স্বপ্নের দেশটি কেমন বদলে গেলো

রোজার ঈদ এর ঠিক আগ দিয়ে একটা দারুণ খবর সোশ্যাল মিডিয়ায় বাঙালীদের মধ্যে খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। রাজশাহীর এক মিষ্টি দোকানদারের দুই ছেলে ছুটিতে বাড়ি এসে বাবার সাথে দোকানে বসে আর তার কাজে হাত লাগায়। এক ছেলে বিসিএস ক্যাডারের উর্ধতন কর্মকর্তা, অন্যজন কলেজে শিক্ষকতা করেন।  উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও তারা তাদের শেকড় ভুলে যাননি। আর তাইতো বাড়ী এসে তারা বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করেননি বাবার সাথে দোকানে বসতে। খবরটা ছিল খুবই হৃদয়গ্রাহী, একেবারে মনের গভীরে ছুঁয়ে যায়।

সত্যি, একজন পিতার জন্য এটা এক চরম পাওয়া। তিনি অনেক কষ্ট করে মিষ্টির দোকান চালিয়ে তার সন্তানদের বড় করেছেন, শিক্ষা দিয়েছেন। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা, তিনি ছেলে দুটোকে পরিপূর্ণ মানুষ করেছেন। কাজের ছুটিতে বাড়ি এসে তারা হয়ে গিয়েছেন বাবা মায়ের পরিবারের দুই সদস্য। তারা দুটি ভাই, বাবা মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে কষ্টের ঋণ শোধ করতে চেয়েছেন, তাদের কষ্টের বোঝা ভাগ করে নিয়ে। সামাজিক অবস্থান, আর্থিক সংগতি বা কর্মক্ষেত্রের সাফল্য কোনটাই ছেলে দুটির মধ্যে বিভেদ বা বৈষম্য তৈরি করতে পারেনি।    

প্রায় দু'মাস আগে এই লেখাটি যখন প্রথম লিখতে শুরু করি তখন ভেবেছিলাম, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ঘটে যাওয়া ভালো ভালো কিছু ঘটনার কথা লিখবো, যেগুলো থেকে শিক্ষণীয় অনেক কিছু আছে।  কিন্তু বাস্তবে সেরকমটা হলো না। আমেরিকার টেক্সাস অঙ্গরাজ্যে ঘটে যাওয়া একটি ভয়াবহ, মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড আমার সব মনোযোগ ঐ দিকে ধাবিত করলো। একটি প্রাইমারী স্কুলে চতুর্থ শ্রেণীর ১৯ জন শিক্ষার্থী ও সেই সাথে দুইজন শিক্ষিকার অকাল মৃত্যু। একজন মানসিক বিপর্যস্ত ১৮ বছরের তরুণের গুলিতে অসহায় শিশুগুলির প্রাণপ্রদীপ নিভে যায়। তরুণটি এই সাংঘাতিক হত্যাযজ্ঞ ঘটানোর আগে বাড়িতে তার দাদীকে গুলি করে তবেই স্কুলের উদ্দেশ্যে রওনা হয়।

এই একুশটি পরিবারের সদস্যদের জীবন ২৪শে মে এর পর থেকে চিরতরে বদলে যায়। বদলে গেছে, যে ছেলেটি এই অপকর্মের জন্য একশো ভাগ দায়ী তার পরিবারের সদস্যদের জীবন। ইউভালদে নামক স্প্যানিশ ভাষী নাগরিকদের ছোট্ট শহরটিতে ছেলেটির পরিবারের কোন সদস্য আর মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবেনা। বিভিন্ন নিউজ মিডিয়ার সূত্র মতে জানতে পারলাম, ঐ ছেলেটির অস্বাভাবিক আচরণ ও জীবনপ্রণালির জন্য তার পরিবার ও স্কুলের পরিবেশ অনেকাংশে দায়ী। 

