(২য়) ওদের ছেলেবেলায় - কোরবানি

প্রথম যে বার বলেছিলাম 'ঈদ' সম্পর্কে, আমার দুই ছেলে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে ছিল। ওদের বয়স তখন খুব কম, খুব ছোট ছিল ওরা। অবাক বিস্ময়ে সেদিন ওরা জেনেছিল, ক্রিস্টমাস নয়...আমরা ঈদ পালন করি। আবার ১ টা নয়, আমাদের ২ টা ঈদ। রোজার ঈদ আর কোরবানির ঈদ। প্রতি বছর ঈদ দুইটা আসে, দুই মাস দশ দিনের ব্যবধানে। তবে ইংরেজি বছরের কোন মাসে ঈদ হবে, সেটা নির্ভর করে লুনার ক্যালেন্ডার বা চাঁদ পঞ্জিকার উপর। এই ভাবেই শুরু হয়েছিল ওদের ঈদ শিক্ষা। 

আমরা যারা প্রথম জেনারেশন বাঙালি বিদেশের মাটিতে স্থায়ী নিবাস গেড়েছি এবং ছেলেমেয়ের জন্ম দিয়ে বড় করছি, তারা সব সময়ই এক ধরনের আশংকায় ভুগি, অনিশ্চয়তায় ভুগি। আমরা আমাদের বাঙালি সংস্কৃতি, রীতিনীতি, বাংলা ভাষা, ধর্মীয় উৎসব আর নিয়ম কানুন কতটুকু দ্বিতীয় প্রজন্মের বাচ্চাদের মধ্যে দিতে পারবো, শেখাতে পারবো। 

আবার খালি শেখানো, বোঝানো হয়ে গেলেই যে শেষ তা নয়। এগুলি রীতি মত পালন করা দেখাও, ওদের জন্য জরুরী। নিয়মিত দেখার পরেও ওরা এগুলি ওদের নিজের জীবনে বড় হয়ে কতটুকু পালন করবে, তাও ভাববার বিষয়। যে দেশে ওরা জন্মাইনি, সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বড় হয়নি, ধর্মীয় উৎসব পালনে যোগ দেইনি, সেই দেশের সাথে একাত্মতা অনুভব করা ওদের জন্য সত্যিই কষ্টসাধ্য।

তারপরেও আমরা, প্রথম প্রজন্মের অভিভাবকেরা চেষ্টা করে যাই। ছেলেমেয়েদের শেখাই  ঈদ-উল-ফিতর ও ঈদ-উল-আযহা সম্পর্কে। দেশে অনেকে এ দুটোকে ডাকে ছোট ঈদ আর বড় ঈদ। একটি হল সংযম আর সাধনার ঈদ। অন্যটি হল ত্যাগ এর ঈদ। কোরবানি ঈদ এর শুরু কোথা থেকে এবং কেন পালন করা হয় সে গল্পটা ওদের অনেকবার বলেছি। 

আমাদের প্রিয় নবী ইব্রাহীম (আঃ)  আল্লাহতা'লার নির্দেশে তাঁর সবচাইতে প্রিয় মানুষ তাঁর আপন সন্তানকে আল্লাহ্‌র নামে কোরবানি দিতে গিয়েছিলেন। তবে সেটা ছিল উনার ঈমানের পরীক্ষা। কোরবানি দেয়ার মুহুর্তে সন্তানের পরিবর্তে ঐ জায়গায় আল্লাহ্‌র নির্দেশে একটি পশু পাঠানো হয়। সেই পশুটির কোরবানি আল্লাহ্‌ তা'লা কবুল করেন এবং সেই থেকে সমগ্র মুসলমান জাতির জন্য নাজিল হয় কোরবানির আদেশ। আল্লাহ্‌র নামে কোন হালাল পশু জবাই করা হল কোরবানি ঈদ এর তাৎপর্য। 

এই গল্পটি আমরা ছোটবেলা থেকেই পিতা মাতার কাছ থেকে জানি, পাঠ্য বই এ পড়ি। ব্যস তারপর থেকে, মুসলমান দেশে বেড়ে ওঠা আর প্রতি বছর ঈদ উৎসব পালন করার মাধ্যমে ঈদ ঢুকে যায় আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। ঈদ হয়ে যায় আমাদের আত্মার আত্মীয়। 

