গল্পকথা


ঐ গল্পটা আবার বল, আমি বড় বড় চোখ করে বলতাম।
মা বলতেন, কোন গল্পটা? 
ঐ যে বেগুন গাছ, দুষ্টু বেড়াল আর টুনটুনির গল্পটা। 
মা বলতেন,  ওটা তো সেদিনই বললাম। এই নিয়েতো অনেকবার শুনেছ গল্পটা। ওইটাই বলব?
আমি মহা উৎসাহে বলতাম, হ্যাঁ, ওইটাই।

সারা দিনের কাজের শেষে, অঢেল ক্লান্তি আর অবসাদের চাদর সরিয়ে মা শুরু করতেন গল্পটা। বেগুন গাছ, দুষ্টু বেড়াল আর টুনটুনির গল্প। মা'র কোলে ঘুমিয়ে পড়ার ঠিক আগ মুহূর্ত পর্যন্ত, আমার সমস্ত ইচ্ছা শক্তি দিয়ে প্রাণপণে খোলা রাখতাম চোখ দুটোকে। সীমাহীন আগ্রহ আর আনন্দকে সাথী করে মা'র মুখ থেকে আবার শুনতাম গল্পটা। বন্দী হতাম গল্প শোনার মায়াজালে। 

এক গৃহস্ত বাড়ীতে ছিল এক মোটা তাজা বেড়াল। বাড়ির পাশে একটি বেগুন গাছে এক টুনটুনি পাখি তার ছোট ছোট তিনটে ছানা নিয়ে বাসা করেছিলো। প্রতিদিন টুনটুনি পাখি বেরিয়ে যেত খাবারের খোঁজে, ছানা গুলোকে বাসায় রেখে। ছানারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতো কখন মা বাড়ি ফিরবে। দিনের শেষে মা খাবার নিয়ে ফিরত আর ছানা গুলোর সাথে মনের আনন্দে খেত।
একদিন এক দুষ্টু বেড়ালের চোখ পড়ল ছানা তিনটের উপর। বেড়ালের খুব লোভ হোল ওগুলোকে খাওয়ার। বেড়াল প্রতিদিন এসে ঘুরঘুর করতে লাগলো বেগুন গাছটার চারিদিকে। সুযোগ খুঁজতে লাগলো কখন ছানা গুলোকে খাওয়া যায়। 
টুনটুনি পাখি দুষ্টু বেড়ালের এই বদ মতলব টের পেয়ে গেলো। সে যখন প্রতিদিন খাবার এনে তার বাচ্চা গুলোর মুখে ধরত, তখন এ ডাল থেকে ও ডালে, একটু একটু করে উঁচুতে উঠতে থাকতো যাতে বাচ্চা গুলো একটু করে ওড়া শেখে। এমন করে বেশ ক'দিন গড়িয়ে গেলো।
একদিন বেড়াল ভাবল, আর দেরী নয়। আজি সে টুনটুনির বাচ্চা গুলোকে খাবে। সে বেগুন গাছের চারিদিকে জোরে জোরে ঘুরতে লাগলো আর লাফ দেবার জন্য প্রস্তুতি নিতে লাগলো। 
ভয় পেয়ে টুনটুনি তার বাচ্চাদের জিজ্ঞেস করল, বাছারা তোমরা কি উড়তে পাড়বে? বাছারা বলল, হ্যাঁ মা, আমরা উড়তে পারবো। মা বলল, তবে আমাকে দেখাওতো কেমন উড়তে পারো। ঐ দূরে তাল গাছটায় গিয়ে বস। বাছারা তাদের ছোট্ট দুটি পাখা মেলে উড়াল দিল আর তাল গাছটার উপর গিয়ে বসলো। ঠিক সেই মুহূর্তে বেড়াল দিল এক লাফ, একেবারে বেগুন গাছের ডালে। শূন্য বাসা, মাও নেই, বাচ্চারাও নেই। বেগুন গাছের কাঁটায় বেড়াল হল রক্তাত্ত ও ক্ষত বিক্ষত। তার মনের সাধ আর মিটল না। 

