ঈদের ছুটি (২)

ফেরি পার হয়ে ওপারে যখন দৌলতদিয়া-রাজবাড়ী ঘাটে পৌঁছাতাম তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল শুরু হয়েছে। আমাদের সমস্ত প্রাণ শক্তি কিছুটা নিস্তেজ হতে শুরু করতো, সমস্ত উত্তেজনায় কিছুটা ভাঁটা পড়তে শুরু করতো। তখন খালি অপেক্ষার পালা, কখন আমাদের কোচ গিয়ে কুষ্টিয়া শহরে প্রবেশ করবে। কুষ্টিয়া সদর আসার আগে মাগুরা, ঝিনাইদাহ পার হয়ে যেতে হতো। শহরের মুখেই ছিল একটি চৌরাস্তার মোড়। রাস্তার চারধারে সারি সারি দোকান, লোকজন হট্টগোল, সিনেমা হল, রেল স্টেশন পার হয়ে তবেই বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে বাস থামত। সে কি শান্তি, সে কি আনন্দ, আমরা পৌঁছে গেছি। 

আমার নানা ছিলেন কুষ্টিয়া শহরের প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার। তিনি আগে থেকেই বাস ডিপোতে বলে রাখতেন, ঢাকা থেকে উনার মেয়ে, নাতনিরা আসছে। ব্যস, বাস থেকে নেমেই দেখতাম রিকশা রেডি। ঢাকার রিকশার সাথে ওখানকার রিকশার তফাত ছিল তাদের আকৃতিতে। ঢাকার রিকশার হুড ছিল গোল আর কুষ্টিয়ার রিকশার হুড চারকোনা। খুবই সামান্য একটা তফাত কিন্তু সেই ছোট বয়সের মনে বিশাল দোলা দিতো। আমি সব সময় ভাবতাম, কুষ্টিয়ার রিকশাগুলো একটু বড়। সেই বড় বড় রিকশায় চড়ে, জেলা স্কুলের পাশ দিয়ে যাওয়া রাস্তাটি ধরে আমরা এসে পৌঁছতাম কোর্ট পাড়ায়, একেবারে নানার বাড়ীর গেটের সামনে। বাড়ীর নাম মনোয়ার মহল। 

চারিদিকে বিশাল প্রাচীর ঘেরা মনোয়ার মহলের লোহার গেটে এসে কলিং বেল দেয়া মাত্রই, সারা বাড়ি অতিথি আমন্ত্রণে ভেঙ্গে পড়ত। ঢাকা থেকে ইতিমধ্যে আগত খালামামারা, খালাত মামাত ভাই বোনেরা উৎসুক হয়ে "এবার কারা এলো" দেখার জন্য বারান্দায় এসে ভিড় করতো। নানা আর নানি তাদের ভালোবাসা আর মমতার উষ্ণতায় সাদরে গ্রহন করতেন নতুন অতিথি, আমাদেরকে। হৈ চৈ, হাসি ঠাট্টা, গল্প গুজব, দৌড়াদৌড়ী, ছুটাছুটি, লাফালাফি এরকম বহুমাত্রিক কলরব ধ্বনি আর কলকাকলিতে তাৎক্ষণিক ভরে উঠত আমাদের নানার বাড়ি। আলোর মতোই চারিদিকে বিচ্ছুরিত হতো আসন্ন ঈদ এর উল্লাস।

যেদিন পৌঁছাতাম সেদিন রাতের সবথেকে উত্তেজনাকর বিষয়টি হতো, কে কোথায় শুবে বা ঘুমাবে। একদিকে ওপরে বিছানায় গাদাগাদি, অন্যদিকে মাটিতে ঢালাউ বিছানা, একসাথে ভাগাভাগি করে শোয়ার সে কি আনন্দ। মা, খালা, মামীরা ওপরে শুতেন আর কাছাকাছি বয়সের কাজিনরা শুয়ে পরতাম মাটির বিছানায়। আমি যতই ভাবতাম সারা রাত গল্প করে কাটাবো, সারা দিনের যাত্রার ক্লান্তিতে একরাশ ঘুম কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসতো চোখের পাতায়।

নানা বাড়ীর উঠোনটা ছিল আমার সব থেকে প্রিয়। এল শেইপ উঠোনের চারিধার দিয়ে লাগোয়া শোবার ঘর, খাবার ঘর আর রান্না ঘর। উঠোনের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে হরেক রকমের গাছ গাছালি। নারকেলি বরই, ডালিম, কূলবরই, লাল পেয়ারা, সুপারি, আতা। উঠোন জুড়ে অবাধ বিচরণ করতো কুকুর, বিড়াল, হাঁস, মুরগী, রাজহাঁস এর দল। তারা খুঁটে খুঁটে খাবার খেত আর বাড়ীর মানুষগুলোর আনন্দ মুখরিত পরিবেশে সামিল হতো। আরও সামিল হতো একঝাঁক পায়রা। আমার মামার পোষা পায়রাগুলো সারাদিন মুক্ত বিহঙ্গে, খোলা আকাশে উড়ে বেড়াত আর দিনের শেষে, নীড়ের টানে উঠোনের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট্ট খোপগুলিতে ফেরত আসতো।  

