ভিনদেশী বন্ধু


১৯৮২ সালে মুক্তি প্রাপ্ত, স্টিভেন স্পিলবার্গ পরিচালিত, বিজ্ঞান কল্পকাহিনী ভিত্তিক চলচ্চিত্র ইটি র (E.T.) কথা মনে আছে? আমার কিশোরী বেলায় দেখা স্মরণীয় ছবি গুলির মধ্যে একটি অন্যতম সেরা ছবি, যাতে একটি ভিন গ্রহের প্রাণী ই.টি. এবং একটি কিশোর ছেলেকে নিয়ে তৈরি হয়েছিল এক দারুন রোমাঞ্চকর গল্প। খুব সম্ভবত এই ছবিটি ব্লকবাস্টার হিট হওয়ার পর সারা দুনিয়া  Extra Terrestrial বা এলিয়েনদের নিয়ে আরো জোরে সোরে জল্পনা, কল্পনা শুরু করেছিলো। মানুষ তার অতুলনীয় চিন্তাশক্তি ব্যবহার করে অন্য গ্রহের বাসিন্দাদের বহু রকম চেহারা বা রূপ কল্পনা করেছে। হয়তো কোন অতিকায় বীভৎস জন্তু, বা কোন আলোর তৈরি দীর্ঘ, কৃশকায় প্রাণী, বা কোন সবুজ রঙের শুঁড়য়ালা ছোট ছোট কীট, অথবা আমাদের মতই দেখতে মানুষরূপী প্রাণী, কিন্তু আমাদের চাইতেও উন্নত বুদ্ধিসম্পন্ন আর ক্ষমতাধারী। আর তারা কখনই মানুষের ভাষায় কথা বলেনা।

সুপ্রাচীন কাল থেকে 'মহাশূন্য' মানুষের কৌতূহলের একটি বিষয় হয়ে আসছে। প্রাচীন গ্রীক, রোমান, মিশরীয়, বেবিলনীয়, ভারতীয়, চীনা, মায়া ইত্যাদি সভ্যতার মানুষেরা বিভিন্ন ভাবে মহাশূন্য বা মহাকাশের ব্যখ্যা দিয়েছে। তবে সকল বিবরণেই কিছু অজানা, অচেনা, রহস্যময় বিষয় ছিল যার কোন সঠিক ব্যখ্যা ছিলনা বা আমরা পুরোটা জানিনা। তাই প্রাচীন কাল থেকে জ্যোতির্বিজ্ঞান, মহাকাশ বিজ্ঞান এগুলোরই গবেষণা করে আসছে।  

শুধু কল্পনা করেই মানুষ থেমে থাকেনি। ভিন গ্রহের বাসিন্দাদের সাথে যোগাযোগেরও চেষ্টা চালিয়েছে। ১৯৭৪ সালের ১৬ই নভেম্বর পোর্টো রিকোর আরেসিবো টেলিস্কোপ থেকে একটি শক্তিশালী রেডিও মেসেজ মহাশূন্যে প্রেরণ করা হয়। এই মেসেজটি পুরোটাই সাংকেতিক ভাষায় বা বাইনারি সংখ্যায় তৈরি। যেটা বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যাবে, মনুষ্য কূলের ডিএনএর রাসায়নিক তথ্য, মানুষের শরীরের অবয়ব, সৌরজগতের গ্রহগুলির মধ্যে পৃথিবীর অবস্থান অর্থাৎ মানব জাতির বাসস্থান। সোজা কথায়, পৃথিবীর মানুষদের একটি সংক্ষিপ্ত পরিচিতি। এই মেসেজটি এখন পর্যন্ত পৃথিবী থেকে ৪৬ আলোক বর্ষ দূরে পৌঁছেছে এবং এর যাত্রা পথের লক্ষ্য ২৪ হাজার আলোক বর্ষ দূরের তারাপুঞ্জ। 