ছোটো বেলা থেকে ছেলেটির কথা বলার সমস্যা ছিল, তোতলামির অভ্যাস ছিল। এটার কারনে সে স্কুলে বন্ধুবান্ধব দ্বারা অনেক ভাবে নিগৃহীত হতো। ফলশ্রুতিতে তার ভেতরে অনেক রাগ, ক্ষোভ, আক্রোশ কাজ করতো যেটার বহিঃপ্রকাশ ঘটতো নিষ্ঠুর কার্যকলাপের মাধ্যমে। ছেলেটি পশুপাখির ওপর নির্যাতন করতে পছন্দ করতো। বাড়ীতেও স্বাভাবিক পরিবেশ ছিলোনা। কাজের কারনে বাবা বেশীর ভাগ সময় অন্য শহরে থাকতো। মা এর সাথে সব সময় লেগে থাকতো ঝগড়া, বিবাদ, কলহ। সেই কারনে মা ছেলেটিকে দাদীর বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। হাইস্কুলে ওঠার পর সে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। গত বছরের জন্মদিনে ছেলেটি বোনের কাছে আবদার করে তাকে বন্দুক কিনে দেয়ার জন্য। স্বাভাবিক কারনেই বোন আবদার মেটাতে রাজী না হওয়ায়, সে অপেক্ষা করে থাকে কখন ১৮ বছরে পড়বে এবং নিজেই বন্দুক কিনবে।

মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে আঠারোতে পরেই সে তার সবথেকে আকাংখিত উপহারটি কিনে ফেলে এবং তার ক্রয় রশিদ ফলাউ করে সোশ্যাল মিডিয়াতে পোস্ট করে। সাথে সাথে পোস্ট করে তার কুঅভিলাষের কথা, সে একটি প্রাইমারী স্কুলে গিয়ে বাচ্চাদের মারবে এবং স্কুলের সবাইকে মারবে। তার নিকট বন্ধুদেরও এই মেসেজ গুলো পাঠায়। তারা কেউ কেউ মেসেজ পড়ে ভরকে গেলেও, এই দুরভিসন্ধির কথা পুরাপুরি বিশ্বাস করেনি। তবে সকলেরই এই ধারণা হয়েছে যে ছেলেটি বদলে গেছে। এর পরের ঘটনা, আমাদের সবার জানা।

আমেরিকায় স্কুল শুটিং কোনো নতুন ঘটনা নয়। সারা দেশে এই বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ইতিমধ্যে তেইশটি স্কুল শুটিং এর ঘটনা ঘটেছে। তবে সবগুলো বিস্তৃত পরিসরে খবরে আসেনি, তাই আমাদের নজরেও পরেনি। ইউভালদে স্কুল শুটিং এর খবরটা নতুন করে আবার আমাকে আতংকিত করে তুলল। এই দেশের স্কুল সমাজে গোলাগুলি, ছাত্রছাত্রী হত্যা, বোমা ফাটানোর ঘটনা গুলো কেমন যেন স্বাভাবিক আকার ধারণ করছে। 

আমার দুটো ছেলেও উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষার্থী। এইতো কিছুদিন আগে স্কুল চলাকালীন সময়ে ওদের প্রিন্সিপালের কাছ থেকে মেসেজ আসলো, যে একজন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি স্কুল প্রাঙ্গনে বোমা রেখেছে বলে জানিয়েছে। সাথে সাথে পুরা স্কুল লকডাউন করে পুলিশ ও সোয়াট টিম এসে স্কুল প্রাঙ্গনে শুরু করলো বিস্তর খোঁজাখোজি। বাইরে ও ভিতর থেকে যে কারো স্কুলে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হলো, এটা স্ট্যান্ডার্ড প্রোটোকল। প্রায় দু'ঘন্টা ধরে চলল এই শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। অবশেষে আবিষ্কৃত হলো, ওটা ছিলো কারো প্র্যাঙ্ক বা তামাশা। আসলে কেউ বোমা রাখেনি। কিন্তু ব্যাপার হলো, কখনো কখনো এটা তামাশা না হয়ে  সত্যি হতে পারে এবং হয়েছেও।

