টিকটকের স্রোতে 𝅘𝅥𝅮𝅘𝅥𝅮𝅘𝅥𝅮

ঘড়ির কাঁটা টিকটক আওয়াজ করে ঠিকই তবে সেটা বেশীর ভাগ সময় খুব মৃদু স্বরে। কিন্তু এ যুগের টিকটকেরা অনেক বেশী আওয়াজ তুলছে, তাদের অনেক বেশী চোখে পড়ছে আর তাদের চলার গতি অনেক বেশী দ্রুত। এক প্রকার বলা চলে, তাদের সাথে কেউ আর পেড়ে উঠছে না - চিন্তা ভাবনায়, সৃষ্টিশীল কাজে, কিংবা প্রভাব বিস্তারে। আমি আজ ব্লগ লিখছি প্রজন্ম জেড বা Generation Z এর ছেলেমেয়েদের নিয়ে, যারা বর্তমান সময়ে 'টিকটক জেনারেশন' নামে পরিচিত। অর্থাৎ, বর্তমান সময়ের টিনএজাররা হল টিকটকের মূল চালিকা শক্তি। 

টিকটক কি? ২০১৬ সালে চায়নাতে একটি ভিডিও শেয়ারিং অ্যাপ উদ্ভাবিত হয় যার নাম ছিল  Douyin. তবে তার বিস্তার শুধুমাত্র চায়নাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। ঠিক এর এক বছরের মাথায় এটি সারা বিশ্বে জনপ্রিয় হওয়া শুরু করলে, এই অ্যাপটিকে নতুন করে সাজিয়ে কিছু পরিবর্তন এর মাধ্যমে 'টিকটক' নামকরণ করা হয়। সঙ্গে সঙ্গে তরুণ তরুণীদের মধ্যে এটি তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করে। কারন অ্যাপটি দিয়ে ভিডিও তৈরি এবং শেয়ার করতে ছেলেমেয়েদের খুব বেশী বেগ পেতে হয়না। 

জেনারেশন ওয়াই বা মিলেনিয়ালসরা যখন ফেসবুক আর ইন্সটাগ্রাম নিয়ে খুবই সাড়া জাগিয়েছিল, তখন আমরা ওল্ড স্কুলাররা ভাবছিলাম, বাহ দারুন তো। প্রযুক্তি দুনিয়ায় এবং সামাজিক মাধ্যমে কি বড় রকমের একটা পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু কে জানতো, এরপরও অপেক্ষা করছে আরো বিস্ময়। 

ওয়াই এর পর এলো জেনারেশন জেড বা Z, যাদের বলা হয় ডিজিটাল নেটিভস। কারন তাদের জন্মই হয়েছিল ডিজিটাল যুগে, স্মার্ট ফোন আর ট্যাবলেটকে সাথে করে। স্মার্ট ফোনের আগে জীবন যাত্রা কেমন ছিল তা সম্পর্কে এদের বিন্দু মাত্র ধারণা নেই। এদের পারিবারিক জীবন, শিক্ষা জীবন, সামাজিক জীবন সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত হয় ইন্টারনেট এর মাধ্যমে। এরা ক্যমুনিকেশনে বিশ্বাসী। এরা পরিবর্তনে উৎসাহী। অনেক বেশী স্বাবলম্বী চিন্তা ধারার মানুষ এরা। সবসময় নতুন কিছু সৃষ্টির চিন্তায় এরা মগ্ন। আর তাইতো 'টিকটক' তাদের এই চাহিদা পূরণের জন্য হল সর্বশ্রেষ্ঠ সোশ্যাল ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম। পৃথিবীর ৬০% জেনারেশন জি এর ছেলেমেয়েরা টিকটক করে। এদের বেশীর ভাগেরই বয়স ১৪ থেকে ২৪ এর মধ্যে। 

