ঈদের ছুটি (১)

অপেক্ষা করতাম কবে স্কুল বন্ধ হবে, ঈদের ছুটি শুরু হবে। সে কি উত্তেজনা! ঢাকা ছেড়ে কবে আমরা কুষ্টিয়ায় নানা বাড়ীতে ঈদ করতে যাবো। প্রতি বছরেই ঈদ করতে আমরা নানা বাড়ীতে যেতাম না। তবে যেই যেই বছরে যেতাম সেই সময়টা একেবারে স্মরণীয় হয়ে থাকতো। মা যখন ঘোষণা দিতেন যে এইবার ঈদএ আমরা কুষ্টিয়া যাবো, আমরা তিন বোন খুশীতে আটখানা হয়ে যেতাম। কি নেবো আর কি নেবোনা, এই পরিকল্পনা করার  আনন্দ যে কি অসাধারণ ছিল তা বলে বোঝানো যেত না। ছোটবেলায় ঈদ এর ছুটির ব্যাগ গোছানোর সেই নির্মল আনন্দের স্বাদ আর কখনো পাইনি। 

সেই সময় দুই ভাবে টিকেট করা যেত। বাসে অথবা ট্রেনে। বাসে হলে আবার দুই ধরনের অপশন ছিল। কোচ বা বাস। কোচ এক টানে বাস টার্মিনাল থেকে ফেরী ঘাটে গিয়ে পৌঁছত। আর সাধারণ বাস হলে, টার্মিনাল থেকে প্রতি স্টপে থেমে লোক তুলতে তুলতে যেত। আমরা বরাবরই কোচে যেতাম। মা আমার জন্য কমলা লেবুর খোসা সঙ্গে করে নিয়ে যেত যেন পেট্রোলের গন্ধে আমার বমি ভাব শুরু হলে শুঁকতে পারি। আমি হাতের মুঠির মধ্যে শক্ত করে খোসা গুলো ধরে বসে থাকতাম আর জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতাম। ব্যস্ত শহরের ইট, কাঠ, কোলাহল, কালো ধোঁয়া আর যান্ত্রিকতার হাত থেকে মুক্তি পেয়ে আমরা এক সীমাহীন আনন্দ স্থানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করতাম।  

প্রচণ্ড এক নয়নাভিরাম দৃশ্যপটের মধ্য দিয়ে দূর্বার গতিতে ভেঁপু বাজাতে বাজাতে আমাদের কোচ ছুটে চলত ঢাকা-আরিচা সড়ক ধরে। উজ্জ্বল হলুদ সরিষা ক্ষেত, ক্ষেতের পেছনে সবুজ শ্যামল বন বনানী, দুই ধারে ক্ষেতের মাঝ দিয়ে সরু পায়ে চলা হাঁটা পথ, স্বচ্ছ ঝিলের পানিতে শাপলা ফুলের সমারোহ কি যে অপুর্ব লাগতো। রাস্তার দুই ধার দিয়ে ছোট ছোট মাটির বাড়ী, বাড়ীর চালে লেপা সারি সারি গোবর, উঠোন ভর্তি স্তূপ করা খড়ের গাদা, বাড়ীর পাশে বাঁশের ঝাড়, কলা গাছে ঝোলা কলার কাঁদি, গরুর গাড়ীতে বসা মানুষগুলোর অসহায় চাহনি, আমরা বাস এর যাত্রীরা অবাক হয়ে দেখতে দেখতে যেতাম। সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল ঐ সময়টা যখন আমরা কোন ছোট জায়গার কাঁচা বাজারের ভিতর দিয়ে যেতাম। 

বাজারের দোকানগুলো এক রাশ পশরার সম্ভার নিয়ে বসতো। থরে থরে সাজানো বিভিন্ন রং এর শাকসবজী, ফলমূল এর কি এক অদ্ভুত বিচিত্রতা প্রকাশ পেতো। মাছের দোকানের সামনে কাদা পানি দিয়ে প্যাঁচ প্যাঁচ করতো। তবুও সেই কাদা পানির উপর দিয়েই মাছওয়ালারা তাদের চিকচিকে, রূপালী ছোট বড় সাইজের মাছের সম্ভার দেখিয়ে লোক জড় করতো। বাসের জানালা দিয়ে তাকিয়ে আমার মনে হতো, আমি যেন কল্পনায় সব শুনতে পাচ্ছি বাজারের লোক গুলো কি বলছে, কিভাবে দামাদামি, দর কষাকষি করছে। মাঝে মাঝে বাজারে আসা কোন কৌতূহলী ক্রেতা রাস্তা থেকে ঘুরে চলন্ত বাসের দিকে তাকাত। 