আমার ছেলেবেলায় - কোরবানি, এর আগের লেখাটিতে ঈদ এর অনেক স্মৃতি চারণ করেছি।

বিদেশের মাটিতে কাটানো ঈদ এ তেমনটি হবার সুযোগ আমার ছেলেদের হয়না। পশু কোরবানি আর হজ্জ এর গুরুত্বের কথা আমাদের মুখ থেকে শুনলেও কোরবানি দেখার সরাসরি অভিজ্ঞতা এর আগে কখনো তাদের হয়নি। তাই এই বছর, আমরা ঠিক করেছিলাম ছেলেদের নিয়ে ফার্মে যাবো আর আদ্যোপান্ত কোরবানির প্রক্রিয়ায় সামিল হবো। 

গত ২০শে জুলাই, ২০২১ ছিল পবিত্র ঈদ-উল-আযহা। যে ছয়/সাতটি বাঙালি পরিবার এক সাথে একটি গরু কোরবানিতে অংশ নিয়েছিল, তারা সকলেই সেদিন ফার্মে উপস্থিত ছিল। আমাদের শহর থেকে প্রায় দেড় ঘন্টা ড্রাইভ দূরে এই ফার্মটিতে সেদিন দেখলাম গরু, ছাগল, মুরগী সব ধরনের প্রাণী বিচরণ করে বেড়াচ্ছে। আগের থেকে বাছাই করে পছন্দ করে  রাখা একটি কালো রং এর গরু, আমাদের সকলের সম্মতি ক্রমে আল্লাহ্‌র নামে জবাই করা হয়। 

এই দেশে একটু ভিন্ন প্রক্রিয়ায় অনেকটা কম কষ্টের মাধ্যমে পশুর প্রাণ হরণ করা হয়। প্রথমে পশুটির মাথা লক্ষ্য করে গুলি করা হয়। পশুটি তাতে হেলে গিয়ে যেই মৃত্যুর মুখে ধাবিত হতে থাকে ঠিক সেই সময়ই তাকে জবাই করা হয়। আমাদের গরুটিকেও একই ভাবে জবাই করা হয়েছিল। তারপর একটি বুলডোজার এর মাধ্যমে মৃত গরুটিকে ঝুলিয়ে তার চামড়া ছেলা হয়। সেই সাথে গরুটিকে বড় বড় কয়েকটি ভাগে টুকরা করা হয়। সেই বড় বড়  টুকরা গুলিকে এরপর আমরা সকলে মিলে হাত লাগিয়ে ছোট ছোট পিস করেছি এবং সবশেষে ওজন করে সাত ভাগ করে নিয়েছি। 

আমার ছেলেরা সেই দিন মহা উৎসাহে মাংস কাটতে আমাদের সাহায্য করেছে। সেই সাথে তারা উপলব্ধি করেছে, আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি লাভের জন্য কেন প্রতিটি মুসলমান পরোপকার ও ত্যাগের মহান আদর্শে অনুপ্রাণিত হয় এবং আল্লাহ্‌র নামে একটি জান কোরবানি দেয়। তারা আরও দেখেছে, আমাদের কোরবানির মাংস সমান তিন ভাগে ভাগ করে, এক ভাগ আমরা গরীব দুঃখীদের জন্য মসজিদে দান করেছি। 

প্যান্ডেমিকের কারনে এবার ঈদ ছিল অন্যরকম। বাঙালিদের বাড়ীতে বেড়াতে যাওয়া, দাওয়াত খাওয়া, এসবের কোন বালাই ছিল না। কিন্তু এবারের কোরবানি ঈদ ছিল আমাদের পরিবারের জন্য সন্তুষ্টি আর পরিপূর্ণতায় ভরা। আমরা নিজে হাতে কোরবানি দিয়েছি, মাংস কেটেছি। আমার ছেলেরা একবার হলেও সশরীরে অংশ নিয়ে এই ত্যাগের উৎসবে যোগদান করেছে। একদিন তারা তাদের পরিবারের সাথে এটি পালন করবে। সেই সব গল্প শোনাবে তাদের ছোটজনদের। বাবা মা হিসেবে আমাদের জন্য এটি একটি পরম পাওয়া।           

Comments

  1. Enjoyed reading this piece, which is based on the significance of Qurbani Eid

    ReplyDelete
  2. Hope they realize that beef is not just steak/meatloaf/burger, chicken not a drumstick, they come from real animals. Animals make the ultimate sacrifice to serve human beings, although not by choice at the moment of sacrificing their lives.

    ReplyDelete

Post a Comment