গুরু নাকি বন্ধু?
ছোটোবেলা থেকে জেনেছি, শিক্ষক/শিক্ষিকা হলেন গুরুর মত। বাবা-মা এর পরপরই তাদের অবস্থান। তাদের দেয়া আদেশ, উপদেশ বা তাদের থেকে পাওয়া উৎসাহ, অনুপ্রেরণা হলো জীবনের শ্রেষ্ঠ পাথেয়। তাদের বলা কোনো কথা, কটূক্তি, তা সে যতই অসম্মানের বা অপমানসূচক হোক না কেন, তা হজম করে নেয়াই ছিলো সকল ছাত্রছাত্রীর কর্তব্য।
শিক্ষক শিক্ষিকারা যতই স্নেহশীল, উদার বা নরম মানসিকতার হোন না কেনো, আমরা কখনই ভাবতাম না যে উনারা আমাদের বন্ধু, বা বন্ধুসম। তাদের প্রতি শ্রদ্ধা বা ভক্তি কখনই বন্ধু পর্যায়ে নামতো না।
আমেরিকা ও বাংলাদেশের শিক্ষকতার মাঝে আছে আকাশ, পাতাল তফাৎ। আমেরিকায় আমার সন্তানদের জন্ম ও স্কুল করা এবং বহুদিন ধরে আমেরিকার পাবলিক স্কুল সিস্টেমের সাথে সংযুক্ত থাকার কারনে কিছু ব্যাপার সহজেই লক্ষ্য করেছি। এ দেশের স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা প্রায়ই শিক্ষক এর সাথে বন্ধুর মত আচরণ করে। তারা অকপটে নিজেদের সমস্যার কথা আলাপ করে। অনেক সময় তারা চায়, টিচার তাদের সমস্যা থেকে পরিত্রান পাওয়ার সঠিক পথ দেখাক।
টিচারও যথেষ্ট সহানুভূতিশীলতা দেখায়, সহমর্মিতা দেখায়। আবার সেও অকপটে তার নিজের পারিবারিক বা সামাজিক জীবনের বৃত্তান্ত ছাত্রছাত্রীদের সাথে আলাপ করে। কার কি পছন্দ বা অপছন্দ, গ্রীষ্মের ছুটিতে কোথায় বেড়াতে যায়, পোষা প্রানী, ছেলেমেয়েদের নাম, তারা কত বড় এবং কি করে, প্রিয় বন্ধু, এই সব কিছু। তাদের পরিবারের ছবি ও বন্ধুদের ছবি নিয়ে এসে ক্লাসের ছেলেমেয়েদের সাথে শেয়ার করে।আমেরিকার
পারিবারিক ও সামাজিক অবকাঠামো এই শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্ক স্থাপনে বিরাট ভূমিকা পালন
করে। খুব ছোট বয়স থেকেই স্কুলে ও বাড়ীতে বাচ্চাদের শেখানো হয় - তোমরা সকল ব্যাপারে
নিজেদের সিদ্ধান্ত নাও, নিজেদের মতামত প্রকাশ করো। বাড়ীতে প্রায়ই যে কোনো বয়সী সন্তানদের মতামত নিয়েই তারপর পিতামাতা কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়। স্কুলের টিচার তার শিক্ষা সংক্রান্ত কারিকুলামের কোনো কোনো পর্যায়ে, ছাত্রছাত্রীদের মতামত নিয়ে লেকচার এর টপিক বা পড়ানোর ধরন
মনঃস্থির করে।
তবে, ক্লাসের ছাত্রছাত্রীর সাথে কথা বলার সময় শিক্ষক এর
যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। প্রতিটি স্কুলবোর্ড খুব নির্দিষ্ট ও
জোরালো ‘কোড অফ এথিকস’ ফলো করে। টিচার দ্বারা এটা ভঙ্গ হলে যদি ছাত্রছাত্রী বাড়ি গিয়ে কোনো ঘটনার
বিবরণ দিয়ে তাদের বাবা মা'কে নালিশ করে,
তবে সাথে সাথে স্কুল কতৃপক্ষ সেই টিচার এর বিরুদ্ধে আইনানুগ
ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। আর তখন দেখা যায়, বাবামা ছেলেমেয়ের সাথে একজোট হয়ে শিক্ষক শিক্ষিকার বিরুদ্ধে যেতে কুণ্ঠা বোধ করে না।