বিশ্বের ১৫৫টি দেশে ৭৫টি ভাষায় এই টিকটক কার্যকরী আছে। টিকটক এর মূল কেন্দ্র বিন্দু হল অডিও ট্র্যাক্স। অনলাইনে দারুণ পপুলার হওয়া কোন গানের ট্র্যাকে লিপ সিংক করা,  কোন ট্রেন্ডিং টিউন এর সাথে নাচের ভিডিও করা অথবা ভাইরাল হয়েছে এমন কোন অডিওর সাথে একটি অভিনয় ক্লিপ যুক্ত করে দেয়া, ব্যস এই হল টিকটকের জাদুগরি। Z দের তৈরি মাত্র ১৫ সেকেন্ড দৈর্ঘ্যের ভিডিও গুলোই সারা দুনিয়ায় চাঞ্চল্য তৈরি করছে।    

আরও কিছু কারসাজি আছে। প্রতিটি পোস্ট এর সাথে টিকটকাররা জুড়ে দেয় খুবই আকর্ষণীয় কোন হ্যাশ ট্যাগ যা কিনা টপিক এর সাথে সামঞ্জস্য দেয়। অনেক সময়, পুর্বে ভাইরাল হয়েছে এমন পোস্ট থেকে একই হ্যাশ ট্যাগ নিয়ে তাদের নিজেদের পোস্টে জুড়ে দেয়। যাতে টিকটক ফিডে তাদের পোস্টটি অনেক বেশী লাইক পায় এবং তড়তড় করে উপরে উঠতে পারে। 

টিকটক দুনিয়াতে টিকে থাকতে গেলে বা নাম কুড়োতে গেলে জানতে হবে, বর্তমানে কি কি ট্রেন্ড পপুলার চলছে। তারপর সেগুলোকেই নতুন কায়দায়, নতুন ঢঙ্গে আবার নতুন ভাবে সৃষ্টি করে একজন টিকটকার আবার রিপোস্ট করতে পারে। সেখানেও কোন বাঁধা নেই। যেমন পুরোনো মাল নতুন মোড়কে ভরে ব্যবসাদাররা বিক্রি করে, ঠিক সেই রকম।   

ফ্যাশন, ব্যবসা আর টিকটক এখন হাত ধরাধরি করে হাঁটছে। প্রায় সময়ই বিভিন্ন ব্র্যান্ড তাদের পণ্যের প্রমোশন বাড়াতে টিকটকারদের উদ্দেশ্যে হ্যাশ ট্যাগ চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়। আর ওমনি সারা দুনিয়ার টিকটকাররা সেই বিষয়ের সাথে মিল রেখে ভিডিও তৈরির প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে। ব্র্যান্ডের ম্যানেজারদের যেটা পছন্দ হয় সেটা তারা তাদের ব্র্যান্ডের জন্য ফিচার করতে পারে। আর ভিডিওটি যে বানিয়েছে সে হয়ে যায় 'স্টার টিকটকার'। 

আমার ক্লাসের ছাত্রীরা প্রায়ই আমাকে জিজ্ঞেস করে আমার টিকটক আছে কিনা। আমি হেসে বলি, "না নেই, কারন আমার বয়সটা একটু বেশী, টিকটক করার জন্য।" তারা মহা উৎসাহে আমাকে বলে, "না, না বয়স কোন ব্যাপার না। যে কেউই টিকটক করতে পারে।" মিডল স্কুলে পড়া ১২/১৩ বছরের মেয়েগুলোর প্রত্যেকেরই আছে টিকটক অ্যাকাউন্ট। ওদের থেকে জানলাম, যারা Trend Setter তাদেরকে ডাকা হয় TikTok Influencer । এরা কিনা প্রতি পোস্টে হাজার হাজার ডলার কামাই করে। এদের এক এক জনের ৫০ থেকে ২০০ মিলিয়ন ফলোয়ারস আছে।  

কিছু দিন আগে একটা নিউজ দেখলাম যে বাংলাদেশে টিকটক নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, যেটা বলবত থাকবে তিন মাসের জন্য। দেশের তরুণ ও যুব সমাজ টিকটক ও বিভিন্ন ভিডিও গেম ব্যবহারের মাধ্যমে খারাপ পথে যাচ্ছে এবং তাদের মধ্যে অপরাধবৃত্তি ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। অশালীন, উগ্র, আপত্তিকর ভিডিও ও গান প্রকাশের মাধ্যমে টিকটকের তরুণ সমাজ একে অন্যকে খারাপ কাজের ইন্ধন দিচ্ছে। কি ভয়ানক অবস্থা।  

