বাংলা ভাষার সাথে
মহান ২১ ফেব্রুয়ারি এবং নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ঠিকানা পত্রিকার ৩৩তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আমার একটি লেখা - যা ঠিকানার বর্ষপূর্তি সংখ্যা ২০২২ এ বেড়িয়েছে।
আমি ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে বললাম, “আসসালামু আলাইকুম। ভালো আছেন?” বলেই আমার পাসপোর্টটি বাড়িয়ে দিলাম। তিনি হাত বাড়িয়ে আমার পাসপোর্টটি গ্রহণ করলেন এবং আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন।
ইমিগ্রেশন অফিসারদের সাথে কথা বলতে এমনিতেই আমার খুব
টেনশন হয়। ওনাদের হাতেই সর্বোচ্চ ক্ষমতা থাকে। কোনো দেশে প্রবেশ করতে এরা যেমন বাধ
সাধতে পারে, আবার কোনো দেশ থেকে বেরোনোর সময়ও এরা অযথা হয়রানির সৃষ্টি করতে পারে। আমি
এই অফিসারটির দৃষ্টি দেখে একটু ইতস্তত করে বললাম, “কোনো সমস্যা?
তিনি অত্যন্ত আবেগজড়িত কণ্ঠে প্রায় ছলছল চোখে আমাকে
বললেন, “ম্যাডাম, এতো সুন্দর করে, সম্মান দিয়ে কেওতো আমাদের সাথে কথা বলেনা। তাও আবার
বাংলায়”। তিনি আমার আমেরিকান পাসপোর্ট এর দিকে তাকিয়ে বললেন, “বহু বছর বিদেশে থাকার
পরও আপনি কি সুন্দর করে বাংলায় কথা বলেন। খুব ভালো লাগলো”।
আমি হেসে বললাম, “বহু বছর বিদেশে থাকলেই কি মাতৃভাষা
বর্জন করা যায়? আমি শুধু বাংলাই বলিনা, বাংলায় লেখালেখিও করি। প্রতিটি মানুষের গর্ব
হওয়া উচিত তার আপন মাতৃভূমি, ভাষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টিকে নিয়ে কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমরা অনেকেই
তা ভুলে যাই”। ইমিগ্রেশন অফিসারটি একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
কথা হচ্ছিলো ঢাকার হজরত শাহজালাল বিমান বন্দরের ইন্টারন্যাশনাল
টার্মিনালের একজন ইমিগ্রেশন অফিসারের সাথে, যখন আমি বাংলাদেশ ছেড়ে আমেরিকায় আমার আবাস
ভূমির উদ্দেশ্যে যাত্রা করছিলাম। ফেরত আসতে আসতে সারাটা পথ আমি এটাই ভাবছিলাম, যে ভাষার
জন্য এতো ত্যাগ, এতো বিসর্জন, রক্তের বিনিময়ে অর্জিত সেই মাতৃভাষা ‘বাংলা’ বলতে কিছু
মানুষের বাঁধা কোথায়? কেনো এতো অনীহা?
