ভায়োলিনের সুর
ঐ হতভাগা মানুষগুলোকে নিয়ে অনেক দিন থেকেই ভাবছিলাম কিছু লিখবো। তবে হয়ে ওঠেনি। সেদিনের একটা ঘটনা ওদের কথা আবার মনে করিয়ে দিলো।
ডিসেম্বরের এক সকালে, আমি গিয়েছিলাম আমার ছেলেকে নিয়ে গ্রোসারি করতে। আমেরিকার সাবার্ব গুলোতে গ্রোসারি স্টোরগুলো বিশাল বড় হয় এবং তাদের সামনে বিরাট বড় পারকিং লট থাকে। অনেকটা আমাদের দেশের পার্ক বা বড় উদ্যান সাইজের। আমাদের মত কাস্টোমাররা প্রায় উপচানো, ট্রলি ভর্তি সওদা পাতি নিয়ে পার্কিং লটে গাড়ীর কাছে আসে এবং গাড়ীর ট্রাঙ্ক ভর্তি করে বাড়ী নিয়ে যায়। যাতে করে বেশ কয়েকদিন আর বাজার করতে না হয়। আমি ও আমার ছেলে স্টোর থেকে বেরিয়ে ট্রলি নিয়ে যেই গাড়ীর দিকে হাঁটা দিয়েছি অমনি শুনতে পেলাম, কোথা থেকে যেন ভেসে আসছে এক সুন্দর, মন মাতানো সুর। আমার ছেলে বলল, আম্মু, কোথায় যেন ভায়োলিন বাজছে। আমি ভাবলাম কি আশ্চর্য্যের কথা। পারকিং লটে ভায়োলিন এর সুর!
এদিক ওদিক তাকিয়ে বুঝলাম না কোথা থেকে আসছে। চারিদিকে তাকাতে তাকাতে গাড়ীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ দেখতে পেলাম ঐ পরিবারটিকে। পারকিং লটের এক কোনে একজন লোক আপন মনে ভায়োলিন হাতে অপূর্ব সুর তুলছে। আকাশে, বাতাসে যা অনুরণিত হচ্ছে, ছন্দে, ছন্দে। খুব সম্ভবত তিনি ঐ পরিবারের বাবা। পাশে একটি চেয়ারে বসা তার স্ত্রী। যার হাত, গলা, মাথা, চুল, হেজাব দিয়ে ঢাকা। আর তার পাশে বসে আছে বিশাল একটি বাক্সের উপর, ছোট্ট একটি ছেলে। সম্ভবত, চার কি পাঁচ বছর বয়স। তাদের সামনে অনেকগুলো পোটলা, পোটলি এলোপাথারি ভাবে মাটিতে পড়ে আছে। আর আছে সাহায্য গ্রহণ করবার একটি বাক্স, সেই সাথে একটি বড় সাইন বোর্ড।
আমি ভাবলাম, আহারে, ক্রিস্টমাসের আগ দিয়ে ওদের কি করুণ দশা। একটু ভালোমন্দ খাবে, উপহার কিনবে, তার হয়তো সামর্থ নেই। আমরা এগিয়ে গেলাম ওদের কিছু টাকা দেবার জন্য। কাছে যেতেই চোখে পড়লো, সাইন বোর্ডের লেখাটি। সুদূর আফগানিস্তান থেকে আসা ওরা একটি অভাগা পরিবার। আমেরিকার মাটিতে ওরা আফগান রেফিউজি। যাদের চাল নেই, চুলো নেই। মাথা গোঁজার ঠাই নেই। পেটের ক্ষুধা নিবারণে রাস্তায় দাঁড়িয়ে মানুষকে আনন্দ দান করছে, মধুর সুর শোনাচ্ছে। তবু সরাসরি হাত পাতছে না।
বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো। আমার জিনিস ভর্তি ট্রলির দিকে তাকিয়ে লজ্জা লাগতে লাগলো। কিন্তু ভাবলাম, আমার ট্রলি থেকে নিয়ে কোনো খাবার দেয়ার চাইতে, নগদ অর্থ দিয়ে সাহায্য করলে ওরা প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে পারবে। মহিলাটি টাকা পেয়ে বার বার থ্যাঙ্ক ইয়ু বলল। এর বেশী ইংরেজি শব্দ জানে কিনা সন্দেহ হলো।
হায়রে নিয়তি। তালেবানদের হাতে প্রাণ হারানোর ভয়ে, নিজ মাতৃভূমি ছেড়ে অচেনা এক ভূখন্ডে এসে শরনার্থীর খাতায় নাম লিখিয়েছে। নিশ্চিত ভবিষ্যতের আশায়।