কি যে খুশী লাগতো যখন দেখতাম বাজারের ঠিক সামনেই ছোট একটি সিনেমা হল। সিনেমা হলের প্রবেশ দরোজার উপরে বিশাল এক রঙিন ব্যানারে ঐ সময়ের জনপ্রিয় রাজ্জাক-ববিতার ছবি, অথবা ফারুক-কবরী । বাসের গতি সাধারণত একটু মিইয়ে আসতো বাজারের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময়। আমি খুব চেষ্টা করতাম এই অল্প সময়ে যেন সিনেমার নামটা পড়তে পারি। অমর প্রেম বা সারেং বউ বা ডুমুরের ফুল। বাজার পার হয়ে যেই আমরা ফাঁকা রাস্তায় উঠতাম, ওমনি আবার শুরু হতো আমাদের বাস আর অন্য বাসের পাল্লাপাল্লি প্রতিযোগিতা, কে কাকে ওভারটেক করবে। দুই প্রতিযোগী বাসের ড্রাইভার আর কন্ডাক্টার ছিল একে অপরের চেনা বন্ধু। তাই এই প্রতিযোগিতা তারা করতো জোশের সাথে, উত্তেজনার সাথে। আর আমরা দুই বাসের অসহায় যাত্রীরা, আমাদের অমূল্য প্রাণ হাতে নিয়ে আল্লাহবিল্লাহ করতে করতে আরিচা ঘাটে পৌঁছানোর দোয়া করতাম।     

নানা কিছু দেখতে দেখতে আর বাসের দোলুনিতে কখন জানি একটু ঝিম লেগে আসতো। হঠাত এক জোর ঝাঁকুনিতে চোখ দুটো খুলতাম আর দেখতাম আমরা আরিচা ঘাটে পৌঁছে গেছি। ফেরিতে ওঠার সে কি এক বিশাল লম্বা লাইন। বড় বড় বাস আর মালামাল বহনকারী ট্রাক গুলো দাঁড়াত এক লাইনে। আর ছোট প্রাইভেট গাড়ী গুলোর লাইন ছিল পাশ দিয়ে ছোট পরিসরে। কোন সিরিয়ালে কে আগে যাবে আর ফেরিতে উঠবে, এইটা কারো বোঝার সাধ্যি ছিল না। সেদিন প্রত্যেকের ভাগ্যে কতটা অপেক্ষা লেখা আছে, তাই ছিল দেখার বিষয়। 

ঢাকা থেকে বাসে যতোবার কুষ্টিয়া গিয়েছি ততোবারই ভাগ্যের এক মজার খেলা দেখেছি। কখনো পনের বিশ মিনিট অপেক্ষার পরই আমাদের বাস সোজা ফেরিতে ওঠার অনুমতি পেতো। কখনো এমন হয়েছে, একটু করে আগাতে আগাতে আমাদের বাসটা যেই ফেরিতে ওঠার র‍্যাম্প পর্যন্ত পৌঁছেছে, তেমনি ঘোষণা - ফেরি ফুল, আর কোন বড় জায়গা খালি নেই। আমরা করুণ দৃষ্টিতে দেখতাম, পাশ দিয়ে ছোট একটা গাড়ী বীরদর্পে হর্ন বাজিয়ে ফেরিতে উঠে যেত আর সঙ্গে সঙ্গে পাটাতনটা ওপরের দিকে উঠতে শুরু করতো। ব্যস, এই ফেরির সাথে আমাদের সব সম্পর্ক শেষ। আমাদের না নিয়েই সে রউনা হয়ে যাবে। আমরা বাসের যাত্রীরা প্রচণ্ড মন খারাপ করে অপেক্ষা করতাম, কুষ্টিয়া থেকে ঢাকা ফিরতি পথের পরের ফেরিটার জন্য।