উঠোনের শেষ প্রান্তে বাথরুমের দেয়াল বেয়ে উঠেছিল একটি লতানো আঙ্গুর গাছ। ঝুমকো ঝুমকো আঙ্গুর ফলে তা ভরে থাকতো। আর ছিল কুয়োর পারে খুব লম্বা একটি নারকেল গাছ। নারকেল গাছের চিরল পাতা গুলির ছায়া পড়ত কুয়োর পানিতে। বাড়ীর পিছে ছিল বিশাল এক আমবাগান। সেই বাগানে আম গাছ তো ছিলই, আরও ছিল জাম, লিচু, কলা, কাঁঠাল, সবেদা, খেজুর, জামরুল। এই বাগানে কত খেলেছি, কত ফুর্তি করেছি। আমাদের কাজিনদের ক্ষুদে গোয়েন্দা বাহিনী কত রহস্যেরই না সমাধান করেছে বাড়ীর পিছে আমবাগানে।

বাড়ীর যে অংশে শোবার ঘর ছিল সে অংশ ছিল দুইতলা। উপর তলায়ও ছিল আরও দুটি শোবার ঘর। ঈদ গ্রুপের ছেলে সদস্যরা উপরতলায় ঘুমাত। উপরের তলায় উঠলেই সোজা চলে যেতাম বাড়ীর সামনের অংশের বিশাল এক টানা বারান্দায়। যেখানে দাঁড়িয়ে রাস্তার বহু দূর পর্যন্ত দেখা যেত। বাড়ীর সামনে অর্জুনদাস আগারওয়ালা সড়ক দিয়ে কোন রিকশা আসছে - যাচ্ছে, কোন পথচারী হেঁটে যাচ্ছে, কোন মোটরবাইক হর্ন দিচ্ছে, কোন ঠেলাওয়ালা সউদা বিক্রি করছে, সব কিছু। আমরা বাচ্চারা কান পেতে থাকতাম কখন শোনা যাবে কুলফিওয়ালার হাঁক। 

কুষ্টিয়ার কুলফি দেশ জুড়ে প্রসিদ্ধ। প্রচলিত আছে, কুষ্টিয়ার কুলফি যে একবার খায়নি, তার সারা জীবনে  আফসোস থেকে যাবে। গরুর খাঁটি দুধে চিনি, এলাচি, বাদাম, কিসমিস ও গরম মসলা মিশিয়ে তৈরি করা হয় কুলফি মালাই। কুমারখালি ও শিলাইদাহ গ্রামের মানুষেরা কুলফি বানিয়ে মাটির হাঁড়িতে করে নিয়ে দূর দূরান্ত বিভিন্ন এলাকায় যায় বিক্রি করতে। আমাদের কোন এক মামা 'কে খাবে কুলফি?' জিজ্ঞেস করতেই, সারা বাড়িতে হৈ চৈ শুরু হয়ে যেত, আমি চাই, আমি চাই বলে। বাড়ীর সবচেয়ে বড় থেকে শুরু করে সব চেয়ে ছোট সদস্য পর্যন্ত সবাই পেতো, কলাপাতায় মোড়া কুলফি মালাইএর অপূর্ব স্বাদ। যে একবার খেত সে আর কোনোদিন ভুলতো না। কুলফিওয়ালা তার মাটির হাঁড়ি পুরো খালি করে, সমস্ত কুলফি বিক্রি হয়ে যাওয়ার এক অসীম আনন্দমাখা হাসিমুখ নিয়ে নানার বাড়ি থেকে বিদেয় নিত। কুলফির দামের সাথে সে পেতো ঈদ এর বকশিস। কুষ্টিয়ার আরও একটি অনন্য খাবার, কমলা ভোগ মিষ্টি। রাজবাড়ী জেলার ঐতিহ্যবাহী চমচম মিষ্টির কারিগরদের হাতে বানানো, কমলার স্বাদযুক্ত রসগোল্লার নাম কমলা ভোগ। হালকা মিষ্টি, কমলার সুঘ্রাণে ভরা এই মজাদার মিষ্টান্ন, আমাদের কুষ্টিয়া ভ্রমণের আরও একটি আকর্ষণ ছিল।