প্রতি বার যখন দেশে যাই, তখন তরুণ প্রজন্মের মধ্যে
যে ‘বাংলিশ কালচার’ দেখতে পাই, তা আমাকে ভীষণ ভাবে পীড়া দেয়। আজকের তরুণ সমাজে বাংলার
সঙ্গে ইংলিশ মিশিয়ে বলার যে অদম্য প্রবণতা বিদ্যমান, তা দেখলে আমি খুবই আশ্চর্য হই।
অনেকের ধারণা, প্রতিটি লাইনে বাংলার ফাঁকে ফাঁকে ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করলে ভাষার সম্মান
বাড়ে বা উক্তিটি অনেক মর্যাদা পায়, ওজন পায়। এটা একেবারে ভুল ধারণা। বাংলা একটি স্বয়ংসম্পুর্ণ
ভাষা। অন্য একটি বিদেশী ভাষার সাহায্য না নিয়ে শুধু মাত্র বাংলা ভাষা দিয়েই মনের ভাব
সম্পুর্ণ ভাবে প্রকাশ করা সম্ভব।
আমি এটাও দেখেছি, পারিবারিক ভাবে সচেতনতার খুব অভাব।
অথচ অভিভাবকেরা একটু সচেতন হলেই তাদের সন্তানদের বাংলা ভাষা চর্চা ও সঠিক প্রয়োগ এর
ব্যাপারে আলোকিত করতে পারেন। এটা খুবই স্বাভাবিক যে স্কুল, টিভি, বিজ্ঞাপন বা সোশ্যাল
মিডিয়াগুলোর মাধ্যমে দেশের ছেলেমেয়েদের ওপর ইংরেজি ভাষার ব্যাপক প্রভাব পড়বে। কিন্তু
দেশের ছেলেমেয়েরা যতই ইংরেজি শুনুক বা ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে পড়ুক না কেনো, বাড়িতে
তো তারা বাংলাই শোনে। তাদের বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশীরাতো
বাংলাই বলে। তাদের দেশ, বাংলাদেশের মানুষেরাতো বাংলাই বলে। তাহলে কেনো তাদের বাংলাটা
হবে ‘অ্যাকসেন্টেড’ কিংবা আরো একটি বিদেশী ভাষার সংমিশ্রণে ‘হাইব্রিড’? আর এ কারনেই
আমার মনে হয়, দেশের তরুণ সমাজ সাংঘাতিক ভাবে দ্বিধাগ্রস্ত। তারা বোঝেনা যে ইংরেজিতে
কথা বললেই বিদেশী হয়ে যাওয়া যায়না। ইংরেজি বললেই প্রকাশ পায়না যে কেউ আধুনিক বা উচ্চ
বিচার-বুদ্ধি সম্পন্ন।
সমাজের বিভিন্ন স্তরে এখন দেখা যায় বড় ধরনের ভাষাদূষণ। রাস্তাঘাটে চোখে পড়ে ভুল বাংলা বানানে লেখা অসংখ্য সাইবোর্ড। ঢাকার টিভি চ্যানেল
গুলোতে উপস্থাপক/উপস্থাপিকার ইংরেজি মেশানো হাইব্রিড বাংলা শুনলে অবাক হতে হয়। রেডিও
জকিদের অ্যাকসেন্টেড বাংলাই বা কম কিসে? প্রতি দু’তিনটে বাংলা শব্দের পর যত্রতত্র ইংরেজি
শব্দ জুড়ে দিলে সেটা শুনতে খুবই হাস্যকর শোনায়। এদের কথা শুনলে কখনোই মনে হয়না যিনি
কথা বলছেন, তিনি বাংলা বা ইংরেজি কোনোটাতেই খুব পারদর্শী।
আমার কথা হচ্ছে, আমরা যে ভাষাই বলি না কেনো তা পুরোপুরি
সঠিক নিয়মে, সঠিক উচ্চারণে, অন্য কোনো ভাষার প্রয়োগ ছাড়াই খাঁটি ভাবে বলতে পারা উচিত।
বাংলা বললে বাংলা, নতুবা ইংরেজি বললে ইংরেজি। দুটোর মিশ্রণ একেবারেই নয়। পারদর্শিতার
বিচারে, একটি মানুষের একের অধিক ভাষায় দক্ষতা থাকলে তাতে কোনো ক্ষতি নেই। একজন বাঙালি
যিনি খুব ভালো ইংরেজি বলেন, তিনি কি খুব ভালো বাংলাও বলতে পারেন না? ইংরেজি শেখার সাথে
সাথে কি তাকে বাংলাটা ভুলে যেতে হবে? এটা অবশ্যই ভাবার বিষয়। পাশ্চাত্য দুনিয়ায় বাস
করতে গিয়ে আমি দেখেছি, এমন অনেক মানুষ আছেন যারা একসাথে তিন বা চারটে ভাষায় পারদর্শি।
তবে তারা যখন যে ভাষায় কথা বলতে চান বা কাজের প্রয়োজনে বলেন, তখন শুধু সেই ভাষাটাই
বলেন, চারটে ভাষা মিশিয়ে নয়।