আমার বয়স তখন পাঁচ কি ছয়। প্রতিবারই যখন গল্পটা শুনতাম, মনের ভেতর এক চাপা উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষা করতাম শেষটা শোনার জন্য। মা পাখী তার সাহস আর বুদ্ধি দিয়ে দুষ্টু বেড়ালের গ্রাস থেকে তার বাচ্চা গুলোকে বাঁচাত আর বেড়াল পেতো তার প্রাপ্য শাস্তি। যতবারই শুনতাম, এই গল্পের সমাপ্তিটা আমার সহজ, সরল শিশুমনে যেন এনে দিতো এক অপারগ শান্তি আর নিরাপত্তার আশ্বাস। মা'র মুখ থেকে শোনা আরও একটি গল্প আমার খুব প্রিয় ছিল, 'আলিবাবা আর চল্লিশ চোর'। খুব সম্ভবত, বিখ্যাত আরব্য উপন্যাস "সহস্র এক আরব্য রজনীর" মধ্যে এটি ছিল সবথেকে জনপ্রিয় গল্প। কৌশলী আর সুচতুর কাজের মেয়ে মরজিনা, কি করে তার মনিব ও পরিবারকে এক বিরাট বড় ডাকাত দলের হাত থেকে বাঁচায়, তারই এক রোমাঞ্চকর কাহিনী।

আজ মার্চের ২০ তারিখ। আজ  World Storytelling Day  বা 'গল্প বলা দিবস'। ১৯৯১ সালে সুইডেনে প্রথম এই দিবসটির সূচনা হয় এবং ধীরে ধীরে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে, ল্যাটিন আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, কানাডায় এই ধারাটি ছড়িয়ে পরে। এখন সারা বিশ্বেই পালিত হয় গল্প বলা দিবস। এই দিবসটিতে গল্পকাররা তাদের নিজেদের জীবন, শৈশব বা নিজ দেশীয় কোন লোকগাথা থেকে নেয়া সুন্দর সুন্দর কিছু গল্প সবাইকে শোনায়, সবার সাথে শেয়ার করে। তা হতে পারে কোন বাচ্চাদের স্কুলে, কলেজে বা ঘরোয়া কোন অনুষ্ঠানে। কিংবা হতে পারে বন্ধুদের আড্ডায় বা রাতের বেলায় তাদের ছোট্ট বাচ্চাটিকে ঘুম পাড়ানোর আগে। কিছু কিছু দেশ তাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে, লোক মুখে শোনা আর প্রচলিত জনপ্রিয় গল্পগুলো Storytelling Day তে বিভিন্ন উৎসব বা উদযাপনের মাধ্যমে সকলের মাঝে ছড়িয়ে দিতে চেষ্টা করে। তরুণ প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের নিজেদের কৃষ্টি সম্পর্কে ধারণা দেয়। 

বর্তমান সময়ে গল্প বলার চল প্রায় একেবারেই উঠে যাচ্ছে। আর গল্প শোনার ধরনটাও যাচ্ছে পাল্টে। এই যুগে সবার হাতেই আছে স্মার্ট ফোন। ছোট থেকে বড় সবার কাছে এখন ওয়েব সারফিং বেশী জনপ্রিয় আর আনন্দদায়ক। কারো মুখ থেকে গল্প শোনার চাইতে, ইন্টার নেটে, ইউটিউবে বা ডিজিটাল Storytelling এ পশ্চিমা জগতের বাচ্চারা বেশী আগ্রহী। কারন এতে Visual ও দেখা যায়। ধৈর্য ধরে শেষটুকু শোনার কৌতূহলও ওদের অনেক সময় হয়না। আমাদের দেশে গ্রামে গঞ্জে হয়তো এখনো গল্প শোনার আসর বসে চাঁদনী রাতে, বাড়ির উঠোনে। শহর কেন্দ্রিক ব্যস্ত জীবনে যেটা একেবারেই অনুপস্থিত।    

