একই বৃন্তে

আমি খুব করে চাইতাম ওদের দলে ভিড়তে। কিন্তু ওরা আমাকে বড় হিসাবে আমলই দিতো না। আমি ছিলাম, দুধ ভাত। খেলায়, ছোট সদস্যরা যেমন হয়। আমার অনেক অভিমান হতো। ভাবতাম কত তাড়াতাড়ি বড় হবো আর ওদের দলে সামিল হবো। আপাদের কাছ থেকে পাত্তা না পেয়ে কখনো কখনো মা'র পিছে পিছে ঘুরতাম। তাতেও লাভ হতোনা। আমরা তিন বোন ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়ে ছিলাম বলে আর আমি পরিবারের সবচেয়ে কনিষ্ঠ সদস্য হওয়ায়, আমি ছিলাম তিন জনের চোখের মণি। সবার আদরের ধন। আমাকে, মা ও আপারা  সব সময় আগলে আগলে রাখতো।  

বড় আপা আর মেঝো আপা কাছাকাছি বয়সের হওয়ায় ওদের মধ্যে ছিল নিবিড় বন্ধুত্ব। ওরা বই খাতা শেয়ার করতো, কাপড় জামা শেয়ার করতো, পছন্দ-অপছন্দের জিনিস শেয়ার করতো। নিজেদের বড় হওয়ার গল্প শেয়ার করতো। আমি ছিলাম ওদের বেবি সিস্টার। মা'এর পরে, বড় আপাই আমাকে মা'এর স্নেহ দিতো। প্রায় সময়ই খাইয়ে, গোসল করিয়ে দিতো। আমার সব অপকর্ম গুলো মা'এর কাছ থেকে আড়াল করে রাখতো। আমি ঘুমাতামও বড় আপার সাথে, ওর বিছানায়।

বড় হওয়ার দিন গুলি ছিল খুবই মধুর, খুবই নির্মল। ছিমছাম, পরিপাটি, অল্পের মধ্যেই খুব সুন্দর করে থাকতাম আমরা। অঢেল টাকা পয়সা, বিত্ত বৈভব, প্রাচুর্য্য আর বিলাসিতা এর কোন কিছুই ছিল না আমাদের বাড়ীতে। তার বদলে ছিল স্নেহ-মমতা, সরলতা, উদারতা, আতিথিয়তায় পরিপূর্ণ আমাদের ছোট্ট নিবাস। কেউ একবার আমাদের বাড়ীতে এলে, ফিরে যেত অনেক গুলো সুন্দর সময়কে সাথী করে। ঈদ এর সময় আমাদের খুশী ছিল একসাথে হাতে মেহদি দেয়ায়, মা'কে রান্নার কাজে সাহায্য করায়, ঘরদোর ঝেড়ে মুছে পরিষ্কার করে মেহমান আপ্যায়ন করায়। কোন দামী জামা, জুতো, খেলনা, গহনার বায়না আমরা কখনই ধরতাম না। কখনো ঈদ এ নতুন কাপড় না হলে কোন মন খারাপ ছিল না। আত্মীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীর বাড়ীতে ঈদ এর দিন ঘুরতে যাওয়ার মাঝেই অনেক আনন্দ লুকানো থাকতো। সবচেয়ে খুশী হতাম যেবার আমরা নানা বাড়ীতে ঈদ করতে কুষ্টিয়ায় যেতাম। 

কিছু সামান্য চাওয়া, কিছু সামান্য পাওয়া, তাতেই আমরা অনেক বেশী খুশী হতাম। টাকা জমিয়ে চাইনিজ খেতে যাওয়া, প্রিয় গানের ক্যাসেট টেপ করা, পছন্দের গল্পের বই কেনা, রাস্তায় ভ্যান থেকে চটপটি-ফুচকা কিনে খাওয়া, শুক্রবার দুপুরে সকলে মিলে বসে বিটিভিতে বাংলা সিনেমা দেখা, এমন কিছু স্মরণীয় স্মৃতি আমাদের মণিকোঠায় আসা যাওয়া করে। আমাদের বাড়ীর খুব কাছে ছিল বিহারীদের পাড়া। বিহারীদের বানানো শিক কাবাব, আলুর চপ, ডালপুড়ি, হালিম, জিলাপি ছিল অতুলনীয়। সেই অপূর্ব স্বাদ, সেই মন কাড়া সুঘ্রাণ অনেক বড় বড় হোটেল, রেস্তোরার খাবারেও আর ফিরে পাইনা।   

লোড শেডিং এর কারনে যখন রাতের বেলা ঝুপ করে ইলেক্ট্রিসিটি চলে যেত, আমরা সকলে বিছানার উপর বসে গানের আসর জমাতাম। মেজ আপা নিয়মিত গান শিখত। ওর ছিল দারুণ গানের গলা। ও প্রথমে গান ধরত, ওর সাথে তাল মিলিয়ে আমি আর বড় আপা গলা ছেড়ে, গলা মিলাতাম। সে কি আনন্দ, সে কি উল্লাস। বর্ষাকালে যখন তখন বৃষ্টি নামলে, আমরা দৌড়ে ছাদে গিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতাম। বোশেখ মাসে শিলা বৃষ্টি হলে ছাদে গিয়ে শিল কুড়াতাম। বাড়ীতে ওস্তাদ খালা যখন কোরান পড়া শেখাতে আসতেন, তখন এক মজার কাণ্ড হতো। উনি যেহেতু আমাদের একজন একজন করে পড়াতেন, আমরা তিন বোনের কেউ প্রথমে যেতে চাইতাম না। কোন না কোন উসিলায় আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়তাম আর এ, ওকে ঠেলতাম।