আমি যখন দেশে প্রাইমারি, মাধ্যমিক/উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল করেছি, তখনকার কথা ছিলো সম্পূর্ণ আলাদা। গুরুসম শিক্ষকের বিরুদ্ধে যাবো - এধরনের একটা ব্যাপার কখনো কল্পনাতেও আসতো না। কখনো যদি বাড়ী এসে বলতাম যে টিচার বকা দিয়েছে, তাহলে মা প্রথমে ভাবতো নিশ্চয়ই আমি কিছু দোষ করেছি। বন্ধুদের মধ্যে এমন অনেক গল্প শুনেছি যে কেউ একজন স্কুলে টিচার এর দেয়া শাস্তি পেয়েছে, তারপর বাড়ি এসে পুনরায় বাবামা'র দেয়া শাস্তি পেয়েছে। তার কারন, সে স্কুলে থাকতে কোনো গর্হিত কাজ করে বাবামা ও পরিবারের সম্মানহানি করেছে। তাই তার ডাবল শাস্তি পাওনা হয়েছে।
আবার দেশে থাকতে এটাও দেখেছি যে, উপরমহল থেকে চাপ আসলে কোনো একজন শিক্ষকের করা অন্যায় কাজ মেনে নেয়া হচ্ছে বা ধামাচাপা দেয়া হচ্ছে। এটা অবশ্য আমেরিকার প্রাইমারি বা মাধ্যমিক স্কুলে একদমই চিন্তা করা যায়না। শিক্ষক, শিক্ষিকা বা ফিজিকাল এডুকেশন কোচ, গোপনে কোনো অন্যায় কাজ করলেও, একবার তা জানাজানি হয়ে গেলে স্কুল প্রশাসন ঐ ব্যাপারে যথাযথ কড়া ব্যবস্থা নেবে। স্কুলের কোনো ঘটনায় বাবামা তাদের সন্তান এর পক্ষ নিলেও, স্কুল কতৃপক্ষ কিন্তু শিক্ষকের সম্মান বজায় রেখে দুই পক্ষের মধ্যে নিরপেক্ষ ভাবে একটা সুষ্ঠ সমাধানের চেষ্টা করবে।
নিজেদের ব্যাক্তি স্বাধীনতা ও বাক স্বাধীনতা রক্ষার ব্যাপারে আমেরিকানরা খুবই সোচ্চার এবং জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে তারই প্রতিফলন দেখা যায়। বাড়ীর পরিবেশ এবং পরিবারের সম্মিলিত মানসিকতা সেই পরিবারের সন্তানের মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আর এই চিন্তাধারা খুব সূক্ষ্মভাবে ছাত্রছাত্রী থেকে স্কুল কালচারে প্রবেশ করে এবং পুরোদমে চর্চিত হয়। ছাত্রছাত্রীরা অধিকাংশ ব্যাপারে তাদের নিজস্ব মতামত জাহির করতে করতে এক সময় নিজেদের শিক্ষকের সমকক্ষ ভাবতে শুরু করে। তাদের কাছ থেকে আসা শিক্ষকের জন্য শ্রদ্ধা বা ভক্তির পরিমাণটা ক্রমাগত কমতে শুরু করে।
একটা বিষয় মনে করে খুব অবাক লাগে। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ও উন্নত দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আমেরিকায় সব কিছুর এতো প্রাচুর্য - অর্থবিত্ত, প্রভাব, প্রতিপত্তি, প্রযুক্তি, আহার, বাসস্থান, প্রাকৃতিক সম্পদ। কিন্তু একটা বিষয়ের এতো অভাব, তা হল সম্মান ও শ্রদ্ধা। হোক না তা বাবামা’র প্রতি, শিক্ষকের প্রতি, গুরুজনের প্রতি, অন্য ধর্মের প্রতি, অন্য বর্ণের প্রতি, অন্য গোত্রের প্রতি। এই একটা ব্যাপারে তাদের সাংঘাতিক কার্পণ্য। অথচ শ্রদ্ধা ও সম্মান দেখাতে কোনো টাকা লাগেনা।
অর্থনৈতিক বিচারে শিক্ষকতা পেশার অবস্থান কোথায়, সেটার একটা পরিপুর্ন প্রতিফলন দেখা যায় তার
বাৎসরিক আয়ের দিকে তাকালে। গ্লোবাল টিচার স্ট্যাটাস ইনডেক্স এর দ্বারা বিভিন্ন দেশ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে একটি
জরীপে দেখা যায়, পয়ত্রিশটি দেশের মধ্যে চায়না ও মালায়শিয়া সবচেয়ে উপরের দুটি স্থান