মানুষের তৈরি দুটি কৃত্রিম উপগ্রহ বা প্রোব যার নাম ভয়েজার ১ ও ২, সে দুটি মহাশূন্যে প্রেরণ করা হয়েছিল ১৯৭৭ সালে। চমৎকার বিষয় হল, এই দুটি তাদের পেটের মধ্যে বহন করে চলেছে দুটি গোল্ডেন রেকর্ড বা ডিস্ক। এই ডিস্ক দুটির মধ্যে আছে আমাদের মানব সভ্যতার ইতিহাস, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, জীব বৈচিত্র্য এবং শিল্পকলার পর্যায়ক্রমিক বিবর্তনের বিভিন্ন ছবি এবং শব্দ। আরও মজার ব্যপার হল, এতে ইংরেজি ভাষায় একটি বাচ্চার কণ্ঠে একটি শুভেচ্ছা মেসেজও রেকর্ড করা আছে। এই আশায় যে কোন না কোন একদিন, কোন এক উন্নত প্রজাতির ও বুদ্ধিমত্তার সভ্যতা আমাদের এই ডিস্কটির সন্ধান পাবে এবং মহাকাশে হাজার হাজার মাইল আলোক বর্ষ দূর থেকে পারি দিয়ে এসে আমাদের পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করবে।

আমেরিকায় প্রতি বছর কিছু চমকপ্রদ খবর প্রকাশিত হয় যে দেশের কোন না কোন প্রান্তে কিছু রহস্যময় উড়ন্ত জিনিস আকাশে দেখা গিয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এয়ারফোর্স বা নেভি পাইলট অফিসাররা তাদের ট্রেনিং বা কর্মরত অবস্থায় আকাশে এগুলোর দেখা পায়। বেশীর ভাগ সময় ঘটনা গুলোর কোন সত্যতা যাচাই হয় না তবে এগুলো নিয়ে মিডিয়াতে বেশ তোড়জোড় আলাপ আলোচনা হয়। গোলাকৃতি, ত্রিভুজাকার, ডিম্বাকৃতি বা ডিস্ক আকারের উড়ন্ত চাকতি পৃথিবীর নভোমণ্ডলে হয়তো উড়ে বেড়ায় এবং খবর সংগ্রহ করে। কে জানে হয়তো কোন দূর গ্রহের বাসিন্দারা আমাদের উপর সর্বদাই নজর রাখছে এবং সুযোগ পেলেই তাদের প্রতিনিধি পাঠিয়ে আমাদের ছবি ও তথ্য সংগ্রহ করে নিয়ে যাচ্ছে।      

মহাজগতে কি আমরাই একমাত্র প্রাণী? এই প্রশ্নটি যুগে যুগে বার বার মহাকাশ বিজ্ঞানীদের মুখে ঘুরে ফিরেছে। পৃথিবীর বাইরে বুদ্ধিমত্তা অনুসন্ধানের বিষয়টি, বিজ্ঞানের ঠিক প্রথাগত গবেষণার বিষয় গুলোর মধ্যে পড়ে না। তবুও মহাবিশ্বে বুদ্ধিমান প্রাণের খোঁজের ব্যপারটি চিরকালই গুরুত্ব পেয়েছে। বিজ্ঞানীদের হিসাব মতে, পৃথিবী ছাড়াও আমাদের ছায়াপথের আরও ৩৬টি গ্রহে অন্য কোন প্রাণের অস্তিত্ব সম্ভব। তবে তার প্রমান পাওয়া খুবই সময় সাপেক্ষ। বছর দু'এক আগে মহাকাশের একটি গ্রহ কে-টু-১৮বি তে পানির সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। আমাদের পৃথিবীর প্রায় দ্বিগুণ আকৃতির একটি গ্রহ যা কিনা পৃথিবী থেকে ১১১ আলোক বর্ষ বা ৬৫০ মিলিয়ন মিলিয়ন মাইল দূরে অবস্থিত। সেই গ্রহের তাপমাত্রা এমন স্তরের যা কিনা বিজ্ঞানীদের ভাষায় বসবাসের যোগ্য।

