আকাশে শান্তির নীড়


ছোটবেলায় খুব শখ হয়েছিল যে বড় হয়ে আমি এয়ার হোস্টেস হবো। কি দারুণ পাট পাট করে তারা শাড়ি পড়ে, চুল উঁচিয়ে সুন্দর করে খোপা করে। সর্বদা হাসি হাসি মুখ। কি বিনয়, কি নম্র তাদের আচরণ। আর সব থেকে বড় আকর্ষণীয় ব্যাপার, কত শত দেশে বিদেশে তারা ঘুরে বেড়ায়, কত নতুন জায়গা দেখে, কত নতুন খাবার খায়।  কত নতুন মানুষের সাথে তাদের পরিচয় হয়।

পাড়ার মেয়েদের সাথে বাড়ীতে যখনই খেলতাম, আমার পছন্দের তালিকায় সব চেয়ে প্রথমে থাকতো রান্না বাড়ি খেলা, আর দ্বিতীয় প্রিয় ছিল বিমান বালা খেলা। মা'র একটা শাড়ি পড়ে আমি সাজতাম বিমান বালা আর বাকিরা হতো প্লেনের যাত্রী। চেয়ার টেবিল টেনে রুমটা প্লেনের ভেতরকার মত বানিয়ে, ট্রেতে করে খাবার, ড্রিংক সাজিয়ে পরিবেশন করতাম। মনে হতো, আমি মাটি থেকে হাজার হাজার মাইল উপরে একটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত, আধুনিক সাজে সজ্জিত উড়ন্ত ড্রয়িং রুমে দাঁড়িয়ে অতিথি আপ্যায়ন করছি। যদি কখনো বাড়ীর সামনে বাংলাদেশ বিমান এয়ারলাইন্সের এর গাড়ী দেখতাম, তখন খুব মন দিয়ে গাড়ীর ভেতর বসে থাকা এয়ারহোস্টেস গুলোকে দেখার চেষ্টা করতাম। কি সুন্দর তারা, কি চমকপ্রদ তাদের চাকরী।    

বড় হতে হতে এই শখটা চলে গিয়েছিল। কারন শখটা ছিল সাময়িক। জীবনে প্রথম যেদিন প্লেনে চড়ে ছিলাম, সেদিন আসল ভুলটা ভেঙ্গে ছিল। প্লেনের এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত হুরোহুরি, ছুটাছুটি করা, যাত্রীদের সেবায় ক্রমাগত কথা বলে যাওয়া, খাবার দাবার পরিবেশন, জিনিসপত্র আগিয়ে দেয়া - এই কাজটাতো কোনোভাবেই আনন্দের হতে পারেনা। বিমান বালাদের পর্যবেক্ষণ করে মনে হয়েছিল, কি অসীম ধৈর্য আর সহ্য নিয়ে এরা কাজ করে যাচ্ছে। যাত্রীদের দুর্ব্যবহার, কথা না শোনা, নিয়ম না মানা, বারে বারে ডেকে বিরক্ত করা - কেমন অকপটে এরা সামাল দিয়ে যায়। যতক্ষণ ফ্লাইটে আছে, এদের এক ফোঁটাও বিশ্রাম নাই। শুনেছি, অনেক লম্বা ফ্লাইটে এরা পালা করে ঘুমাতে যাওয়ার সুযোগ পায়। কিন্তু ছোট লোকাল ফ্লাইটে তা কোনোভাবে সম্ভব নয়।

কিছু দিন আগে একটা খবর পড়ছিলাম, একজন বিমান বালা তার টিকটক একাউন্টে তার এই গ্ল্যামারাস পেশার কিছু নন গ্লামারাস সত্য কথা প্রকাশ করে দারুন ভাবে জনপ্রিয় হয়েছে। মেয়েটির ফলোয়ারসদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে মিলিয়ন। একজন যাত্রী হিসেবে খবরটা পড়ে আমি দারুন অবাক আর বিস্মিত হয়েছি। উড়োজাহাজে চলমান অবস্থায় কত কিছুই আমাদের অজানা থাকে। তারই কয়েকটা শেয়ার করলাম।

- ওরা যখন প্লেনের দরজায় দাঁড়িয়ে হাসি মুখ করে আপনাকে অভ্যর্থনা করে অথবা আইল দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় আপনার দিকে তাকিয়ে হাসি দেয়, তখন আসলে ওরা যাচাই করে যে কোন ধরনের জরুরী ইভাকুএশনে আপনি কোন কাজে আসতে পারেন কিনা। যেমন, পেশাগত দক্ষতা (ডাক্তার, নার্স, ফায়ার ফাইটার, পুলিশ, মিলিটারি ইত্যাদি), অথবা আপনার সুঠাম শারীরিক গঠন যা কোন জরুরি পেশী শক্তি প্রয়োগে কাজে আসতে পারে। এই তথ্যটি, প্রশ্ন করে বা কথা ছলে যাত্রীর কাছ থেকে জেনে নেয়ার ট্রেনিং ওদের থাকে। যাত্রী হিসেবে আপনি হয়তো ভাবেন, বাহ, এই হোস্টেসটি তো খুবই মিশুকে, আমার সাথে অনেক গল্প করলো। 

