সুন্দরের সাথে, এজিং


কিশোরী বয়সে আমার খুব প্রিয় টিভি সিরিজ ছিল চার্লিজ অ্যানজেলস। প্রতি সপ্তাহে বিটিভিতে যখনই প্রচারিত হতো, আমি খুব আনন্দিত আর বিস্মিত হয়ে সিরিজ গুলি উপভোগ করতাম। তিনজন চপলা, চঞ্চলা, সুন্দরী রমণী তাদের প্রখর বুদ্ধি, কৌশল আর সুনিপুণ শারীরিক ট্রেইনিং এর জোরে সব ধরনের দুষ্ট লোকদের দমন করে বেড়াচ্ছে। আমেরিকায় চলে আসার পর বহুদিন আর সিরিজটি দেখা হয়নি।  

গত ২০০০ সালে চার্লিজ অ্যানজেলস এর প্রথম হলিউড মুভি তৈরি হয়। এতে আমার দু'জন প্রিয় অভিনেত্রী অভিনয় করেন। ক্যামেরন ডিয়াজ এবং ড্র ু ব্যারিমোর। তারা দুজনেই সিনেমাটিতে দুর্দান্ত অভিনয় করেন। বাস্তব জীবনে আবার এরা দুজন  'জানি দোস্ত'। 

সেদিন একটা খবর পড়ছিলাম। ক্যামেরন ও ড্র ু  দুজনেরই বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি হওয়া সত্ত্বেও তাদের দেখে মনেই হবে না তাদের প্রকৃত বয়স। কারন তারা খুব স্বাভাবিক গতিতে নিজেদের স্বকীয়তা বজায় রেখেই ধীরে ধীরে বার্ধক্যের দিকে এগুচ্ছে। 

পাশ্চাত্য দুনিয়ায় ইংরেজিতে একটা এক্সপ্রেশন আছে, যাকে বলা হয় Aging Gracefully. খুব সম্ভবত, এই দুইজন ভাগ্যবতী মহিলা ঐ ক্যাটাগরিতেই পড়েছে।  খবরটিতে বলেছে, ওদের দু'জনার কেউই আধুনিক যুগের বোটক্স বা ফিল্টারস এ বিশ্বাসী নয়। ডিয়াজ একবার মুখে বোটক্স ট্রিটমেন্ট করেছিলেন এবং তার ভয়াবহ রেজাল্টও পেয়েছিলেন। তারপর থেকেই তিনি আর করেননি। ফ্যান বা ভক্তকূলের মতে, এই দুই সুন্দরী বান্ধবীজুগল হলো, পারফেক্ট এইজ লেস বিউটি। 

বার্ধক্য মানব জীবনের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি যা কিনা আগে থেকেই প্রকৃতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। জীব বিজ্ঞান বলে, পঁচিশ বছর বয়স পর্যন্ত মানুষের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে এবং তারপর থেকেই সকলের দেহ বার্ধক্যের দিকে যাত্রা শুরু করে। মানুষের জীবনে শারীরিক ও মানসিক উভয় ক্ষেত্রেই আসে পরিবর্তন। 

বিজ্ঞানীদের মতে, তিন ধরনের বার্ধক্য গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসে। মানসিক বার্ধক্য, সামাজিক বার্ধক্য এবং শারীরিক বার্ধক্য। কিন্তু কোন বার্ধক্য একা আসেনা। কোন না কোন বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে আসে। আর সেটাই হয় মহাবিপদ। প্রতিটা মেয়ের জীবনেই এক বা একের অধিক বার্ধক্য আসবে। তবে কখন, তা সে আগে থেকে জানেনা। আর জানার পর মেয়েটি  কিভাবে সেটা সামাল দিবে তাও বিরাট বিবেচনার বিষয়।

প্রাকৃতিক নিয়মেই সব সৃষ্টির বয়স বাড়ে। নারী জাতি এই নিয়মের বাইরে নয়। বয়স বাড়লে চোখের কোনে, নাকের দু'পাশে, কিংবা কপালের পাশে দেখা দেয় বলি রেখা। কিংবা চামড়ায় ভাঁজ পড়ে। সকালে ঘুম ভাঙ্গে শরীরের নানান অংশে ব্যাথা নিয়ে। তারা ভয়ে, আতংকে জর্জরিত হয়। এই বুঝি তারা বুড়ীয়ে গেলো। 

এজিং বা বয়স বৃদ্ধি রুখে না দেয়া গেলেও, কিছুটা সচেতনতা অবলম্বন করে এর গতিকে ইতিবাচক পর্যায়ে ঠেলে দেয়া যায় এবং বৃদ্ধির হার ধীর করা যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে,  অল্প বয়স থেকেই সঠিক খাদ্যাভাস মেনে চলা, নিয়মিত ব্যায়াম করা এবং ত্বকের যত্ন নিতে শুরু করলে বার্ধক্য আসা পেছানো সম্ভব। তবে পেছানো গেলেও এর আসা কি বন্ধ করা সম্ভব? 

