প্রথম জেনারেশন বাঙালি

জীবনের 'প্রথম' অভিজ্ঞতাটা সব সময়ই অসাধারণ, দারুন স্মরণীয়। এই যেমন, প্রথম দিন স্কুলে যাওয়া। প্রথম কাউকে বলা, আমি তোমাকে ভালবাসি। প্রথম চাকরী পাওয়া। প্রথম কোন রেকর্ড গড়া বা ভাঙ্গা। প্রথম নিজে হাতে রান্না করা। প্রথম মা ডাক শোনা, নাতি নাতনির মুখ দেখাদুনিয়ার বেশীর ভাগ প্রথম অভিজ্ঞতাটাই মনে রাখার মত হয় এবং সম্ভবত কোন নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে জীবনে। 

প্রতিটা দেশের কালচারেইপ্রথম জেনেরেশন ইমিগ্র্যান্ট বলে একটা কথা বা নাম প্রচলিত আছে। বিদেশের পটভূমিতে সেই দৃষ্টিকোণ থেকে 'প্রথম' হওয়ার লেবেলটি যারা পায়, তাদের সেই নতুন অধ্যায়ের শুরু থেকেই অনেক ঝড় ঝাঁপটার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এই যেমন, প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ ছেড়ে যোজন–যোজন মাইল দূরের এই প্রবাস জীবনে দ্বিতীয় নিবাস গড়ে তোলার পর থেকেই আমরা অনুভব করতে শুরু করি, এই আমেরিকাই হবে আমাদের স্থায়ী নিবাস। সেই নিবাস গড়ে তুলতে আমাদেরকে বহু রকম চড়াইউতরাই পার হতে হয়নতুন জীবনের প্রথম দিনগুলো কারো জন্য সহজ হয়, আবার কারো জন্য কঠিন। ভিন দেশকে আপন করে নিয়ে মন মানানোর পরীক্ষায়, প্রথম কেউ পাশ করে, কারো পাশ করতে অনেক সময় লেগে যায়

পড়াশোনা, চাকরী, বিয়ে কিংবা পারিবারিক ইমিগ্রেশন এর মাধ্যমে বাঙালিরা সাধারণত বিদেশে পাড়ি জমায় এবং সম্পূর্ণ নতুন একটি দেশে এসে জীবনটাকে নতুন ভাবে গড়ে। তাদের ভাবনায় যে জিনিসটি প্রাধান্য পায় সেটি হল, নতুন জায়গায় প্রতিষ্ঠা লাভের কথা। প্রতিষ্ঠা লাভ খুব সহজে বা একদিনেই হয়ে যায়না। অনেক চেষ্টা, অনেক ধৈর্য, অনেক পরীক্ষা, অনেক পরিশ্রমের বোঝা তাদের বহন করতে হয় প্রথম প্রজন্ম হিসেবে অনেকটা সময় অতিক্রান্ত করার পর কারো কারো ক্ষেত্রে সফলতা আসে - ভাষায়, পেশায়, সামাজিকতায়, জীবন উন্নয়নে। কারো কারো ক্ষেত্রে খুব একটা পরিবর্তন হয়না কেউ কেউ আবার পরিবর্তিত হতে চায়না। এটা নিতান্তই প্রত্যেকের ব্যক্তিগত অভিমত বা স্বাচ্ছন্দ্যের জায়গা থেকে আসে।

লেখাপড়ায়, কর্ম ক্ষেত্রে, পারিবারিক জীবনে উন্নতি ও শান্তি লাভের পাশাপাশি, নতুন দেশের মূলধারার সংস্কৃতি, সামাজিক রীতি নীতি, ভাষা, লাইফ স্টাইল প্রণালী সব কিছু রপ্ত করা, খুব সহজ কোন ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় না। আর এই কঠিন কাজটি করতে গিয়েই কোন কোন বাঙালি নিজেদের একদম পরিবর্তন করে ফেলে, কেউ কেউ একেবারেই পরিবর্তিত হয়না। তবে অধিকাংশ অভিবাসি বাঙালিরা কিছুটা পরিবর্তনের মাধ্যমে, যা না হলেই না, নিজেদের বাঙ্গালিয়ানাকে বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে। একই দেশে বাস করেও তাই, বহু দিনের দেশ ছাড়া বাঙালিরা হয় ভিন্ন ভিন্ন ঘরানার, ভিন্ন মতাদর্শের, ভিন্ন চিন্তা-চেতনার।