- ৩৫,০০০ ফিট উচ্চে প্রায় ৩০০/৪০০ জন যাত্রীর জান, মাল সুরক্ষার জন্য কেবিন ক্র দের খুবই লম্বা এবং কঠিন ট্রেনিং এর মধ্য দিয়ে যেতে হয়। যেমন মধ্য আকাশে শিশুর জন্মদানে সাহায্য করা, সি পি আর এর মাধ্যমে হৃদযন্ত্র পুনরায় চালু করা, আগুন পানি বা ঝড়ো হাওয়ার মোকাবেলা করা, হাইজ্যাকিং সিচুএশনে প্রয়োজন হলে হাতাহাতি, মারামারি পর্যন্ত ওদের আয়ত্ত করতে হয়।

-  একসাথে ভ্রমণরত যাত্রীদেরকে দেখে ওরা যাচাই করার চেষ্টা করে কোন নারী বা শিশু পাচার হচ্ছে কিনা। এ ব্যাপারে ওদের নজরদারি ট্রেনিং থাকে।

- ওরা বেতন পায় শুধু মাত্র আকাশে ওড়ার সময়টাতে, শুধু মাত্র সেই ঘন্টা গুলোর জন্য। উড়োজাহাজ মাটিতে থাকা অবস্থায়, বোর্ডিং এর আগে ও ল্যান্ডিং এর পরে যদিও ওরা প্লেনের ভেতর থাকে এবং প্রস্তুতি নেয়, কিন্তু কোন বেতন ছাড়াই। 

- একজন ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্ট প্রায় প্রতিটি ফ্লাইটেই নতুন কিছু সহকর্মীর সাথে পরিচিত হয় এবং একসাথে কাজ করে। এর কারন র‍্যান্ডম স্কেজুলিং। কে, কবে কোন ফ্লাইটে পড়বে, তা ওরা আগের থেকে জানে না। খুবই সিনিয়ার এবং অভিজ্ঞ কর্মীরা নিজেদের পছন্দের কথা বলার অনুমতি পায়।  

ছোটবেলায়  বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি বিজ্ঞাপন দেখেছিলাম টিভিতে। আকাশে শান্তির নীড়। এই যুগে, প্লেনে করে আমেরিকার ভেতর বা আমেরিকার বাইরে অন্য কোন দেশে যাওয়ার সময় 'শান্তি' বা 'স্বস্তি' কোনটাই অনুভূত হয়না। উপরন্তু মনে হয়, কত তাড়াতাড়ি গন্তব্য স্থলে পৌঁছাবো। আর সব বিমান বালারাই হাসি হাসি মুখ করে এগিয়ে আসেনা, ভারী লাগেজ ওপরে তুলতে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়না। সব ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্টরাই বন্ধুত্ব সুলভ আচরণ করেনা।  

এর কারন, উড়োজাহাজ কর্মীরা নন, আমরা যাত্রীরাও নই। এর কারন, ৯/১১ এর পর সমগ্র দুনিয়া ব্যাপি এয়ারলাইন্স ব্যবসার ধস নামা, নিয়মনীতি পরিবর্তন, কঠোর বিধি নিষেধ আরোপ, বেতন হ্রাস, ওভার টাইম কাজ, বিনা নোটিশে হঠাত কাজের শিফট পরিবর্তন, বোনাস কাট, এরকম আরও বহুবিধও জটিল ব্যপার যার পুরোটা আমাদের জানা নেই।

শৈশবের স্বপ্নে বোনা আমার সেই অতি প্রিয় জায়গাটিতে আরোহণ বা বিচরণ করতে আর আমার ভালো লাগেনা। বলতে বাঁধা নেই,  প্লেন জার্নি আমার জন্য আর মোটেও একটি স্বপ্নিল ব্যপার নয় । করতে হয় বলে করি। এক দেশ থেকে আর এক দেশে, এক মহাদেশ থেকে আর একটিতে, আর অন্য কোন ভাবে যাওয়ার উপায়তো নেই। টিকেট কেটে যেই মাত্র বাংলাদেশে যাওয়া কনফার্ম করি, এক অজানা উত্তেজনায়, চাপা আনন্দে মন আনচান করে ওঠে। 

নীল আকাশের দিগন্ত ছাপিয়ে, একটি উড়োজাহাজই তার পেটের মধ্যে করে আমেরিকার মাটি থেকে আমাকে নিয়ে যেতে পারবে, প্রিয় স্বদেশ ভূমিতে।    

Comments

  1. Informative and interesting. Let's just hope that a child's imagination can become the reality we so desire!

    ReplyDelete
  2. Dear Blogger, you have again beautifully and carefully
    managed to present another great topic. Very honestly it was so captivating that I read it under one breath.
    Thank you for enlightening us with the challenging job they do and also reminding us of the great care we receive from these Air stewardess

    ReplyDelete
  3. Very nice. In my childhood I used to think that the life of pilot is immensely tough. At that time I used to think how the pilots are able to take rest, because they have to fly plane at anytime. Now after reading this write up I got to know that not only the pilots, but also the survival of air hostess and cabin crew is also too hard. And also they have no relaxation really. The salary issue of air hostess has shocked me very much. So did the current American airlines service matter. Now I will say you really did the best thing by omitting this ambition.

    ReplyDelete

Post a Comment