এর কিছুদিন পরে ঘটলো আরো একটি শুটিং এর ঘটনা। ৪ঠা জুলাই আমেরিকার স্বাধীনতা দিবসের উইকেন্ডে আমরা গিয়েছিলাম  উইসকনসিন স্টেটে বেড়াতে। ঐ দিন ঠিক তার পাশের লাগোয়া স্টেট ইলিনয়ের একটি সীমান্তবর্তী শহরে অবস্থিত হাইল্যান্ড পার্কে প্যারেড চলাকালীন সময়, একজন বন্দুকধারী পাশের একটি উঁচু ছাদের উপর থেকে গুলি করে প্রায় অর্ধশত মানুষকে। এর মধ্যে আটচল্লিশ জন জখম ও সাত জনের মৃত্যু হয়। ঐ ঘটনার সময় আমরা খুব কাছাকাছি উইসকনসিনের একটি শহরে অবস্থান করছিলাম। পুলিশ বিজ্ঞপ্তিতে জানা গেছে, বন্দুকধারীর প্ল্যান ছিল এর পরে উইসকনসিন এর একটি শহরে গিয়ে মানুষ মারার। কে জানে, হয়তো এটা হতে পারতো আমরা যে শহরে ছিলাম, সেটিই। 

খুব লজ্জাজনক হলেও সত্যি, এ বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত আমেরিকায় ইতিমধ্যে তিনশ'র বেশী 'মাস শুটিং' বা গণ হামলার ঘটনা ঘটেছে। এই সংখ্যাটি পৃথিবীর যে কোনো দেশের তুলনায় অনেক অনেক বেশী। সারা আমেরিকার বিভিন্ন স্টেটে প্রতি সপ্তাহে একটি করেতো ঘটছেই, মাঝে মাঝে দুতিনটা করে শুটিং এর ঘটনা ঘটছে যার সব গুলো খবরে আসছে না। স্কুল, শপিং মল, সুপার মার্কেট, সিনেমা হল, নাইট ক্লাব, অফিস, রেস্তোরা, মিউজিক কনসার্ট, পার্ক, রাস্তাঘাট এমন কোন জায়গা বাকি নেই যেখানে জনসমাবেশে কোনো না কোন হামলার ঘটনা ঘটে নাই। করোনা ভাইরাসের মতই যে কেউ, যে কোনো সময় এই ভয়াবহ আক্রমণের শিকার অনায়াসে হতে পারে।  

একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এই দেশের মোট জনসংখ্যা যত, তার থেকেও অধিক পরিমাণ বন্দুক বা আগ্নেয়াস্ত্র কিছু মানুষের হাতে এখন বিদ্যমান আছে। যা কিনা মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ মানুষ। নিজেদের নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে লাগামহীন অস্ত্র ক্রয় এবং তার যত্রতত্র ব্যবহারের মধ্য দিয়ে আমেরিকানরা একটি যুদ্ধবাজ, মারকুটা জাতিতে পরিণত হচ্ছে। কাউকে পছন্দ না হলে, কারো সাথে বনিবনা না হলে, প্রেমে প্রত্যাখান হলে, প্রতিশোধ নিতে চাইলে, মাথায় রাগ উঠে গেলে, পুরোনো ক্ষার মেটাতে - এরকম বহুবিধ কারনের বশবর্তী হয়ে আমেরিকানরা হাতে তুলে নিচ্ছে বন্দুক, রাইফেল, মারণাস্ত্র।  

আর সেটা করতে পারছে দুটি কারনে। এক, তাদের বাড়িতেই মজুদ আছে আগ্নেয়াস্ত্র যা আগের থেকে বাবামা বা অন্যান্য সদস্য দ্বারা কেনা। অথবা দুই, দোকানে গিয়ে কোনো রকম ব্যাকগ্রাউন্ড চেক বা মানসিক সুস্থতার স্ক্রিনিং ছাড়াই আঠারো বছর বয়সী বা উর্ধের যে কেউ এগুলো সহজে কিনতে পারছে।

অনেক অপরাধ বিজ্ঞানী ও মানসিক বিশেষজ্ঞদের মতে আমেরিকানদের এরকম হত্যাপ্রিয় মনোবৃত্তির অনেক গুলো কারন রয়েছে। খুব ছোটবেলায় অনেক ধরনের পারিবারিক নির্যাতনের শিকার। স্কুল, কলেজে অতিরিক্ত বুলিং বা অপমান, অপদস্তের শিকার। যাদের দ্বারা এক সময় নির্যাতিত, নিগৃহীত তাদের উপর প্রতিশোধ নেবার প্রবল ইচ্ছা। নিজের জীবনের প্রতি কোনো মায়া না থাকা বা এর গুরুত্ব না বোঝা। আর একটি কারন খুব অবাক হওয়ার মত - রাতারাতি ফেমাস বা জনপ্রিয় হওয়ার বাসনা। সাধারণত এইসব সাংঘাতিক হত্যাকাণ্ড গুলো যখন ঘটে, তখন এদেশের মিডিয়াতে, বিভিন্ন নিউজ চ্যানেল গুলোতে যে পরিমাণ কাভারেজ দেয়, সেই পরিমাণ কোনো ভালো কাজ করলে দেয় কিনা আমার জানা নেই। 