আমরা সব সময় টিভিতে, বিজ্ঞাপনে, ম্যাগাজিনে, ইন্টারনেটে একটা কথাই ঘুরে ফিরে চলতে দেখি। কি করে বার্ধক্য রোধ করা যায়? বিউটি এক্সপার্ট, নিউট্রিশনিস্ট, হেয়ার স্টাইলিস্ট, মেকাপ আর্টিস্ট, ফিজিক্যাল ট্রেইনার, এমনকি ডার্মাটোলজিস্ট সহ সকলের মুখে সব সময় শোনা যায় বয়স ঠেকানোর নানাবিধ উপায়, মন্ত্র, কৌশল আর পরামর্শ। 

কিন্তু এখানেই আমার আপত্তি। একটি নির্ভেজাল আপত্তি। আমার প্রশ্ন হল, বয়স কেনো ঠেকাতে হবে?... বা, বয়স ঠেকাবো কেনো? বয়সের নেতিবাচক দিকটা না ভেবে এর ইতিবাচক দিকটা দেখলে মন্দ কি? দেই না আমরা বয়সকে তার স্বাভাবিক নিয়মে চলতে। আর সেই বয়সের সাথে তাল মিলিয়ে একসাথে কি করে পথ চলতে হয়, আমরা তা নতুন করে শিখে নেই, নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করি। বয়সের সাথে প্রতিযোগিতায় না নেমে বরং তা নিজের ভেতরে সাদরে গ্রহন করে, আমরা হতে পারি আরো আকর্ষনীয়, আরো লাবন্যময়। 

সামঞ্জস্যতা খুব জরুরী একটা বিষয়। আমরা অনেক সময় সেটা ভুলে যাই। নিজেদের স্বকীয়তা বা নিজস্বতা বজায় রাখতে গিয়ে আমরা বয়সের সামঞ্জস্যতা হারিয়ে ফেলি। বিশ বছর বয়সে যে পোশাকটা পড়তাম, চল্লিশে এসে সেটা নাহয় নাই পড়ি। তিরিশ বছর বয়সে যেভাবে কথা বলতাম, তারুণ্যের প্রকাশ ঘটাতাম, পঞ্চাশে এসে নাহয় সেটা বদলে আরো ধীরস্থির ও উপলব্ধি সূচক ভঙ্গী উপস্থাপন করি।  

বয়স বৃদ্ধি কোনো অপরাধ নয়। বয়স বৃদ্ধি একটি অর্জন। জ্ঞ্যান এবং অভিজ্ঞতার অর্জন। পরিপূর্ণ সফলতার অর্জন। সুন্দর মন ও মননের প্রতিস্থাপন। প্রতিটা কাজের যেমন আলাদা আলাদা ধারা আছে, প্রতিটা বয়সেরও তেমন মানানসই ব্যাপার আছে। তার মানে এই না যে বয়স হয়েছে বলে আমরা সময়কে উপভোগ করবো না, মনের শখ আহ্লাদ মেটাবো না, জীবনের ইচ্ছা পূরণ করবো না। বরঞ্চ সব কিছুই করবো বয়সের সাথে উপযোগী আর জীবনের সাথে মানানসই। জীবনতো একটাই। সময়ের চাকাতো ঘুরবেই। 

একটি মেয়ে তার পোশাক আশাক, চালচলন, কথাবার্তা, অভিব্যক্তি সব কিছু মিলিয়ে নিজেকে প্রতিনিয়ত উপস্থাপন করে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে মেয়েদের চেহারায় যে সৌন্দর্য আসে, তার দ্যুতি আর দীপ্তি হয় অনেক বেশী উজ্জ্বল, অনেক বেশী প্রখর। যে উজ্জ্বলতা, জীবনের বহু চড়াই, উতরাই পেরিয়ে আসার ফলাফল। যে প্রখরতা, জীবনের বহু ঘাত প্রতিঘাত সহ্য করার নতীজা। যে উজ্জ্বলতা কখনো ম্লান হয়ে যায়না, যে দ্যুতি কখনো মিইয়ে আসেনা। 

বয়স বাড়ার সাথে সাথে পোশাকের ধরণ, সাজগোজের ধরণ, কথাবার্তার ধরণ, নিজেকে উপস্থাপন, সব কিছুতেই যখন সামঞ্জস্যতা ও বয়স উপযোগী নিজস্ব রুচির ছাপ দেখতে পাওয়া যায়, হয়তো তখনই তাকে বলা হয় Aging Gracefully বা সুন্দরের সাথে এজিং।

Comments

  1. You have given an apt explanation of aging gracefully. Aging doesn't mean getting weaker and falling ill or stopping learning and staying at home. We need to change our attitude and embrace the glory of maturing gracefully.

    ReplyDelete
  2. তোমার মত করে এতো সুন্দর করে যদি সবাই ভাবতে পারতাম?তোমার লেখার থেকে অনেক কিছুই শেখার আছে।ধন্যবাদ এতো ভাল একটা বিষয়কে উপস্থাপন করার জন্য।

    ReplyDelete
  3. Age, Grace and Beauty can be a great combination if it is demonstrated in a consistent manner. So much to take away from this great piece of writing

    ReplyDelete

Post a Comment