আমরা যারা দেশের বাইরে থাকি, আমাদের কোনো উপায় নেই। ঘরে-বাইরে, রাস্তাঘাটে, কাজেকর্মে, স্কুলে, অফিসে, এতো এতো ইংরেজি ভাষাভাষী মানুষ। তাদের সাথে কথোপকথন বা যোগাযোগের জন্য আমাদের ইংরেজি ভাষা ব্যতীত আর কোনো রাস্তা নেই। কিন্তু ভেবে দেখুন। একটু সুযোগ পেলেই, বাংলাভাষী বা বাংলাদেশের কাউকে পেলেই, আমরা মনের সুখে বাংলায় কথা বলা শুরু করে দেই। আমাদের দ্বিতীয় প্রজন্মের সন্তানেরা যারা এ দেশে জন্ম হয়ে বড় হচ্ছে, তাদেরকে আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করি বাংলা চেনানোর জন্য, বাংলা ভাষার সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য, ভাষাসংগ্রামের ইতিহাস সম্পর্কে অবহিত করার জন্য।
প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারিতে, আমার ছেলেদেরকে তাদের দাদার মহান ভাষা আন্দোলনে অংশ গ্রহনের গল্পটা বলি। ১৯৫২ সালে আমার মরহুম শ্বশুর ‘মির হায়দার আজম’ ছিলেন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের (এখনকার বুয়েট) প্রথম বর্ষের ছাত্র। বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা পুলিশের ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে সেদিন স্লোগান ও মিছিলে জমায়েত হয়েছিল। নিজ মাতৃভাষার অপমান ঠেকাতে সেদিন আমার শ্বশুরও ছিলেন সেই মিছিলে শামিল। পুলিশ এক পর্যায়ে ধাওয়া ও গুলি করলে মিছিল ভঙ্গ হয় এবং তিনি দৌড়ে পাঁচিল টপকে পালাতে চেষ্টা করেন। পাঁচিল টপকানোর সময় লোহার শিক তার হাঁটুকে জখম করে। আহত অবস্থায় তিনি মাটিতে পড়ে গেলে পুলিশ এসে উনাকে ধরে নিয়ে যায় এবং পুলিশ প্রহরায় রেখে একটি হাসপাতালে ভর্তি করে। পরে খবর পেয়ে ওনার প্রিয় বন্ধু ও হলের রুমমেট আরো কিছু ছাত্রদের সঙ্গে নিয়ে হাসপাতালে অভিযান চালান এবং পুলিশের কবল থেকে ওনাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন। ফেব্রুয়ারি, ভাষার মাস। ফেব্রুয়ারি, গর্ব করার মাস। জাতিসংঘের ইউনিসেফ ফেব্রুয়ারি মাসের ২১ তারিখটিকে ‘ইন্টারন্যাশনাল ল্যাংগুয়েজ ডে’ হিসেবে ধার্য করেছে। সারা বিশ্বে আর অন্য কোনো দেশের মানুষ তাদের মাতৃভাষার সম্মান রক্ষার্থে অকাতরে প্রাণ দেয়নি। যেখানে আন্তর্জাতিক বিশ্ব বাংলা ভাষাকে এতোবড় স্বীকৃতি ও সম্মান দিয়েছে, সেখানে কেনো দেশের অনেক ছেলেমেয়েরা এই তথ্যটি সম্পর্কেও ওয়াকিবহাল নয়। এটাও ভাবার বিষয়। একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাতে শুধু শহীদ মিনারের পাদদেশে ফুল বিছালেই হবেনা, প্রকৃত অর্থে বাংলা ভাষাকে সম্মান দিতে হবে। শুধু ফেব্রুয়ারি মাসেই বাংলা নিয়ে হৈ চৈ না করে সারা বছরই সমাজ, সরকার, ও প্রশাসন লেভেলে বাংলা ভাষা চর্চার প্রতি বিশেষ সচেতনতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।তিরিশ বছর আগে আমেরিকার মাটিতে পা দিয়েছিলাম উচ্চশিক্ষা
লাভের আশায়। কলেজ প্রাঙ্গনে জ্ঞ্যান আহোরণের ভাষা ইংরেজি হলেও মনটা ঠিকই আনচান করতো
বাংলা বলার নেশায়। বাংলা পড়ার নেশায়। ঠিক এমন সময়ই আবিষ্কার করেছিলাম ‘ঠিকানা’ পত্রিকাটিকে।
কি আনন্দ, কি আনন্দ। বাঙালী গ্রোসারি দোকানে ও নিউজ স্ট্যান্ড
এ ঠিকানা পত্রিকা বিক্রি হতো। কলেজ থেকে বাড়ি ফেরার পথে সাবওয়ে ট্রেন থেকে নেমে প্রতি
সপ্তাহে আমি সংগ্রহ করতাম ঠিকানা। প্রথম পাতা থেকে শেষ পাতা পর্যন্ত আমার সবগুলো পছন্দের
খবর পড়ার পর আমি শান্তি পেতাম। এক নিমেষে ফিরে পেতাম বাংলাদেশকে। পেতাম তাজা খবর, পেতাম
দেশের চেনা গন্ধ।