আকাশের কোন এক প্রান্তে যেই দেখা যেত এক ফালি চাঁদ তেমনি ঘোষণা হতো, পরদিন ঈদ। সে কি আনন্দ আমাদের। আমরা বাড়ীর মেয়েরা দল বেঁধে উঠোনে নেমে মেহদি গাছের কাছে চলে যেতাম আর ডালা ভরে মেহদি তুলে আনতাম। কচি সবুজ মেহদি পাতা, পাটার ওপর শুরু হতো বাটা। কেউ একজন নানির পানের বাক্স থেকে খয়ের নিয়ে আসতো যেটা কিনা বাটা মেহদিতে যোগ করে আবার বাটা হতো, মেহেদির রং আরও উজ্জ্বল করার জন্য। আমরা লাইন দিয়ে উত্তেজনায় অপেক্ষা করতাম। পরিবারের যারা গুনি আঁকিয়ে বা মেহদিশিল্পী, তারা অসীম ধৈর্য ও সহ্যের সাথে, মনের মাধুরী মিশিয়ে একের পর এক বিভিন্ন নকশা দিয়ে সাজাতো আমাদের হস্তপট।

শুরু হতো ঈদ এর রান্নাবান্নার অঢেল আয়োজন। এই রান্নার রেশ চলত পরের দিন পর্যন্ত। আমার নানি ছিলেন অসম্ভব পাকা একজন রাঁধুনি। এমন হাতযশ শুধু  ঐ যুগের নানি, দাদিদের মধ্যেই দেখা যেত। উনার হাতের রান্নার সেই স্বাদ, গন্ধ, বর্ণ আর আমেজ আর কোথাও পেয়েছি কিনা জানিনা। নানির রান্নাঘরে মূল আয়োজন চলতো মাটির উনুনে। খড়ি বা লাকড়ি ছিল যার জ্বালানি। পেছনের আমবাগান থেকে কাঠ, বাঁশ, খড়কুটো, শুকনো পাতা নিয়ে এসে মাটির চুলায় দম দেয়া হতো। কি অভিনব রান্নার পদ্ধতি। কাঠের আগুনে রান্না হতো পোলাউ, কোর্মা, রেজালা, রোস্ট, কাবাব, সেমাই, ফিরনি, হালুয়া আরো কত কি। ধোঁয়ার গন্ধ ভরা খাবারগুলো হতো দারুন সুস্বাদু। কতটুকু তেলমসলা, কতটুকু জ্বালানি, কি পরিমাণ আগুনের তাপ, কতটা সময় ধরে রান্না এইসব ব্যাপার গুলোর নিখুঁত, যথাযথ, ত্রুটিহীন সমন্বয় ঘটিয়ে, নানির রান্নাঘর থেকে তৈরি হতো এক একটি অনবদ্য সৃষ্টি, ঈদ স্পেশাল আইটেম।

এতদিন ধরে বহু কষ্টে, সযতনে, গোপনে যা লুকিয়ে রেখেছিলাম সেই ঈদ এর নতুন কাপড়ের উদ্বোধন হতো, ঈদ এর দিনটিতে। কার কয়টা নতুন জামা, কি কি রং এর, কে কয়বার জামা পাল্টালো, এই সব রহস্যের চলত বিরাট আবিষ্কার। আর চলত ঈদি পাওয়ার প্রতিযোগিতা। কে কয়বার ঈদি পেল, কার কত টাকা হল - কত হিসেব, কত নিকেশ। ঈদ এর দিনটি ছিল সবচাইতে মধুর, সবচাইতে স্মরণীয়। আমাদের নানা-নানি তাঁদের ছেলেমেয়ে, নাতিনাতনিদের সঙ্গে নিয়ে সন্তুষ্টি আর আনন্দে ভরা একটি চমৎকার ঈদ এর দিন উদযাপন করতেন। আমাদের স্মৃতির মণিকোঠায় যা জ্বল জ্বল করে জ্বলবে। নানা-নানি আমাদের ছেড়ে বহুদিন হল চলে গেছেন অন্য ভুবনে। ওখানে ঈদ পালন হয় কিনা জানিনা। আমরা বড় হয়ে যে যার জীবনে বহু দূর চলে এসেছি, বহু সময় পার করেছি। ছোটবেলার ঈদ আনন্দ আর শত চেষ্টা করলেও পাবোনা।

ঈদ এর ছুটির শেষে আমরা ঢাকায় ফেরত আসার প্রস্তুতি নিতাম। পরম মমতায় নানি আমাদের সঙ্গে করে দিয়ে দিতেন তাঁর হাতে বানানো নাড়ু, মোয়া, পিঠা, মোরব্বা, আচার, বড়ি। নানা ও নানি অশ্রুসিক্ত নয়নে আমাদের বিদেয় দিতেন। আর দিতেন তাঁদের আশীর্বাদ ও দোয়া। এক কাক ডাকা ভোরে আমাদের ফিরতি পথের বাস রউনা হতো, কুষ্টিয়া থকে ঢাকার উদ্দেশ্যে।       

Comments

  1. Loved reading every bit of your story, as it a reflection of our past, which was so pure, precious and also brought so much joy. The description and the narration of the eventful journey is so heart warming, which helped me to visualise the precious moments in the past and the absence of some very loving people who have also left us.

    ReplyDelete
  2. A very picturesque narration of treasured memories. This took me down memory lane.

    ReplyDelete
  3. "Sometimes we will never know the value of a moment until it becomes memories" Dr. Seuss

    ReplyDelete

Post a Comment