সোনার হরিণ

গত কয়েকদিন ধরে বাংলা নিউজ ফলো করছিলাম। ঈদ এর মাত্র কিছুদিন বাকি। তাই ঈদ এর আগে ঢাকা শহরে ঈদ এর পুরোদস্তুর কেনাকাটা, কাঁচাবাজার, জনসমাগম, শহর জুড়ে আলোকসজ্জা, সেই সাথে ইফতারির রকমারি আয়োজন, এই সবকিছুর চিত্র একনজরে দেখতে পাবো বলে খুব আগ্রহ নিয়ে প্রতিদিন বাংলা খবর দেখে চলেছি। 

ঈদ বাঙালিদের একটি ধর্মীয় উৎসব হলেও এটি ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে আমাদের সংস্কৃতিতে, আমাদের জীবন প্রণালীতে। জন্মের পর থেকেই ছেলেমেয়েরা দেখে বাবা-মা ঈদের দিনে বিশেষ কিছু রীতিনীতি পালন করছে। বাড়ীর ছেলেরা সকাল বেলা পাঞ্জাবী পায়জামা পড়ে ঈদের জামাতে যায়, মেয়েরা বাড়িঘর গোছায়। মায়েরা ব্যস্ত থাকে হরেক রকম ঈদ স্পেশাল রান্নাবান্না নিয়ে। ছেলেরা নামায শেষে বন্ধু, পরিজনদের সাথে কোলাকোলি করে, ঈদ শুভেচ্ছা আদান প্রদান করে। বাড়ি ফিরে তারা মিষ্টি মুখ করে, বন্ধুবান্ধবের বাড়ীতে বেড়াতে যায়। বিকেলে পরিবারের সবাই মিলে ঘুরতে বেরোয় আত্মীয় স্বজনদের বাড়ীতে। দেখতে যায় নতুন সিনেমা বা কোনো জাতীয় উদ্যান। কারো কারো বাড়ীতে নেমন্তন্ন থাকে অন্যান্যদের। রাতভর চলে খাওয়াদাওয়া, আড্ডাবাজী, হৈ হুল্লোড়।

ঈদ এর দিনে আরো একটি আকর্ষনীয় ব্যাপার ঈদ সালামী। বাড়ীর কনিষ্ঠরা পায়ে হাত দিয়ে বয়োজ্যেষ্ঠদের সালাম করে আর তাদের কাছ থেকে পায় সালামী বা টাকা। ছোটবেলার কথা মনে পড়ে যায়। আমাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলতো, কে কত বেশী সালাম করবে আর সালামী পাবে। খবরে দেখছিলাম, ঈদ উপলক্ষে রাস্তার ফুটপাতের দোকান গুলোতে পুরনো টাকার পরিবর্তে নতুন টাকা বিক্রি হচ্ছে। তবে সেক্ষেত্রেও দামাদামি, দর কষাকষি চালাতে হচ্ছে। একজন ক্রেতা বলছিলেন, এক হাজার টাকার নোট পাল্টানোর জন্যে দেড়শ টাকা বাড়তি দিতে হচ্ছে। আর একজন বললেন, এতো ঝামেলা করেও নতুন টাকার নোট কিনতে তার কোনো আপত্তি নেই। কারন, বাড়ীতে ছেলেমেয়েরা নতুন টাকা সালামী পেয়ে খুবই আনন্দিত হয়।   

ঈদের আনন্দ শুধু এই দিনটিকে ঘিরেই সীমাবদ্ধ নয়। বরঞ্চ এটার সূত্রপাত হয় দেড় মাস আগে থেকেই। রোজার ১৫ দিন আগে শবেবরাত উদযাপন এর মাধ্যমে ঈদ আনন্দের সূচনা। হালুয়া, সুজি, ফিরনি, বরফি, চালের আটার রুটি, ভুনা মাংস সহ বহু রকমের সুস্বাদু খাবার, প্রতিবেশী আর আত্মীয়দের মাঝে বিতরন হয় এই পবিত্র দিনটিতে। বাঙালি মুসলমানরা, পরম বিশ্বাসে তাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন করার উদ্দীপনায়, ভালোবাসা আর ভালো খাবার বন্টনে ব্যস্ত হয় শবেবরাত এর রাতে। ছেলেমেয়েরা আতসবাজি, পটকা, মরিচ বোমা ফাটিয়ে আসন্ন ঈদের আনন্দ উদযাপন করে।       