দখল করে আছে, যে দুটি দেশে শিক্ষকতাকে অত্যন্ত সম্মানিত পেশা হিসাবে গন্য করা হয়,
একেবারে ডাক্তারি পেশার সমকক্ষ হিসাবে। তৃতীয় অবস্থানে ছিল রাশিয়া। এছাড়া, ভূটান,
নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও জাপানে, শিক্ষক শ্রেণীর মানুষেরা
সবচেয়ে বেশী আয় করে থাকে।
বলাই বাহুল্য, এই লিস্টে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান অনেক নীচের দিকে ছিল। পরিপূর্ন সম্মান বা যথাযোগ্য আয় কোনোটাই আমেরিকায় বসবাসরত শিক্ষক শ্রেণীর ভাগ্যে জোটেনা। উপরোন্তু তারা সবসময় একটি কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর মত অবস্থায় বিরাজমান থাকে। কোনো ধরনের সামাজিক বা অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কারন হিসেবে প্রথমত টিচারদেরই দায়ী করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে মনে করা হয়, শিক্ষকেরা তাদের শিশু ও যুব সমাজকে যথাযথ শিক্ষা দিতে পারছেনা বিধায় এই আপত্তিকর অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে।
আমেরিকায় টিচিং জবকে কোনো চ্যালেঞ্জিং পেশার অন্তর্ভুক্ত হিসেবে ধরা হয়না। বরঞ্চ তাদের পেশাকে অত্যন্ত হেয় চোখে দেখা হয় এবং মানদণ্ডের বিচারে মনে করা হয় শিক্ষকেরা অত্যন্ত অ্যাভারেজ ক্যালিবারের বুদ্ধিমত্তার মানুষ। বাবামাও কখনো তাদের ছেলেমেয়েদের উৎসাহিত করেনা ভবিষ্যতে শিক্ষকতা পেশা বেছে নেবার জন্য। এই সব মানসিকতার রিপেল এফেক্টের প্রভাবে এবং নিম্ন বেতন, ছাত্রছাত্রীর দূর্ব্যবহারের নতীজা বোঝা যায় আমেরিকার বিভিন্ন স্টেটের পাবলিক স্কুল সিস্টেমে পর্যাপ্ত শিক্ষকের ঘাটতি দেখে যা প্রতি বছর ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে।
অথচ কি আশ্চর্য্য, ছোটবেলা থেকে আমরা
বাংলাদেশে এটা জেনে বড় হয়েছি যে শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড। যিনি আমাদের শিক্ষাদাতা, তিনি
আমাদের গুরু, আমাদের পথ প্রদর্শক।
করোনা চলাকালীন সময় পৃথিবীর অনেক দেশ ও জাতি, শিক্ষকদের নিয়ে নতুন করে ভাবতে শিখেছে এবং তাদের প্রতি সম্মানের মাত্রা বৃদ্ধি করেছে। প্যান্ডেমিকের সময় এটি অনায়াসে প্রতীয়মান হয়েছে যে, শিক্ষকেরা ফ্রন্ট লাইনার বা সম্মুখ যোদ্ধাদের চেয়ে কোনো অংশে কম নয় এবং তারাও প্রতিনিয়ত বাঁধার সম্মুখীন হয়েছে। নিজেদের পরিবার ও প্রিয়জনদের উপেক্ষা করে, নিজেদের সুস্বাস্থ্য ও সুরক্ষার ঝুঁকি নিয়ে, সারা বছর ধরে শিক্ষকেরা ‘সশরীরে’ বা ‘অনলাইনে’ শিক্ষকতা চালিয়ে গেছে। লেখাপড়া ও স্কুলের প্রতি একান্ত দায়িত্ব ও মমত্ববোধ না থাকলে যেটা করা সম্ভব নয়।
জাতিসংঘের ইউনেস্কো সম্প্রতি বিশ্বের উন্নত দেশগুলোকে
আহবান জানিয়েছে, তারা যেন তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা, শিক্ষকতা পেশা ও শিক্ষা কার্যক্রমের
প্রতি আরো বেশী মনোযোগী হয়। তারা যেন সমাজে শিক্ষক শিক্ষিকার নিরলস অবদানকে যথাযোগ্য মূল্যায়ন
করে।
শিক্ষক যদি বন্ধু হয়,... তবে বন্ধু হবে কে?