ছেলেবেলায়  আমার বাতিক ছিল প্রায়শই জানালা দিয়ে জিনিস পত্র ফেলে দেয়া। বেশ কয়েকবার এমনটা করেছি। খুব সাংঘাতিক ভাবে করেছি। বড় আপার বাচ্চা কালের দুটো সোনার বালা জানালা দিয়ে ফেলে দিয়েছিলাম। যে দুটো ছিল ওকে দেয়া আমার দাদীর শেষ চিহ্ন। আরও একবার ফেলে দিয়েছিলাম বাড়ীর গেটের চাবি। যেটা কিনা জানালা থেকে পড়ে কার্নিশের ওপর ঝুলছিল, ভাগ্যিস। নয়ত এটাও হারিয়ে যেত। এ সব গল্প  আমরা তিন বোন এখন স্মরণ করি, অনেক হাসি আর আনন্দে। আর নেই কোন অভিযোগ, নেই কোন অনুযোগ। জীবনের মধ্য লগন পার করে দিয়ে, বোনদের সাথে কাটানো সুখস্মৃতি গুলি খুব মনে পড়ে।

এখন আর ওদের দলে জায়গা পাওয়ার জন্য তদবির করতে হয়না। জায়গা না পাওয়ার কোন আক্ষেপও নেই। কারন এখন আমরা সবাই বড়, আমরা এখন বন্ধুর মত। ছোটবেলার সাথীর মত। হাসি, কান্না, ভালো, মন্দের ভাগীদার। একে অপরের কষ্ট বোঝার সমঝদার। আমরা আমাদের এই জীবনের সুখ, দুঃখের গল্প শেয়ার করি। শেয়ার করি, পেছনে ফেলে আসা সেই ভুলতে না পারা সময় গুলোর কথা। তবে চাইলেও আমরা একে অপরকে দেখতে পাইনা, কাছে পাইনা। একই বাড়ীতে কাটানো মধুর দিন গুলি আর ফিরে আসেনা। কোথায় হারিয়ে গেলো সেই সব সোনা ঝরা দিন!

'ন্যাশনাল সিস্টার্স ডে' পালিত হয় অগাস্টের প্রথম রবিবারে। এ বছর, প্রথম রবিবার পড়েছে পহেলা (১লা) অগাস্টে। তাই এই দিনটিতে স্মরণ করছি আমার প্রিয় বড় দুই বোন, দুই আপাকে। অবাক হলেও সত্যি, আজ আমরা ভিন্ন ভিন্ন তিনটি মহাদেশের বাসিন্দা। আমাদের জীবনের চলার পথ তিনটি ভিন্ন দিকে ধাবিত হয়েছে। ভাগ্য আমাদের একে অপরের কাছ থেকে অনেক দূরে নিয়ে গিয়েছে। তবে আমরা যে যার জায়গায় বিদ্যমান, প্রতিষ্ঠিত। আমরা আমাদের বোনদের নিয়ে গর্বিত।    

বোনে, বোনে ভালোবাসার যে বন্ধন তা কখনো ছিন্ন হয়না। এই পৃথিবীতে যাদের বোন আছে তারাই শুধু জানে, কত সহজে এক বোন আর এক বোনকে তার হৃদয় নিঙ্গড়ানো আবেগ, অনুভূতির কথা বলতে পারে। দুঃসময়ে পাশে চাইতে পারে। বোনের জন্য বোনের যে টান আর ভালোবাসা, তা হয় খাঁটি, নির্ভেজাল। ছোটবেলা থেকেই বোনে, বোনে যে নিবিড় ও গাড় সম্পর্কের বুনিয়াদ হয়, তা হয় একই সূতায় গাঁথা। যেন একই বৃন্তে ফোঁটা, তিনটি ফুল।

"বাঁশ বাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে ঐ
মাগো আমার শোলক-বলা কাজলা দিদি কই?"......যতীন্দ্রমোহন বাগচীর কবিতা 

Comments

  1. I feel so honoured to be your sister. Thank you for restoring some special memories from our childhood on National Sister's day. The enchanting time that we have left behind will always be treasured in our hearts.
    No matter how far away we are from each other, we will always remain the best of friends and draw strength from each other.

    ReplyDelete
  2. Happy Sister's day my darling Palmalina! That is what I thought when you were born. A precious little baby in a size of a palm, yes that small. I am grateful to Allah that I have been blessed with two precious gems, my sisters. May Allah keep our bonding as strong and loving till the last day of our life. Thank you for taking me down the magical memory lane.

    ReplyDelete
  3. তোমার লেখাটি পড়ে আমার নিজের ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল। আমিও সবার ছোট - আদর আহ্লাদে বড় হয়েছি। তুমি যেন আমার মনের কথাগুলোই বলেছো। যে স্নেহমায়া ভালবাসার ছায়ায় তোমরা তিনটি বোন বড় হয়েছো তার অটুট বন্ধন, তিনটি মহাদেশে থেকেও যেন চিরকাল তোমরা উপলব্ধি করতে পারো এই কামনা করি। শুভ বোন দিবস।

    ReplyDelete
  4. It's really a great pleasure to have siblings by our side and spend remarkable moments with them. Unfortunately I didn't have that luck because of not having any brother or sister. By reading your post I was feeling like I wish if I would have siblings. But at the same time I felt happy for you after knowing about your bonding with your sisters. From this write up for the first time I got to know about "National Sister's Day". May your bonding with your sisters remain robust. Always be happy and keep smiling.

    ReplyDelete

Post a Comment