে এবং ক্যান্ডির বদলে ফ্রূট কেক খায়। আমেরিকান জাতির মত, ধার করা ট্র্যাডিশন নিয়ে বিরাট বড় হৈ চৈ বা আদিখ্যেতা করার প্রবণতা তাদের মধ্যে নেই। অথবা কোনো উৎসবকে পুঁজি করে ব্যবসায়িক মুনাফা অর্জনের কৌশলও তাদের বিবেচনায় নেই।  

সবসময়ই দেখেছি, হ্যালুইন ডে এর সাথে কমলা ও কালো, এই দুটো রং এর আধিক্য। কমলা রং মার্কিন মুলুকের হেমন্ত কাল বা নবান্ন উৎসবকে প্রতিফলিত করে। আবার এই কমলা রং মিষ্টি কুমড়ারও রং। অন্যদিকে কালো রং, জগতের যা কিছু অশুভ এবং অন্ধকার তারই জোরালো প্রতীক। অনেক আমেরিকানের মতে, এই হ্যালুইন উৎসব মানুষের জীবনে মৃত্যুর পুর্বের এবং মৃত্যুর পরের দুটো জগতের সীমানার কথা মনে করিয়ে দেয়। 

অনেক ক্রিশ্চিয়ান ও ইহুদি  ধর্মাবলম্বীর মানুষেরা এবং মুসলিম ধর্মের অনুসারীরা এই উৎসব পালনে বিশ্বাসী নয়। তার কারন হল, এই উৎসবের উৎপত্তি এমন এক সময়ে যখন পেগান সম্প্রদায়ের মানুষেরা এক বা একাধিক দেবতায় বিশ্বাস করতো বা মূর্তি পূজা করতো।  একজন সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস বা সুনির্দিষ্ট কোন ধর্মের সুচনা তখনো এই পৃথিবীতে হয়নি।

এখানকার স্কুলগুলোতে হ্যালুইন উপলক্ষে বিশাল কর্মকাণ্ড অনুষ্ঠিত হয়। আমার ছেলেরা যতদিন প্রাইমারি স্কুলে ছিল, পঞ্চম বা ষষ্ঠ শ্রেণী পর্জন্ত তারা খুব জোরেসোরে এটা পালন করেছে। এরপর আস্তে আস্তে হ্যালুইন এর উৎসাহ তাদের মধ্যে অনেকটা কমে এসেছে। তাই অক্টোবার মাস এলেই আমার আগে থেকে দুশ্চিন্তা শুরু হয়না, এ বছর ছেলেরা কোন পোশাক কিনতে চায় বা কনকনে ঠাণ্ডার ভেতর তাদের নিয়ে বাড়ি বাড়ি ক্যান্ডি চাইতে যেতে হবে। 

শুধু আগে থেকে কয়েক ব্যাগ ক্যান্ডি কিনে রাখি আর হ্যালুইন এর দিন সন্ধ্যা হলেই দরোজার সামনে জ্যাক-ও -ল্যান্টার্ন জ্বালিয়ে অপেক্ষা করি। এই বুঝি ছোট ছোট ছেলেমেয়ের দলগুলো এলো। কলিং বেল চাপতেই আমি দরোজা খুলবো আর শুনবো, অসীম উৎসাহ, গভীর আনন্দ ও অপেক্ষা মেশানো তাদের মিষ্টি কণ্ঠস্বর, 'ট্রিক অর ট্রিট'।

 

Comments

  1. Wonderful! In fact it is a very amusing festival. Thank you for writing about Halloween.

    ReplyDelete
  2. Very informative. Enjoyed reading the history of Halloween

    ReplyDelete
  3. Very informative and all possible explanations are provided.

    ReplyDelete

Post a Comment