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গত বছর (২০২১) অগাস্ট মাসে ঘোষণা দিয়েছিলেন, "আফগানিস্তানে আমাদের সব কার্যক্রম বন্ধ। আমাদের সেনারা ঘরে ফেরত আসুক।" আর সেই দিন থেকে আফগান মানুষদের জীবনটা একেবারে পালটে গেলো। তারা উপলব্ধি করলো, তালেবানদের মত নিষ্ঠুর স্বৈরশাসক যে দেশে ক্ষমতায় আসবে, সেই দেশে আর যাই হোক কোন স্বাধীন প্রাণ থাকবেনা। নারী, পুরুষ, আবাল, বৃদ্ধ, বণিতা, সবাই আতঙ্কিত হলো এই ভেবে যে তাদের আহার, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, চাকরী সব ধরনের জৈবিক সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হবে। কঠোর বিধি নিষেধ আরোপ করা হবে। যারা প্রায় দুই দশক ধরে মার্কিন সেনাদের হয়ে ট্রান্সলেটর, গাইড, ড্রাইভার হিসেবে কাজ করেছে, সেই অসহায় আফগান কর্মীদেরকে রাজাকার হিসেবে বন্দী করা হবে, প্রাণ হরণ করা হবে।
তাই তারা প্রাণের ভয়ে ঘর ছাড়তে শুরু করলো। ঝাঁকে ঝাঁকে আফগানীরা দেশ ছাড়তে শুরু করলো। মার্কিন সেনাবাহিনীর শেষ বিমানটি যখন কাবুল এয়ারপোর্টের রানওয়েতে ওড়ার জন্য একেবারে প্রস্তুত, সেই মুহুর্তে হাজার হাজার ঘর ছাড়া, মরিয়া, আফগানবাসী কোথা থেকে প্রাণপণ দৌড়ে এসে উড়োজাহাজের ওপর চড়ে বসে। প্লেনের ভেতর জায়গা না হোক, প্লেনের ছাদে বা ডানা দুটোর ওপর বসেই তারা রউনা হবে। প্রায় উপচে পড়া আমার গ্রোসারি ট্রলিটির মতই ছিল যার অবস্থা। মধ্য আকাশে প্লেনের ছাদ থেকে পড়ে গিয়ে কয়েকজনের মৃত্যুও ঘটে। বিভিন্ন খবরে ও সোশ্যাল মিডিয়াতে যার ভয়াবহ, মর্মান্তিক ভিডিও ফুটেজ আমরা দেখেছি।
সাম্প্রতিক এক জরীপে প্রকাশ পেয়েছে, প্রতি দশজন আমেরিকানের মধ্যে সাতজনই বিশ্বাস করে, যেই আফগানরা তাদের দেশের ভেতর মার্কিন সেনাদের আভ্যন্তরীন কাজে এতো সাহায্য সহযোগিতা করেছে, সেই আফগানদের আমেরিকার মাটিতে বৈধ কাগজ পত্রের মাধ্যমে অবশ্যই স্থায়ী ভাবে থাকার ব্যবস্থা করা উচিত। অনেকটা বন্ধুত্বের ঋণ শোধের মত। এটা আর নতুন কি কথা। আমরা সকলেই কম বেশী জানি, কোনো এলাকায় ঘাঁটি গাড়তে হলে, আগে সেই এলাকার স্থানীয় লোকজনদের সাথে হাত মেলাতে হয়। বিশ্ব জুড়ে মার্কিন সেনারা তাদের মিলিটারি অপারেশনে এই ফরমুলা সব সময়ই ব্যবহার করে।
তবে আমেরিকান ইমিগ্রেশন খুবই দীর্ঘ ও জটিল একটি প্রক্রিয়া। তাই সাধারণ আমেরিকান পাবলিক মনে মনে চাইলেও, ইমিগ্রেশন এর আওতায় বৈধভাবে নথিভুক্ত হতে এই সব মানুষগুলোর কতদিন সময় লাগবে তা আল্লাহ্ই জানেন। আমেরিকার যে পাঁচটি স্টেইট সর্বোচ্চ সংখ্যক আফগান শরনার্থীদের সাদরে গ্রহণ করেছে, তাদের মধ্যে ক্যালিফোর্নিয়ার পরে, দ্বিতীয় স্থানেই আছে টেক্সাস। বলাই বাহুল্য, সবচেয়ে বড় দুটি স্টেইট, সবচেয়ে বেশী সংখ্যক রেফিউজিদের সহায়তা প্রদানে সক্ষম ও সক্রিয় ভূমিকা রাখছে।
টেক্সাস স্টেটের অস্টিন, ডালাস, হিউস্টন এলাকায় এবং এল পাসোর সামরিক ঘাঁটিতে অবস্থান করছে প্রায় দশ হাজারের মত আফগান, তাদের অস্থায়ী শেলটার কেন্দ্রগুলোতে। তাদের জন্য স্থায়ী পুণর্বাসন এর ব্যবস্থা কবে, কখন হবে তা এখনো সরকারের তরফ থেকে ঠিক হয়নি। এরই মাঝে বহু বেসরকারি ও চ্যারিটি অর্গানাইজেশন এবং বিভিন্ন মসজিদ কমিটির পক্ষ থেকে শহরব্যাপী ডোনেশন ও রিলিফ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। শুকনা খাবার, ওষুধ, কাপড় চোপড়, ঘর গৃহস্থালির সামগ্রী, প্রসাধন সামগ্রী, জায়নামাজ, এমন অনেক কিছু সবার তরফ থেকে সংগ্রহ করে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে দুস্থ মানুষগুলোর দুয়ারে।
