(১ম) আমার ছেলেবেলায় - কোরবানি
মুসলমান সম্প্রদায়ের বৃহত্তম দুটি ধর্মীয় উৎসবের মধ্যে অন্যতম একটি হল পবিত্র ঈদ–উল-আযহা বা কোরবানির ঈদ। ছেলেবেলায় কোরবানি ঈদ এর অভিজ্ঞতাটা ছিল আনন্দ, ভয় আর কৌতূহল মিশ্রিত। পাড়ায় পাড়ায় গরু ছাগল কেনার হিরিক দেখে নির্মল আনন্দ পেতাম। কোন বাড়ীতে গরু আর কোন বাড়ীতে ছাগল তা দেখার জন্য মনটা উৎসুক হয়ে থাকতো। আবার গরু, ছাগলের রং কি সাদা, কালো না খয়েরি সেটাও ছিল একটা দেখার বিষয়। তাদের স্বাস্থ্য কেমন, মোটা-তাজা নাকি দুবলা-পটকা, সেটা দেখাও ছিল পাড়ার সকলের কাজ।
পাড়ার বয়স্ক লোকেরা নিজেদের অভিজ্ঞতার আলোকে বিভিন্ন বাড়ীর গরু, ছাগল নির্বাচনের উপর মতামত জাহির করতো। এমন ভাব যেন সকলেই এক একজন পশু বিশেষজ্ঞ। গাবতলির বাজারে গরু ছাগলের হাট বসতো। সেই হাট থেকে কেনা গরু বা ছাগলকে জরির মালা পড়িয়ে, শিং এ রাংতা জড়িয়ে, দড়ি ধরে টানতে টানতে মাইলের পর মাইল হাঁটিয়ে যার যার বাড়ীতে নিয়ে যাওয়া হতো।
“আপনারা, গরু না খাসী?” এটা ছিল ঈদ এর আগ দিয়ে সবচাইতে জনপ্রিয় প্রশ্ন। উত্তরটা শোনার পর পরই দ্বিতীয় প্রশ্নটি হতো, “কত দামে পেলেন”? ঠিক দামে জিতেছে না বেশী দামে হেরেছে এটা নিয়ে ক্রেতার মনে খুব একটা ভাবান্তর হতো না। উপরন্তু তারা অস্থির থাকতো কখন তাদের সদ্য কেনা প্রাণীটিকে সযত্নে, সুরক্ষায় বাড়ীতে নিয়ে যাবে আর কোরবানির আগ পর্যন্ত খাইয়ে, দাইয়ে শরীরে মাংস বর্ধন করবে।
শহুরে বাড়ীতে উঠান পাওয়া মুশকিল। তার পরেও, একতলা আর বাড়ীর গেটের মাঝখানটাতে যে এক চিলতে জায়গা থাকতো অথবা গেটের বাইরে রাস্তার উপর যেটুকু বাড়ীর সীমানা, সেই খানটাতে কোরবানির এই প্রিয় প্রাণীটিকে বেঁধে রাখা হতো। প্রতি দিন দু’বেলা করে ঘাস বা কাঁঠাল গাছের পাতা হতো যার খাদ্য। নির্বোধ প্রাণী - হয়তো বুঝতো, হয়তো বুঝতো না। কি গভীর ষড়যন্ত্র চলছে তাকে কতল করার। কসাই এর সাথে দামাদামি চলছে। জবাই এর সময়সীমা নির্ধারণ করা হচ্ছে। বাড়ীর রান্না ঘরে, মাংসের ঈদ স্পেশাল কি কি আইটেম রান্না হবে তারও পরিকল্পনা চলছে। কোন কোন আত্মীয়ের বাড়ীতে মাংস বিলি হবে তারও লিস্টি তৈরি করা হচ্ছে।
আমার বরাবরই মনে হতো, এই সব অসহায় প্রাণীগুলো কোন না কোন উপায়ে জানতে পারছে তাদের বলিদানের কথা। হয়তো আল্লাহ্ তা’লা এক অদৃশ্য দূত পাঠিয়ে প্রাণী গুলোর কাছে খবর পাঠিয়েছে, তোমাদের সময় শেষ। তাদের কানে কানে বলা হয়েছে, মনুষ্য সমাজের জন্য এই মহান আত্মত্যাগের মাধ্যমে তারা বেহেশতের মতোই কোন এক স্বর্গীয় জায়গায় স্থান পাবে। এই ধারণার পুরোটাই ছিল আমার শিশু মনের কৌতূহলী ভাবনার ফসল।
ঈদ এর ঠিক আগের
দিন রাতে কোন এক বিচিত্র কারনে আমি ঘুমোতে যাওয়ার আগে শুনতাম, সারা মহল্লার কোরবানির
