যন্ত্র-মানব
একবার ভেবে দেখুন তো কেমন হবে যদি এই যান্ত্রিকতার যুগে আমাদের জীবনযাত্রার পাশাপাশি আমাদের শরীরটাও যান্ত্রিক হতে শুরু করে? কিংবা আমাদের মস্তিষ্ক? রক্ত মাংসে গড়া এই শরীরটা আস্তে আস্তে কোনো যন্ত্র বা ডিভাইস দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হবে। কিংবা আপনার সুন্দর সুন্দর ভাবনাগুলি মুখ ফুটে কাউকে বলার আগেই দেখবেন সেগুলো কেউ বা কোনো কিছু বাস্তবে রুপান্তরিত করে ফেলেছে। কি আশ্চর্য্য ব্যাপার তাই না?
আমার লেখার এবারের বিষয়টা খুব সমকালীন একটা খবর নিয়ে, যেটা কিনা আজকে থেকে দশ বিশ বছর পরে খুলে দিতে পারে একটি বিরাট সম্ভাবনার দুয়ার, নতুবা আনবে কোনো প্রলংকারী ধ্বংস।
মেশিন বা যন্ত্রের সাথে মানব জাতির বন্ধুত্ব, এটা আর নতুন কি কথা? একের দ্বারা অন্যকে সনাক্তকরণ বা অন্যের অবস্থান নির্ধারণ, এটা সম্পর্কেও আমরা ওয়াকিবহাল।আমেরিকার বড় বড় টেকজায়ান্ট ফার্মগুলি তাদের ল্যাবে নিয়মিত ব্রেইন-কম্পিউটার ইন্টারফেস এর গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বের সবচেয়ে শীর্ষ ধনী ব্যাক্তিদের একজন, টেসলা ইলেকট্রিক গাড়ী ও মহাকাশযান ইন্ডাস্ট্রির কর্ণধার ইলন মাস্ক। সম্প্রতিকালে, তার নিউরালিংক কোম্পানি আমাদের মস্তিষ্ক বা ব্রেইন এর সাথে প্রযুক্তির যুগান্তকারী সমন্বয় ঘটাতে যাচ্ছে। ইলন মাস্ক বলেছেন, নিউরালিংক নামের চিপটি অনেক দুরারোগ্য মানসিক ব্যাধি অটিজম বা স্কিটজোফ্রেনিয়া, এবং প্যারালিসিস এর মত জটিল শারীরিক অবস্থার উন্নতি করতে সক্ষম হবে। চালের দানার সাইজের এই চিপটি খুব সহজে ইঞ্জেকশন এর মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করানো যাবে। তবে আমেরিকান এফডিএ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এই চিপ ইমপ্ল্যান্ট পদ্ধতি এখনো মনজুর করেনি।
সুইডেনের মত প্রযুক্তিতে দারুন অগ্রগামী দেশে, গত ২০১৫ সাল থেকে ২০১৮ পর্যন্ত প্রায় তিন হাজারের মত নাগরিক তাদের শরীরে (হাতে) মাইক্রোচিপ প্রতিস্থাপন করেছে। যার ফলশ্রুতিতে, এই জনগোষ্ঠীর মানুষদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় তাদের আই ডি কার্ড, বাড়ীর চাবি, গাড়ীর চাবি, মেট্রো রেলের টিকেট কোনো কিছুই বহন করতে হয়না। তারা শুধু দরোজার প্রবেশ মুখে রাখা একটি ডিজিটাল বক্সের সামনে তাদের হাত তুলে ওয়েভ করে অথবা কোনো স্ক্যানিং মেশিনের উপর তাদের হাতটা ধরে, আর সাথে সাথে গ্রীন সিগন্যাল বা সবুজ সংকেতের মাধ্যমে তাদের প্রবেশের অনুমতি দেয়া হয়।
তাদের আঙ্গুল বা তর্জনীতে অবস্থান করা চিপগুলোতে সংরক্ষিত থাকে তাদের পার্সোনাল ইনফরমেশন, ইমার্জেন্সি কনট্যাক্ট, রেলের ই-টিকেট, সোশ্যাল মিডিয়া প্রোফাইল ইত্যাদি, যা দ্বারা তাদের সনাক্ত করা হয়। এই সব সুইডিশ নাগরিকদের মতে, এই ব্যবস্থার দ্বারা তাদের জীবনযাত্রা হয়ে উঠেছে খুবই সহজ, নির্ভেজাল এবং দ্রুত গতিসম্পন্ন। করোনা ভাইরাস আক্রমণের পর গত ২০২১ সালে একটি সুইডিশ কোম্পানি নতুন একটি চিপ উদ্ভাবন করেছে যাতে সংরক্ষণ করা যাবে করোনা রোগের ভ্যাকসিন সার্টিফিকেট। এই চিপটি শরীরে থাকলে বিভিন্ন দেশে ভ্রমণের সময় আর মনে করে সাথে ভ্যাকসিন সার্টিফিকেট নিতে হবেনা।