ফেরির নামটা সাধারণত হতো কোন স্বনামধন্য ব্যক্তির নামে যেমন, খান জাহান আলী, আমানত শাহ, বেগম রোকেয়া। ফেরিতে উঠে আমাদের বাসটা কোথায় গিয়ে অবস্থান নিবে সেটাও ছিল এক কৌতূহলের বিষয়। যদি ছাদের নীচে না হয়ে, রেলিং এর পাশে খোলা জায়গাটাতে জায়গা পেতো তাহলে বুঝতাম আমাদের ভাগ্যটা সেদিন খুবই ভালো। পদ্মা নদীর উত্তাল ঢেউ, ঝিরিঝিরি ঠাণ্ডা বাতাস, নীল আকাশের অবাধ বিশালতা, ভেসে চলা পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ, নদীমাতৃক বাংলাদেশের অপার সৌন্দর্য আমরা বাসে বসেই জানালা দিয়ে উপভোগ করতে পারতাম। দেখতাম একটু দূরে, ছোট কোন স্টিমার বা মাছ ধরার ট্রলার পারের ধার ঘেঁসে চলেছে, যেখানে পানির গভীরতা অসীম নয়।  

বিকট শব্দ করে সাইরেন বাজিয়ে যেই আমাদের ফেরি চলতে শুরু করতো, ওমনি কোথা থেকে এক গাদা বিক্রেতারা বাসে উঠে পড়ত। ডিমওয়ালা, কলাওয়ালা, ঝাল মুড়িওয়ালা, আমড়াওয়ালা, বিচিত্রা-ম্যাগাজিনওয়ালা, তেলেসমাতি ওষুধওয়ালা, এমন কত রকমের হকারসদের আনাগোনা শুরু হতো নিমেষেই।

আমরা মেয়েরা সাধারনত বাস থেকে ফেরিতে নেমে ঘুরাঘুরি করতাম না। তবে আমাদের সাথে কোন মামা যেবার কুষ্টিয়া যেত, সেবার আমরা ফেরির দোতালায় ক্যান্টিনে বসে দুপুরের খাবার খেতাম। দোতালায় ওঠার সিঁড়ি থাকতো একেবারে ধারে, রেলিং এর পাশ দিয়ে। আমার খুব ভয় লাগতো উঠতে। যদি হাত ফসকে, পা পিছলে পানির মধ্যে পরে যাই। অনেক কষ্টে ভয় কাটিয়ে উপরে উঠলেই টের পেতাম চারিদিকে রান্নার সুঘ্রাণ মৌ মৌ করছে। দুই ধরনের চয়েস থাকতো। ভাত-ডাল-মাছ-সব্জি। অথবা ভাত-ডাল-মুরগি-সব্জি। সহজ সাধারণ রান্না কিন্তু  কি যে সুস্বাদু, একেবারে ভোলার নয়। অল্প কিছুক্ষণ আগেই পানি থেকে ডাঙ্গায় তোলা টাটকা মাছ কেটে, পরম যত্নে, সামান্য পেঁয়াজ, মসলায় ভুনা করা। অথবা হাড় জিরজিরে মুরগির মাংস ছোট আলু দিয়ে তেলে, ঝোলে মিলেমিশে অসাধারণ পরিবেশন। আহা কি যে স্বাদ, কি যে তৃপ্তি, মুখে লেগে থাকতো।

চলবে.......           

Comments

  1. Thank you for helping us go down the memory lane reminiscing the best time of our lives. Each and every journey was an unforgettable experience. Been to so many places, but those journeys still remain to be the most heartwarming happenings till date. No wonder people of this country would do anything to go back to their roots, take all the risks, hardships and what not. After all, family bonding and our roots are the most important things in our lives.

    ReplyDelete
  2. Going for holidays to Nani Bari cannot be compared with the holidays that we have now a days, as it was so enchanting, exciting and the most glorious time in our lives. Thanks for helping us to go back and revisit those precious memories that has been carefully tucked away. Eagerly awaiting your next part

    ReplyDelete
  3. সুন্দর, অনবদ্য লেখা। ছোটবেলার অমৃতময় স্মৃতিগুলোকে মনে করিয়ে দেয়।

    ReplyDelete
  4. Loved it! Simple but profound expression so similar to my childhood

    ReplyDelete

Post a Comment