ছোটবেলায় আমার একজন প্রিয় গল্পকার ছিলেন। তিনি আমার বড় ফুপু। খুব ছোট বয়সে আমি আমার বাবাকে হারাই। বাবাকে হারিয়ে আমরা তিন বোন ছিলাম স্নেহের কাঙ্গাল। ভাইয়ের  তিনটে বাবা মরা ছোট্ট মেয়ের স্নেহ আর মমতার টানে তিনি প্রায়ই আসতেন আমাদের বাড়ীতে। আর তিনি এলেই মা তাকে ছাড়তেন না, রাতে রেখে দিতেন। বড় ফুপু এলেই আমরা একসঙ্গে অনেকগুলো গল্প শোনার সুযোগ পেতাম। আমার কাছে মনে হতো, তিনি যেন সাক্ষাৎ ঠাকুমা'র ঝুলি নিয়ে আসতেন। আমাদের জিজ্ঞেস করতেন, কোন ধরনের গল্প শুনতে চাই...রুপকথা,হাসির, রাজা রানী, ভুতের। ভুতের গল্প গুলো বেশীর ভাগ সময় হতো আমাদের দেশের বাড়ি পাবনার (এখন সিরাজগঞ্জ)। আমরা সবাই মিলে বড় ফুপুর চারিদিকে বসে মন দিয়ে, মহা আনন্দে গল্প শুনতাম। একেক বেলায় একেক রকম গল্প, আমি যে কি খুশী হতাম! বড় ফুপু আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন বহু বছর হল। তিনি আর আমার বাবা থাকেন, না ফেরার দেশে। ঐ দেশের গল্পটা আমার জানা নেই।

পেছনে ফেলে আসা দিনগুলোর মধুর স্মৃতি প্রায়ই চোখে ভাসে। কানে বাজে আমার মা'র স্নেহভরা, সুমধুর কণ্ঠস্বর, বাছারা তোমরা কি উড়তে পারবে?... 

আমরা উড়তে শিখেছি, মা আমাদের শিখিয়েছেন। নিজ জীবনে চলার মত সাহস আর শিক্ষা দিয়েছেন। মা এর নীড় ছেড়ে উড়োজাহাজে করে উড়ে আমি অনেক দূর চলে এসেছি। সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপারে  অন্য এক দেশে। কিন্তু মা'র কোলে বসে গল্প শুনতে খুব ইচ্ছে করে। 

যেন আমার মা মাথায় হাত বুলিয়ে বলবেন, "ভয় নেই, তুমি পারবে।"    

Comments

  1. There is a grate relationship between the past and the story telling. It becomes more alive, visual and heart-warming when the story teller is as great as you. You helped me to immerse myself into this enchanting process while cascading through the pearls of our past memories.

    ReplyDelete
  2. টুনটুনি বেড়ালের নাগালের বাইরে উড়ে গেলেও তাকে নতুনভাবে শিখতে হয় কিভাবে বাজপাখি আর ঈগলের থাবা এড়িয়ে সে চলবে। আর এই আত্মরক্ষার কৌশল সে একদিন শেখাবে তার নিজের ছোট্ট ছানাগুলো কে।

    ReplyDelete
  3. তোমার নিবেদনটি পড়ে আমার ছোট বেলার কথা মনে পড়ে গেল। আমার বড় বোন আমাদের গল্প শোনাতেন। আর তার পরিবর্তে তার হাত পা টিপে দিতে হতো। গল্প শোনার লোভে তাই করতাম।
    তোমার লেখার দুটো বৈশিষ্ট্য আছে। এক - তুমি নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার দৃষ্টি ভঙ্গি থেকে লেখ। দুই - কোন একদিক থেকে না দেখে তুমি সমগ্র ভাবে সবকিছু দেখ। আমি নিজে একটু আধটু লিখি, তাই এই জিনিসগুলো আমার চোখে পড়ে। এমনি ভাবে চালিয়ে যাও, আর আনন্দ ছড়িয়ে যাও।

    ReplyDelete
  4. Very nice. You have wonderfully elaborated the whole write up including the story which you heard during your childhood. From this write up, I got to know for the first time that 20th March is World Story Telling Day. Also you have amazingly discussed about story telling and listening in today's time. This is one of your best works. Well done.

    ReplyDelete

Post a Comment