রোজার মাস এলেই সবার মাঝে খুশী খুশী ভাব ছড়িয়ে পড়ে। বাড়ীর ছোট বড় সকলে মিলে সেহরি করা, রোজা রাখা, ইফতার করা, তারাবী নামায পড়া, এই সব কিছুর মধ্যেই এক ধরনের আনন্দ, এক ধরনের অপেক্ষার পালা লুকানো থাকে। এই অপেক্ষার আনন্দ পরিবার এর গণ্ডি থেকে বেড়িয়ে সারা মহল্লায় সঞ্চালিত হয়। গত কয়েক বছর ধরে ঢাকা শহরের বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট গুলিতে চল হয়েছে, ভোররাতে সেহেরী পরিবেশন করা। বন্ধুবান্ধব মিলে হৈ চৈ করে রেস্টুরেন্টের মনোরম পরিবেশে সেহেরী পার্টি করা, এখনকার তরুণ সমাজে দারুন জনপ্রিয় একটি ব্যাপার। এছাড়া তো আছেই, বাড়ীর ডাইনিং হলে, বাগানে বা রুফটপ গারডেনে, টেবিল ভর্তি খাবার সাজিয়ে আকর্ষনীয় ইফতার পার্টির আয়োজন।

মাস ধরে ঈদ এর কেনাকাটাও চলে পুরোদমে। ঈদ এর বাজার বলে কথা। জামা, জুতো, প্রসাধনী, শাড়ি, গহনা, নিত্য ব্যবহার্য জিনিস সব কিছুতেই যুক্ত হয় নতুন মাত্রা, নতুন রং, নতুন ঢং। সময় ও ঋতুকে মাথায় রেখে, ঈদ এর আমেজের বৈচিত্র্যতা মিশিয়ে, পোশাক নির্মাতা ও কারিগররা তৈরি করে আকর্ষণীয় ঘর সাজানোর জিনিস ও পরিধেয় বস্ত্র। ঢাকা শহরের ফ্যাশন হাউজগুলি ভরে ওঠে নিত্য নতুন কাপড়ের সম্ভারে। পরিবারের সদস্যরা একে অন্যের জন্যে কেনাকাটা শুরু করে। ঈদের আনন্দ বাটাবাটি হয় উপহার আদান প্রদানের মাধ্যমে। 

আমাদের সময়ে নিউ মার্কেট, গাউসিয়া মার্কেট, এলিফ্যান্ট রোড, বেলি রোড ছিল খুব জনপ্রিয় শপিং এর জায়গা। পরবর্তীতে বহুতলা বিল্ডিংএ শপিংমল আর শপিং প্লাজায় ভরে যায় ঢাকা শহর। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে, আরাম করে কেনা কাটায় অভ্যস্ত হয় ঢাকাবাসীরা। সাপ্তাহিক ছুটির দিনটিতে কোনো কোনো পরিবারের রুটিন হয়ে দাঁড়ায়, শপিং মলে গিয়ে সারা দিন কেনাকাটা, খাওয়াদাওয়া করা, সিনেমা দেখা। 

ঈদ এর আগের দিন ঘটা করে সারা দেশে চাঁদরাত পালিত হয়। ঘরে ঘরে রান্নাবান্নার আয়োজন শুরু হয়।টেবিল ভরে যায় ঈদ স্পেশ্যাল আইটেমে। বাড়ীর মেয়েরা, মনের মাধুরী মিশিয়ে অদ্ভুত সুন্দর নকশা আর মেহেদী রঙে রাঙায় তাদের হাত, পা, চুল। ঈদের খুশীতে বিউটি পার্লারে দৌড়ানোর ধুম পড়ে যায়।  মেয়ে ও মহিলারা ব্যস্ত হয় মুখমণ্ডল, ত্বক ও চুলের পরিচর্যায়। 

সবাই মিলে আনন্দ করে ঈদ এর ছুটিতে নানাবাড়ি বা দাদাবাড়ি যাওয়ার প্রথা হয়তো উঠেই গেছে। ঢাকা শহরে গত এক দশক ধরে চল হয়েছে ঈদ এর ছুটিতে দেশের বাইরে বেড়াতে যাওয়া। থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মালয়শিয়া, দুবাই এখন কিছু মানুষের ঈদ ডেস্টিনেশন। ঈদ এর পরে ঢাকায় ফিরে রকমারি ট্যুরের গল্প আর সোশ্যাল মিডিয়াতে হয় ছবি পোষ্ট। 

কেউ কেউ দেশে ঈদ করলেও, ঈদ এর শপিংটা দেশের বাইরে করতে বেশী ইচ্ছুক। সেই সাথে দেশে ফেরত এসে ঈদ শপিং এর প্রচারণা। আত্মীয়স্বজন, বন্ধু মহলে দামী উপহার আদান প্রদান এবং কারটা কত দামী বা আনকমন, সেটা খতিয়ে দেখা। অন্যেরাও থেমে নেই। অঢেল অর্থ খরচ করে, পরিবার নিয়ে বিদেশে যাওয়া যাদের সামর্থে কুলোয় না, তারা দেশের ভেতরেই সিলেট, কক্সবাজার, বান্দরবন, সেন্টমার্টিন সহ বিভিন্ন নয়নাভিরাম ট্যুরিস্ট জায়গাগুলো পরিদর্শনে যায়।