একটি অজানা দেশে, অজানা পরিবেশে এসে নিজের স্বকীয়তা,
নিজের কৃষ্টি, নিজের মাতৃভাষাকে কখনো হারিয়ে ফেলিনি, এই ঠিকানা ছিলো বলে। প্রাণের ভাষা
বাংলাকে ভুলে যাইনি, এই ঠিকানা ছিলো বলে। বিদেশের মাটিতে বসে বাংলায় লেখালেখি করে আজো
বাংলার চর্চা চালিয়ে যাচ্ছি, এই ঠিকানা আছে বলে।
প্রিয় ঠিকানা, ৩৩তম বর্ষে পদার্পণ উপলক্ষে তোমার জন্যে প্রাণঢালা শুভেচ্ছা। তুমি সামনে এগিয়ে চলো ও বাংলা ভাষাকে বহির্বিশ্বের কাছে আরো মহিমান্বিত করো।
Excellent analysis! It is really shocking that now people are not speaking in Bangla properly. Instead of that they are mixing English with it. You are right that, parents should be very aware of all these. They should properly make their children understand the importance of Bangla language. You are also right that, culture and mother tongue can't be necessarily forgotten after shifting to another country. One strange thing I want to share. I have always loved my mother tongue and culture, therefore remained inside it all the time. Despite studying in English medium, I am not that good in speaking English. Even in my school finals and O level exams I got the highest in Bangla. Among all the informations I found your father-in-law's part taking in Language Movement the most interesting. I salute him for his contribution. Also congratulations to your "Thikana" newspaper on its 33rd anniversary.
ReplyDeleteWhat a wonderful insight from someone who had done schooling in English medium, yet has so much respect for his native language Bangla!!
DeleteThank you so much for your kind and thoughtful remarks.
You are most welcome. Always keep up your wonderful write ups.
Deleteপ্রকৃত অর্থেই তাই - বিভিন্ন ভাষা জানা ভাল, যে কারণে প্রবাসের স্কুলগুলোতে ইংরেজীর পাশাপাশি ফ্রেঞ্চ, জার্মান ইত্যাদি ভাষা শেখার অবকাশ থাকে। কিন্তু ভাষা মিশিয়ে কথা বলার তো দরকার নেই। প্রতিটি ভাষাই নিজ নিজ গুনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। তোমার লেখাটি পড়ে ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের কটাক্ষ করে লেখা সেই কবিতাটির কথা মনে পড়ে যাচ্ছে - জানেন দাদা, আমার ছেলের, বাংলাটা ঠিক আসে না। বাংলাদেশের একজন ব্যক্তিকেই দেখেছি ত্রূটিহীন বাংলায়, শুধু বাংলাতেই নয়, বাংলা কাব্যিক ছন্দে অনর্গল কথা বলে যান - কোনদিন তিনি একটিও বিদেশী শব্দ ব্যবহার করেননি। যদি পারো তো তাঁর কথা কখনো লিখো। তিনি হলেন প্রখ্যাত কৌতুক উপস্থাপক এবং সমাজ প্রবর্তক হানিফ সংকেত।
ReplyDeleteকমেন্ট পড়ে ভালো লাগলো। অবশ্যই চেষ্টা করবো।
DeleteYour command in Bengali language is outstanding. You continue to amaze me with your writing prowess & the your unique ability to express such delicate human emotions so beautifully in such an intricate manner. In short, Proud of you
ReplyDeleteThank you so much for your endless inspiration and continuous encouragement! They mean a lot to me.
Delete