আমেরিকার বিভিন্ন রক্ষণশীল মহল এবং আইন ও বিচার ব্যবস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তিবর্গ, এই প্রযুক্তি বিদ্যায় ঘোরতর আপত্তি জানিয়েছে। তাদের মতে এটি 'বায়োহ্যাকিং' ছাড়া আর কিছুই নয়। এটি সাধারণ মানুষের স্বাধীনতা ও গোপনিয়তা রক্ষার বিরাট অন্তরায় হবে, যদি তাদের শরীরে ট্র্যাকাবেল মাইক্রোচিপ ইমপ্ল্যান্ট করা হয়। কোনো ইলেকট্রনিক ডিভাইস যেমন স্মার্ট ফোন, স্মার্ট ওয়াচ, হিয়ারিং ডিভাইস, আপনি শরীর থেকে সরিয়ে ফেলে বা নষ্ট করে দিতে পারেন, কিন্তু আপনার মাথার ভেতর বসিয়ে দেয়া চিপটা কি করে সরাবেন। দূরে বসে কোন ব্যাক্তি বা মহল আপনাকে সদা নিয়ন্ত্রণ করবে। আপনি হয়ে যাবেন, তাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত রোবট বা 'যন্ত্র মানব'।
নিউরাল ইমপ্ল্যান্টের মত প্রযুক্তিগত পদ্ধতির শুধু এক নয়, একাধিক খারাপ ফলাফল হতে পারে। সরকার এবং বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী এজেন্সি গুলো সর্বদা কারোর উপর নজরদারি করতে পারবে বা তার গতিবিধি তার অজান্তে প্রতিনিয়ত রেকর্ড করতে পারবে। ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো আপনার পছন্দ অপছন্দের জিনিসের তালিকা খুব সহজেই বের করে ফেলবে। পুলিশ মহল কোনো ওয়ারেন্ট ছাড়াই ট্র্যাকিং ডিভাইস দিয়ে গোপনে সংগ্রহীত রেকর্ডের ভিত্তিতে কাউকে তুলে নিয়ে জেলে ভরতে পারবে। এ ছাড়াও আছে, ডাটা ব্রিচিং এর সম্ভাবনা। মানুষের দুনিয়াতে কোনো কিছুই শতভাগ নিশ্চিত বা সুরক্ষিত নয়। একবার চিন্তা করে দেখুন, আপনার একান্ত ব্যাক্তিগত তথ্যাবলী, মেডিকাল রেকর্ড, ব্যাংক একাউন্ট নাম্বার, আইডি নাম্বার, বাড়ীর ঠিকানা কোন দুষ্ট ব্যাক্তি বা অপরাধী চক্রের হাতে পড়লো। এরপর আপনি কতটা নিরাপদ থাকবেন?
খোদার উপর খোদকারী??...কথায় আছে, খোদা'তালা সীমা লঙ্ঘনকারীদের পছন্দ করেন না। কোনো বিষয়েরই অতিরিক্ত ভালো নয়। রক্ত মাংসের শরীরে যন্ত্র বসিয়ে মানুষ হতে চাইছে আরো ক্ষমতাধর, পরাক্রমশালী। মানুষের রোগ-ব্যাধি, অপারগতা, অক্ষমতাকে করতে চাইছে জয়।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিরামহীন উৎকর্ষতা ও অগ্রগতি, প্রতিনিয়ত আমাদের কোন দিকে ঠেলে দিচ্ছে?... এটা খুবই ভাববার বিষয়।
বিজ্ঞান যে দ্রুত গতিতে ছুটছে সেই ধারাবাহিকতায়, আজ থেকে তিরিশ চল্লিশ বছর পরে মানব জাতির অবস্থান কোথায় হবে আমি জানিনা। আমার উত্তরসূরিদের জীবনটা কেমন হবে তাও জানিনা। শুধু ভয় হয়, আমাদের নিজেদের সৃষ্ট আকাশচুম্বী সাফল্যের ভার কি আমরা নিজেরাই বহন করতে পারবো?
নাকি আমাদের ভেতরকার সূক্ষ্ম মানবিক গুণাবলী হারিয়ে, নিজেদের স্বাধীনতা-স্বকীয়তা-সৃজনশীলতাকে বিসর্জন দিয়ে আমরা একেকজন হয়ে যাবো যন্ত্র-মানব??
বেশ মজার ব্যাপার। তবে মানুষ এক দিক দিয়ে যেমন অতি মাত্রায় অগ্রসর হচ্ছে অন্যদিকগুলোতে তেমন উন্নতিসাধন হচ্ছেনা, যেমন যুদ্ধবিগ্রহ, কলহ, অশান্তি এসব লেগেই রয়েছে।
ReplyDeleteThis informative topic has left me wondering about the world in 40/50 years time, which is also generating fear and anxiety.
ReplyDeleteLife was absolutely fine with the generations before us.
The need to complete with God, however doesn't sit well with me.
চিপ ইমপ্ল্যান্ট এর মাধ্যমে জীবন যেমন সহজ হতে পারে, তেমন কঠিনও হতে পারে। ওয়ালেট, আই ডি কার্ড, সাবওয়ে পাস সাথে না রাখতে হলে নিজেকে হাল্কা মনে হবে ঠিকই, কিন্তু ক্রিমিনাল যখন আপনার পরিচয় ব্যবহার করে অপরাধ করবে তখন তো দুর্ভোগ একটু হবেই। আর সবচেয়ে বড় অপব্যবহার করবে বিভিন্ন সরকার --- সুপার পাওয়ার মিলিটারি হয়তোবা একটি পুরো শত্রুভাবাপন্ন জাতিকেই অথর্ব করে দেবার চেষ্টা করবে। আর বেশীরভাগ সরকার হয়তো করবে ধরপাকর আর শোষন, যদি মানুষের মনের কথা বুঝে ফেলতে পারে।
ReplyDeleteআইন কি পারবে প্রযুক্তির সাথে পাল্লা দিয়ে চলতে? গুগুল, ফেসবুক, অ্যাপেল, অ্যামাজন কিন্তু ভালো সূচনা করতে পারে নি।