আমরা অনেক সময় মিশিয়ে ফেলি ধর্ম, সংস্কৃতি আর ভাষাকে। কোনটাকে আগে গুরুত্ব দেয়া উচিত বা কোনটার প্রয়োজনীয়তা আমাদের জীবনে বেশী, সেটা সম্পর্কে সন্দিহান হই। তাই বাংলা ভাষা, বাঙালি রীতি নীতি আর মুসলিম ধর্ম অনুসরন এই তিনে মিলিয়ে কেমন যেন একটু ঘোলাটে হয়ে যায়। এ কথা সত্য যে বাঙালি সংস্কৃতিতে অনেক কিছুই  আছে যা ঠিক মুসলমান রীতিনীতি অনুসারিত নয় বা অন্যান্য মুসলিম দেশ সেগুলো ফলো করে না। আবার অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোর সংস্কৃতি খুঁজতে চাইলে দেখবো, সেগুলো আমাদের থেকে অনেক আলাদা। এই বৈষম্য বা তারতম্য গুলো কোনই সমস্যা তৈরি করে না যখন আমরা নিজ দেশে, বাংলাদেশে বেড়ে উঠি।   

সমস্যাটা শুরু হয় যখন আমরা অন্য কোন দেশে এসে বসতি স্থাপন করি এবং আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে আমাদের আসল ঠিকানা তুলে ধরার চেষ্টা করি। আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে, দ্বিতীয় প্রজন্মের বাঙালি সন্তানদের আমরা কি হিসাবে দেখতে চাই?... মুসলমান? বাঙালি মুসলমান? নাকি শুধুই বাঙালি?... এই চিন্তাতে আমরা বাঙালিরা দ্বিধান্বিত হই। 

আমরা আমাদের সন্তানদের প্রায়ই দোষারোপ করি যে তাদের মাঝে একটা আইডেন্টিটি ক্রাইসিস কাজ করে। তারা কি সেটা তারা নিজেরাই জানেনা বা বোঝেনা। কিন্তু এই অবস্থার জন্য কি আমরা প্রথম জেনারেশন বাঙালিরা আংশিক ভাবে দায়ী নই? শেকড়ের সন্ধান করবার দায়িত্ব শুধু সন্তানদের একার নয়, আমাদের অভিভাবকেরও। যে দেশের মাটিতে তারা জন্মাইনি, সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠেনি, সে দেশের সাথে একাত্মতা অনুভব করা, তাদের জন্য শুধু মাত্র বাবা মায়ের দেয়া কঠিন চাপ ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু তার পরেও আমরা বাবা মা’রা চেষ্টা করে যাই। আমাদের ছেলেমেয়েদেরকে, আমাদের চাইতে আলাদা করে আমরা ভাবতেই পারিনা।    

তবে এই ভাবনার আগে একবার আমাদের ভাবা উচিত, আমাদের নিজেদের পরিচয় কি। আমেরিকান? বাঙালি আমেরিকান? নাকি বিদেশে থাকা খাঁটি বাঙালি? এর কোন সঠিক বা একটি উত্তর নেই। বিদেশের মাটিতে পহেলা বৈশাখ, পিঠা উৎসব, ঈদ মেলা বা বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে বাঙালি সাজসজ্জা করে এবং বাঙালি খাওয়াদাওয়া খেয়ে আমরা অন্তর থেকে বাঙালি ফিল করি। দেশে বেড়াতে গেলে প্লেন থেকে এয়ারপোর্টে বেরিয়ে আমাদের অন্য সত্ত্বা জেগে ওঠে… আমরা আমেরিকা থেকে এসেছি, আমরা বাংলাদেশী আমেরিকান। বিদেশের মাটিতে ইমিগ্রেশন স্ট্যাটাস যাই হোক না কেন, একবার দেশ ছাড়লে আমরা হয়ে যাই অভিবাসী বা প্রবাসী বাঙালি। আবার সন্তানের অদূর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করলে আমাদের মনে হয়, ওরা তো আমেরিকান। আমেরিকার মাটিতেই ওরা লেখাপড়া, চাকরী বাকরি করবে, জীবনসঙ্গী খুঁজে নিবে, নিজেদের পরিবার গঠন করবে। 