এই অ্যাপের আরো একটি খারাপ দিক হল Cyber Bullying । টিকটকের সব একাউন্ট হল পাবলিক। যে কেউ এতে কমেন্ট দিতে পারে। কম বয়সী, অপরিণত মনোবৃত্তির তরুণ তরুণীরা একে অন্যের চেহারা, স্বাস্থ্য, নাচগানের দক্ষতা নিয়ে একে অন্যের ভিডিওতে অপ্রীতিকর মন্তব্য, অপমান সূচক কথা, কটূক্তি করে থাকে। তার ফলোশ্রুতিতে অনেক টিনএজারদের মধ্যে বিরাজ করে ডিপ্রেশন, হতাশা, বিদ্বেষ, এমনকি আত্মহত্যা করার প্রবণতা।   

এ যুগের ছেলেমেয়েরা ভীষণ ভাবে আলাদা। তারা নিজেদের সর্বক্ষণই তুলে ধরতে চায়, প্রকাশ করতে চায়। অচেনা, অপরিচিত মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের মধ্যে পায় অসীম আনন্দ। তবে তা কঠিন অধ্যবসায় বা পরিশ্রমের মাধ্যমে নয়। বিরাট কিছু আবিষ্কারের মাধ্যমে নয়। বরঞ্চ খুব সহজে, অল্প সময়ে, কিংবা ফাঁকি ঝুঁকি, মেকি কার্য কলাপের মাধ্যমে। লিপ সিঙ্কিং, ভিডিও এডিটিং, ফিল্টারিং প্রমুখ আর যাই হোক, শিল্পের বহিঃপ্রকাশ তো নয়ই। এসবের মাধ্যমে প্রতিভা বা গুণ কোনটারই প্রকাশ ঘটেনা। প্রকাশ ঘটে, কে কতটা Tech Savvy বা প্রযুক্তিতে পারদর্শী।

যতো দিন যাচ্ছে, আমাদের জীবন থেকে খাঁটি /অকৃত্রিম /আসল /বিশুদ্ধ  শব্দগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। আমরা আগের জেনারেশনের মানুষেরা চুপ করে মেনে নিচ্ছি, নীরবে দেখে যাচ্ছি। পরিবর্তনের এই ঝড়, ঠেকানোর নয়। যুগের পরিবর্তন, মানুষের পরিবর্তন, ধ্যান-ধারনার পরিবর্তন। আমাদের উত্তরসূরিরা এই পরিবর্তনের স্রোতে গা ভাসিয়ে চলেছে। 

কিন্তু ভয় হয়, এর পর কি হবে?... এই ধারা আর কত দূর যাবে? প্রতিটা ভালোরই কিছু মন্দ দিক থাকে। 

    

Comments

  1. What a brilliant topic you have focused on. A prevalent one which has become quite contagious mainly with the younger generation.
    Due to belonging to the primitive generation, it has become increasingly difficult for me (us) to comprehend with this rapid change, where purity and authenticity is clearly missing.
    Well done to you again

    ReplyDelete
  2. খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় এটি। প্রথমে ফেসবুক আর টুইটার শেখালো কিভাবে নিজের জীবনকে সম্পূর্ণ কৃত্রিমভাবে সাজিয়ে ছবির মত সকলের সামনে তুলে ধরা যায়, আর এখনকার ভিডিও অ্যাপ গুলো বের করে এনেছে তরুণ তরুণীদের বিখ্যাত হবার বাসনা। অভিনেতা/অভিনেত্রী, গায়ক/গায়িকা, খেলোয়াড় হবার ইচ্ছায় আগে কত তরুণ/তরুণী তাদের জীবনের বহু বছর নষ্ট করত, আর এখন সবারই সুযোগ হয়েছে টিক-টক বা ইউ-টিউব ষ্টার হবার।

    কেউ কি তাদের বলবেন, একজন ষ্টার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে কত লক্ষ ষ্টার আকাশ থেকে ঝরে যায়? সেই লক্ষ ঝরে যাওয়া বেশীরভাগ ষ্টার নিভৃতে সন্মাণজনক জীবনযাপনের বদলে কাটায় অনুশোচনার, অনটণের জীবন।

    ReplyDelete
  3. Very informative and thought-provoking.

    ReplyDelete

Post a Comment