এক উইকেন্ডে আমার দুই ছেলের সৌভাগ্য হয়েছিল এখানকার লোকাল মসজিদ দ্বারা আয়োজিত আফগান রিলিফ কার্যক্রমে ভলান্টিয়ার করার। ঘরের আনাচে কানাচে পড়ে থাকা এমন অনেক কিছুই আছে যা আমরা নিত্য ব্যবহার করিনা। সেদিন সকালে আমরা সবাই মিলে সারা বাড়ি ঘেটে অনেক অব্যবহৃত পোশাক, জুতো, জামা, জিনিসপত্র পেলাম যা সহজেই দান করা যায়। আমার ছেলেরা রিলিফ কেন্দ্রে গিয়ে অন্য অনেক ভলান্টিয়ারদের সাথে একত্রিত হয়ে সব জিনিস ভাগ করলো, ব্যাগ বানালো, বাক্সে ভরলো। তারপর সেগুলো ট্রাকে তোলা হলো। পরে জেনেছি, সেই উইকেন্ডে মোট ২০০ আফগান পরিবারের কাছে ঐ রিলিফ এর বাক্সগুলো পৌঁছে দেয়া হয়।ঐ পরিবারটির কথা মাঝে মাঝে মনে হয়। তারা কেমন আছে কে জানে। হয়তো অন্য এক ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের পারকিং এ দাঁড়িয়ে ভায়োলিন বাজায়। ভায়োলিনের সুর যতই হৃদয় ছোঁয়া হোক না কেনো, ওদের জীবনের সুর অনেক বেশী নির্মম, অনেক বেশী আবেগবর্জিত। যেই সুরে প্রায়শই ছন্দপতন ঘটে। ইদানীং রাস্তার মোড়ে, ট্রাফিক লাইটে গাড়ি থামলে এমন অনেক আফগান চেহারার দেখা মেলে....বড় একটি সাইন বোর্ড, দান বাক্স নিয়ে বসে আছে। দেশছাড়া ঐ মানুষগুলোর দিকে তাকালে মনে হয় ওদের চোখে অনেক স্বপ্ন, মনে অনেক আশা।
এই অচেনা দেশে নতুন করে জীবন শুরু করার আশা। অতীতকে ভুলে সামনের দিকে এগিয়ে যাবার আশা। আমেরিকান ইমিগ্র্যান্ট সমাজে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার আশা। এই সংগ্রামী, প্রত্যয়ী মানুষগুলোর আর ফেরারতো কোনো পথ নেই। একমাত্র ভবিষ্যতই জানে ওদের জন্যে কি অপেক্ষা করছে।
True depiction of the plight of Afghani refugees. This is a common story of many Middle Eastern countries where inhabitants are fleeing their homeland in search of a better haven. While going through stories like this, the first thing that comes to my mind is how fortunate we are to firstly have a homeland, secondly to be able to talk in our own native language. At least we still have our roots firmly attached.
ReplyDeleteAfghanistan a country that has been invaded and destroyed many times by many countries and influential regimes, which has left the citizens ABUSED and HOMELESS.
ReplyDeleteThe endless struggle of these innocent people makes us aware of our own standing.
ভাল লাগল তোমার লেখাটি পড়ে
ReplyDeleteআমরা কত ভালো আছি পরমের কৃপায় অথচ কত মানুষ বিশেষ করে যারা বাধ্য হয়েছে দেশ ছাড়তে এবং গৃহহীন মানুষ যারা জানেনা কোথায় যাবে, পরবর্তী খাবার কোথা থেকে আসবে তাদের কথা কি আমরা ভাবি, ভাবলেও সক্রিয় ভাবে কি কোন পদক্ষেপ নেই? প্রচুর খাবার আর লেটেস্ট ফ্যাশনের পাশাপাশি এ এক বিরাট বৈষম্য। লেখাটি পড়ে খুব ভালো লাগলো। এই ব্যাপারে তুমি শুধু আলোকপাতই করোনি, সক্রিয় ভাবে নিজে এবং তোমার ছেলেরা এই বিপর্যয়ের সমাধানে অংশ গ্রহণ করেছ।
ReplyDeleteThey are touchy on the subject of war issue and government and you have pick your words carefully when talking about it. I liked it .
ReplyDelete