পাশ্চাত্যের সঠিক শিক্ষা-দীক্ষা আর সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের স্বাচ্ছন্দ্যময় পরিবেশের মধ্যে বেড়ে উঠছে আমাদের পরের প্রজন্ম। আমাদের কারো কারো সন্তানেরা ধীরে ধীরে এদেশের মূল ধারায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে আদর্শ নাগরিক হিসাবে, খাঁটি আমেরিকান হিসাবে বিভিন্ন সেক্টরের শীর্ষ আসনগুলি দখল করে নিতে সক্ষম হচ্ছে। আর সেটাই স্বাভাবিক। আমরা এটাই চাই। কারন আমাদের প্রবাসী মন সবসময় বলে, আমরা দু’ জায়গারই ভালোটা চাই। এমনটা ভাবা দোষের কিছু নয়। 

যে কঠিন সময়ের ভেতর দিয়ে বিদেশের মাটিতে আমরা নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠা করি, তা শুধু আমরাই জানি, আমরাই বুঝি। এই বাস্তব সত্যিটার কথা জানে আমার সকল প্রবাসী বাঙালি ভাইবোন। খোঁজ নিলে দেখা যাবে আমাদের প্রত্যেকেরই কোন না কোন স্মরণীয় গল্প আছে - আমেরিকার মাটিতে আমাদের জীবন শুরুর প্রথম দিন গুলোকার। যেই গল্পের মাহাত্য বুঝবেনা, দেশে থাকা বাঙালি পরিবার পরিজনেরা অথবা, এ দেশে জন্ম ও বড় হওয়া দ্বিতীয় প্রজন্মের বাঙালি ছেলেমেয়েরা। যেই গল্পগুলো শুধু মাত্র প্রথম জেনারেশন বাঙালিদের। যে গল্পগুলো তাদের মনের খুব গভীরে বাস করে, হৃদয়ে দোলা দেয়, স্মৃতির পাতায় লেখা রয়।

আমার গল্পটা আমি বলেছি - মাছে ভাতে বাঙালি তে, এখানে শেয়ার করলাম।

সবশেষে, কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বিদেশী ফুল’ কবিতার কয়েকটি লাইন উদ্ধৃত করলাম।

“হে বিদেশী ফুল, যবে আমি পুছিলাম - কি তোমার নাম,

হাসিয়া দুলালে মাথা, বুঝিলাম তরে, নামেতে কি হবে।

আর কিছু নয়, হাসিতে তোমার পরিচয়।”

Comments

  1. সকল প্রবাসীদের হয়ে সুন্দর ভাবে একটি চিত্র অঙ্কন হয়েছে এই লেখাতে। সম্প্রতি আমার এক বন্ধুর মন্তব্যের উত্তরে আমি বলেছি : ঠিক, আমি মনে প্রাণে বাঙালী। এটাই আমার প্রথম পরিচয়। তবে যেহেতু পৃথিবীর বিভিন্ন মানুষের সাথে ওঠাবসা করেছি, পড়াশোনার ক্ষেত্রে, কর্মক্ষেত্রে, যদিও আমার পরিচয় বদলায়নি তবে এর পরিধি বেড়েছে।

    ReplyDelete
  2. Enjoyed reading this interesting piece

    ReplyDelete
  3. Very nice elaboration! You are absolutely right, that first of all it is the responsibility of parents to make their children understand the roots of their culture and country. Because children learn from their parents and past generations. Therefore, the parents and the past generations should be primarily aware of all these.

    ReplyDelete

Post a Comment