পশুগুলো তারস্বরে ডাকছে আর চেঁচাচ্ছে। কারো কারো কাছ থেকে গোঙানির মত শব্দ শোনা যেত।
তারা হয়তো তাদের আসন্ন কষ্টের কথা চিন্তা করে ভয়ে, আতংকে চিৎকার করতো আর একে অপরকে
জানান দিতো। কিন্তু শেষ পর্যায়ে এসে আর কোনভাবেই এই বন্দী দশা থেকে তাদের মুক্তি লাভ
হতোনা।
ঈদ এর দিন সকাল থেকেই মনটা খারাপ হয়ে যেত। আমি কোনোভাবেই বাড়ীর নীচতলায় যেতাম না বা বারান্দা থেকে বিভিন্ন বাড়ীর কোরবানি দেয়ার দৃশ্য দেখতাম না। দিন বাড়লে নজরে পড়তো কাটা মাথা, চামড়া আর মাংসের ছড়াছড়ি। রক্ত, নাড়ীভুঁড়ি আর পচা দূর্গন্ধে রাস্তা ঘাটের খানা, খন্দ, নর্দমা গুলো ভরে যেত। তার উপর দিয়েই রিকশা, গাড়ী, সাইকেল, মোটরবাইক, মাইক্রোবাস দিব্যি চলাচল করতো। একদল গরীব, ভিক্ষুক শ্রেণীর দল গেটে গেটে বারি দিতো আর এ বাড়ি, ও বাড়ি থেকে মাংস সংগ্রহ করতো।
আস্তে আস্তে মন খারাপ ভাব দূর হতো দুপুরের পর, ওবেলায়। নতুন কাপড় জামা পরে তৈরি হতাম ঈদ
ভ্রমণের উদ্দেশ্যে। ঈদ বলে কথা। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের বাড়ি বেড়াতে যেতাম অসীম উৎসাহের সাথে। ঈদ এর মূল রান্না বান্নার আয়োজনটা শুরু হতো দ্বিতীয় দিনে, সব মাংস বিলি বণ্টনের পর। মা’র হাতে রান্না করা কাবাব, বিরিয়ানি, ভুনা মাংস, তেহারি, চাপ এর অপূর্ব স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে। সেই উত্তেজনা, সেই অপেক্ষা, সেই মৌ মৌ করা গন্ধ নেয়ার আনন্দে ভরে থাকতো ঈদ এর তিনটি দিন।
প্রিয় মাতৃভূমি ছেড়ে হাজার হাজার মাইল দূরে বসে, বহু দিন আগে ফেলে আসা শৈশব, কৈশোরের সেই ঈদ স্মৃতি খুব মনে পড়ে। আমার পরের প্রজন্মের কাছে যখন গল্প বলি, যখন সেই আনন্দময় অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করি তখন মনে হয়, ওরা কি কোন দিন বুঝবে, কোন দিন উপলব্ধি করবে সেই সময়টা।
ঈদ এর সাথে ছিল আমাদের আত্মার সম্পর্ক। ঈদ এর দিবসটি ছিল ত্যাগ আর ভালোবাসায় ঝলমলে একটি দিন। ছেলেবেলার প্রতিটি ঈদএ সারাটা দিন অকারণে মনটা খুশীতে ভরে থাকতো। ঈদ এর অনুভূতিটাকে মনে হতো আমাদের পরিচিত সব অনুভূতি থেকে আলাদা। একটু পর পর মনে পড়ত “আজকে ঈদ, আজকে ঈদ!”
দ্বিতীয় পর্ব, ওদের ছেলেবেলায় - কোরবানি
খুব সুন্দর ভাবে তুমি আমাদের পুরানো দিনে ফিরিয়ে নিয়ে গেলে।ধন্যবাদ তোমার এই সুন্দর লেখাটির জন্য।
ReplyDeleteEid was such a special day for us. We use to look forward to the festive mood, new clothes, fantastic arrays of mouth watering food, great eid special TV shows but not the animals slaughtering part, which was brulal & traumatizing.
ReplyDeleteFeeling nostalgic
Remembrance and reminiscence.
ReplyDeleteGood writing Joyeeta👌🥰