আমার মতে, একজন শিক্ষক খুব ভালো মেন্টর বা গাইড হতে পারে, কাউন্সেলর হতে পারে, বন্ধুসুলভ একজন প্রিয় মানুষ হতে পারে - তবে কখনই বন্ধু নয়। তাদের দেয়া পাথেয় নিয়ে আমরা জীবনের পথ চলি। তাঁরা সব সময়ই শ্রদ্ধার পাত্রপাত্রী, তাদের কাছে আমাদের থাকা উচিত চিরকৃতজ্ঞ ও চিরঋণী।
গভীরভাবে ভাবলে দেখা যাবে, আমাদের সবার জীবনেই কোনো না কোনো সময় একজন গুরু বা শিক্ষক এসেছেন, যিনি জীবন সম্পর্কে আমাদের সঠিক নির্দেশনা দিয়েছেন। প্রতিনিয়ত আমাদের মাঝে উৎসাহ ও সাহসিকতা জাগিয়েছেন, এই মানব জগত সম্পর্কে আমাদের চিন্তাধারা পাল্টে দিয়েছেন। সম্মানের সাথে তিনি আমাদের হৃদয়ের খুব কাছে অবস্থান করেন।
Very informative and interesting! I can relate some of it to the British education system. However, it differs in fee-paying, private and grammar schools where children are expected to follow certain strict school rules.
ReplyDeleteQuite interesting and informative
ReplyDeleteEvery society has its own way of shaping a child's mind. Norms, values and respect are instilled in a child's mind from a very early age primarily by their family and the society they live in. Societal structure also paves the way on how to perceive and value relationships That may be the reason behind the difference in perception and behavior. Today the ideal of teacher student relationship is blurred. The ideal teacher student relationship does not limit a teacher to impart academic education only. As mentors their responsibilities also lies in awakening hidden talents and guiding on how to nurture them. And to do so, the teachers need to maintain a friendly, cordial and healthy relationship with the student which maybe mistakenly perceived as friendship.
ReplyDeleteCompletely agree with you. You have truly reflected on what I have talked about on my blog. Thank you :) and Happy Teaching!
DeleteStudents in the USA tend to view the hard boundaries b/w teachers and students as power play --- teachers have the power if they won't go along with the excuses kids can make with their still developing minds. The fact is, teachers are leaders, and leaders must have a certain measure of authority. If society reflected the value of teachers by matching their paychecks with the important responsibility of shaping young people to responsible adults, then parents and other decision makers in the society would automatically find more reverence in the job they do. A brilliant teacher/professor in America is obscure, but the foul mouthed, hyper mean football coach (who is usually the highest paid "teacher", often the highest paid city/county/state employee) is well known because he puts a product out of a school team that is essentially an entertaining performance.
ReplyDeleteKids pick up on these social preferences. That's why they'll get up at 5:30 am in the morning to have two hours of practice before school, but won't show up for the math tutorial offered just 30 min prior to school beginning bell.
Good insights to Teaching, Respect, mentorship, Coach and changing generatuons. There is big changes with influence of Technology and learning. Mindset theory, changing behavior and attitude are interesting.
ReplyDelete