যুগে যুগে সমাজ বিজ্ঞানীরাতো বলেই গেছেন, ঋণাত্মক কর্মকান্ডের প্রতি মানুষের একটি সহজাত আকর্ষণ সব সময় থাকবে। একটি খারাপ কাজের হোতা, আরো একজন খারাপ কাজের অনুসারীকে সাহস দেয়। আরো সাহস দেয় বিভিন্ন টিভিশো, সিনেমা, সোশ্যাল মিডিয়া, ভিডিও গেম ও কমিক বই, যেখানে প্রচুর অন্যায় কাজ ও অপকর্মের বিশদ বিবরণ ও গ্র্যাফিক চিত্র ক্রমাগত প্রচার করা হয়। সামাজিক অবক্ষয়ের চাইতে আর্থিক মুনাফা আর মিডিয়া রেটিং, এই দেশে অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ন। 

সমস্যাটা কি এবং কারণটা কি এটা পরিষ্কার ভাবে জানার পরও, সেই সমস্যা সমাধানের কোনো উপায় বা ইচ্ছে আমাদের সরকার, উর্ধতন প্রশাসন ও আইন প্রণয়নকারীদের মধ্যে তেমন একটা নেই কেনো, তা অবশ্যই ভাববার বিষয়। আপনি যদি এই দেশে থাকেন তাহলে মনে হবে, এরা কি ইচ্ছে করেই সমস্যাটা জিইয়ে রাখছে? মনে হবে, ছোট ছোট স্কুল শিশুদের মৃত্যু কি এদের মনে দোলা দেয়না? যেই দেশ এতো শক্তিশালী, সারা দুনিয়ার মানুষের সমস্যা সমাধান করে বেড়ায়, অন্য দেশের সরকারের পতন ঘটায়, সেই দেশ তাদের একটি আভ্যন্তরীন সমস্যা কেন শক্ত হাতে সমাধান করতে পারছেনা? কথা হল, মার্কিন সমাজ ও রাজনীতির আনাচে কানাচে অলিগলিতে চিরকালই 'পাওয়ার প্লে' একটা বড় ভূমিকা রেখে আসছে।

স্বপ্নের এই দেশটি কেমন যেন বদলে গেলো। আমি যখন প্রথম এই দেশে আসি সেই তিরিশ বছর আগেকার আমেরিকাকে আর খুঁজে পাইনা। আগে এরা নিরাপত্তার খাতিরে কুংফু, কারাটে, মার্শাল আর্ট, আত্মরক্ষার ট্রেনিং নিত। এখন এরা নিরাপত্তার খাতিরে দোকানে গিয়ে বন্দুক কিনে আনে। বন্দুক চালানোর ক্লাসে ভর্তি হয়।

মাঝখানে কিছুদিন কথাবার্তা চলল, স্কুলের শিক্ষক শিক্ষিকা ও কর্মচারীদের বন্দুক চালানোর ট্রেনিং দেয়া হবে। এতে সুফলের চাইতে কুফল যে বেশী হবে, তা বলাই বাহুল্য। যে দেশের পুলিশবাহিনী সংঘবদ্ধ অবস্থায় একজন আঠারো বছরের বন্দুকধারী ছোকরাকে সামাল দিতে ভয় পায়, সেই দেশে স্কুলের শিক্ষক শিক্ষিকা বইখাতা ফেলে দিয়ে বন্দুক হাতে তুলে নিয়ে কিভাবে শত্রু দমন করবে, ঠিক বুঝলাম না। 

আর তাই যদি হয়, তাহলেতো লেখালেখি বাদ দিয়ে আমাকেও অস্ত্র চালানোর ট্রেনিং নিতে হবে।

Comments

Post a Comment