এতোক্ষন ধরে, হাসিখুশি আর নির্মল আনন্দে ভরা ঘটনাগুলোর কথা বললাম। এবার একটা বিষয় নিয়ে বলবো যা খুব করে আমাকে অবাক করেছে। এবার বলবো 'সোনার হরিণের' কথা। ঢাকা ছেড়ে যাওয়া ঘরমুখী মানুষের, ঘরে ফেরার কথা। অম্লান বদনে, হয়রানির পরোয়া না করে, তাদের ঈদ যাত্রার কথা। 

কি দুর্দান্ত চেষ্টা, পরিশ্রম ও ধৈর্য্যের পরীক্ষা তাদের দিতে হয়। খবরে বলছিলো, অতিরিক্ত গরম ও যানজটের কারনে এবার ঢাকাবাসী বহু মানুষ, বাসের পরিবর্তে ট্রেনে করে দেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তাই তারা ভিড় করতে শুরু করে কমলাপুর রেলস্টেশনে। যেখানে কিনা ঈদ এর সাত দিন আগে থেকে অগ্রিম টিকেট বিক্রি শুরু হয়। 

তবে লাইনে দাঁড়িয়ে সেই টিকেট পেতে তাদের ভোগান্তির শেষ ছিলোনা। অজস্র মানুষের গাদাগাদি ভিড়, ঠেলাঠেলি, অসহ্য গরম, রোজা, সব সহ্য করে ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা। অনেকে আগের দিন রাতে লাইনে দাঁড়িয়ে পরের দিন সকালে টিকেট পেয়েছে। অনেকে তাদের মোবাইল ফোন থেকে অনলাইনে ঢুকে কাটার চেষ্টা করছিল কিন্তু টিকেট এর দেখা পাওয়া মাত্রই স্ক্রিনে তা মুহুর্তে গায়েব হয়ে যাচ্ছিল। এখানেও অনলাইন প্রতিযোগিতার দৌড়ে অনেকে পিছিয়ে পড়ছিল। 

নিউজ রিপোর্টার বলছিলেন যে ট্রেনের টিকেট পাওয়া যেন সোনার হরিণের খোঁজ পাওয়ার সমতুল্য। টিকেট হাতে পেয়ে এই অপেক্ষমান মানুষগুলোর চোখে মুখে যে বিজয়ের আনন্দ, প্রাপ্তির প্রশান্তি হয়, তা সত্যিই দেখার মত। 

মানুষগুলো জানে বাড়ীতে বাবামা, ভাইভাবি বা শ্বশুর শাশুড়ি পথ চেয়ে বসে আছে। বাড়িতে ঈদ এর প্রস্তুতি চলছে, পছন্দের খাবারগুলো রান্না হচ্ছে। সময় মত পৌঁছে, সবার সাথে একত্রিত হয়ে পালিত হবে রমজানের ঈদ। তাই, বহু প্রতীক্ষিত এই যাত্রা পথের আনন্দে তারা বিভোর। এই সোনার হরিণই পারে একমাত্র তাদের গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দিতে।

ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ...

Comments

  1. True depiction of Eid in Bangladesh. Most of the people face a lot of hardships in celebrating the Eid festival with their near and dear ones. Mass exodus causes too much pressure on the roads, leading to tragic loss of lives that has become all too common. Sincerely hope and pray that all come back to their destination wearing the same smile they take along with them. Happy Eid!

    ReplyDelete
  2. পোষ্ট টা অনেক ভালো হয়েছে । পড়ে ভালো লাগলো ।

    ReplyDelete
  3. Enjoyable Read..Eid Mubarak to all

    ReplyDelete
  4. Awesome elaboration. You have wonderfully analyzed both the happy and sad incidents of Eid. I hope this time Eid goes well with everyone. It is one of your remarkable write ups. Keep it up.

    ReplyDelete
  5. একেই হয়তোবা বলে নাড়ির টান। ঢাকা থেকে দেশের বাড়ি, বিদেশ থেকে দেশ সেই একই টানে সবাই ছুটে যায়। আমাদের সন্তানরা কি সেই টানে ছুটে আসবে? সময়ই বলে দেবে হয়তো একদিন। ঈদ মোবারক!

    ReplyDelete
  6. You skilfully present your stories that enable readers to see two sides of them and they provide an overall picture. Your article reminded me of Eid days back home. Thanks 🙏.

    ReplyDelete
  7. Take me back to those old days again .after reading your Blog I just miss the old time and the old me .but now everything is changed. We miss the happiness we got &fun we did in past. Touched my soul .

    ReplyDelete
  8. Beautiful writing on Eid. Reminded me about old days.

    ReplyDelete

Post a Comment