ইদানীং কালের সবচাইতে জনপ্রিয় খবর পৃথিবীর নিকটতম গ্রহ 'মঙ্গলে' বা লাল গ্রহটিতে নাসার বিজ্ঞানীদের প্রোব পাঠানো এবং সফল ভাবে অবতরণ করা। এই প্রোবটি অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে গ্রহটির বিভিন্ন অংশের ছবি তুলে বিশ্লেষণের জন্য পৃথিবীতে পাঠাবে এবং পাশাপাশি এও খোঁজ করতে থাকবে, ওখানে কোন প্রাণের অস্তিত্ব পাওয়া যায় কিনা। সোজা ভাষায়, মানুষের সংজ্ঞা অনুযায়ী প্রাণ বা প্রাণীর বেঁচে থাকার জন্য যা যা প্রয়োজন তার কোন কিছু গ্রহটির পরিবেশে আছে কিনা। তবে এমনতো কোন কথা নেই, আমরা মানুষেরা জীবন ধারণের জন্য অক্সিজেন সেবন করি বলে, অন্য গ্রহের এলিয়েনরাও বেঁচে থাকার জন্য বায়ুমণ্ডল থেকে অক্সিজেনই গ্রহন করবে।   

মহাকাশ কারো একার সম্পত্তি নয়। ১৯৬৭ সালের অক্টোবার মাসে 'আন্তর্জাতিক মহাকাশ আইন' প্রতিষ্ঠিত হয়। এই আইন অনুযায়ী, মহাকাশের উপর কোন একটি রাষ্ট্রের ক্ষমতা বা সার্বভৌমত্ত আরোপ করা যাবেনা। তবে সকল রাষ্ট্র মুক্ত ভাবে মহাকাশ অনুসন্ধান সম্পাদন করতে পারবে। আর তাইতো বিশ্বের বড়, বড় দেশ গুলোর মধ্যে এখানেও শুরু হয়েছে প্রতিযোগিতা। আমেরিকা ও রাশিয়ার পাশাপাশি এই দৌড়ে সামিল হয়েছে ভারত ও চীন। ক্ষমতা আর কর্তৃত্ব প্রকাশের এইতো চরম সুযোগ। আমাদের গ্রহ ছাড়িয়ে এখন মহাবিশ্বের পরিসীমায় চলছে মহাজাগতিক লড়াই। পৃথিবীর কক্ষপথে প্রদক্ষিণ, চাঁদের মাটিতে মানুষের অবতরণ, মঙ্গল গ্রহ অভিযান, সৌরজগতের আরও দূরবর্তী গ্রহগুলির অজানা তথ্য আবিষ্কার, এমন বহু সংখ্যক কার্যক্রমে বড়, বড় দেশগুলি অংশ নিচ্ছে এবং অর্থায়নের সীমা ক্রমাগত বৃদ্ধি করছে।

যোজন যোজন মাইল দূরে, কোন গ্রহ গ্রহান্তরে, আরও একটি প্রাণী জগত কি আছে? হুবহু আমাদের পৃথিবীর মতোই দেখতে। হয়তো একদিন তা আবিষ্কার হবে। দূরে কোথাও হয়তো কোন প্রাণীকূল আমাদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করছে, কোন অত্যাধুনিক উপায়ে মেসেজ পাঠাচ্ছে যা কিনা হাজার হাজার মাইল আলোকবর্ষ পার করে এখনো পৃথিবীতে এসে পৌঁছোয়নি। কে জানে, হয়তো আবিষ্কারের আগে আমরা নিজেরাই কারো দ্বারা আবিষ্কৃত হবো। সে দিন হয়তো আর বেশী দূরে নয়।  

দূরে কোথাও, এই ভুবনে অথবা অন্য পৃথিবীতে, কেও কি কখনো জানছে আমাদের কথাগুলো, পড়ছে আমাদের গল্প? 

Comments

  1. Quite informative and thought provoking

    ReplyDelete
  2. Informative and intriguing! The questions you asked are my questions too.

    ReplyDelete

Post a Comment