স্বপ্ন ডানা

নিউ ইয়র্ক থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ঠিকানা পত্রিকা, আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে তাদের বিশেষ ক্রোড়পত্রের জন্য আমার কাছে একটি লেখা অনুরোধ করে। লেখালেখি আমার খুব পছন্দের একটি কাজ। তবে আমি নারী হলেও, কট্টর নারীবাদী মনোভাবাপন্ন নই। 

'স্বপ্ন ডানা' নামে আমি একটি লেখা লিখেছি যাতে আমি আমার কিছু ভাবনা, কিছু অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছি খুবই নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে। আমার মতে প্রতিটি মানুষ (নারী ও পুরুষ) এর মন ও মানসিকতা, তার ইচ্ছা-অনিচ্ছা, তার বেড়ে ওঠা, সামাজিক অবস্থান ও সামগ্রিক প্রাপ্তির প্রতিফলন মাত্র। এর কোন 'ঠিক' বা 'ভুল' নেই। দিনের শেষে আমরা কেউ এর বিচার করার সঠিক যোগ্যতা রাখিনা। আমার চোখে যা ঠিক, আর একজন নারীর চোখে তা নাও ঠিক হতে পারে। 

*********************************************************************************

এমন যদি হতো, ইচ্ছে হলেই আমি হতাম প্রজাপতির মত.....  

ছোট বেলায় পড়া কবি সুকুমার রায় এর এই কবিতাটি যেন আমাদের মনের এক সীমাহীন সুপ্ত বাসনার অভিপ্রকাশ। কবি তার কবিতায় বলেছিলেন, আমরা যদি আমাদের ইচ্ছে দিয়ে, শক্তি দিয়ে সব মন্দকে ধ্বংস করে জগতে যা কিছু ভালো তা ছড়িয়ে দিতে পারতাম, তবে খুব ভালো হতো। আজকের নারীরা যেন তাই করে চলেছে। কবি আরও বলেছিলেন, আমরা যদি গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে ছুটে মহাকাশের রহস্য আবিষ্কার করতে পারতাম, তাহলেও খুব ভালো হতো। আজকের নারীরা তাও করে চলেছে। 

এ যুগের নারীরা কি না করছে? মহাকাশে নভোচারী থেকে শুরু করে আকাশে বৈমানিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা থেকে শুরু করে গবেষণার বিজ্ঞানী, আদালতের ব্যরিস্টার থেকে শুরু করে হাসপাতালের সেবিকা, সর্বক্ষেত্রে আজ নারীদের বিচরণ, সাফল্য আর অর্জন। একদিকে তারা সংসারের হাল ধরছে, অন্য দিকে পরিচালনা করছে একটি গোটা রাষ্ট্র। বাড়ির চার দেয়ালের ছোট্ট জায়গাটি থেকে শুরু করে বিশাল জনগোষ্ঠীর দেশ পরিসীমায় নারীদের অবস্থান।

নারী পুরুষ মিলিয়েই আমাদের সমাজ। এই মানব সমাজে নারীদের পরিচয় ভিন্ন, রূপ ভিন্ন - ক্ষেত্র বিশেষে, সম্পর্কের বিচারে। জননী, স্ত্রী, কন্যা, সহোদরা, প্রেমিকা, বন্ধু। কিংবা সহপাঠী, সহকর্মী। তবে নারীরা স্বভাবগত ভাবে ধৈর্যশীল, সুক্ষ বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন আর সংবেদনশীল। তারা ঘরে, বাইরে দু'জগতেই সমান নিষ্ঠা আর পরিশ্রম প্রয়োগ করতে পারে। পুরুষের চাইতে তাদের দেখার চোখ আলাদা, বোঝার ক্ষমতা আলাদা। তাই সময় আর পরিবেশ তাদের অনুকূল হোক বা না হোক, তারা যে কোন পরিবেশে, যে কোন পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। তাদের মধ্যে যেমন আছে আত্মরক্ষার তাড়না, তেমনি আছে আত্মত্যাগের বাসনা। 

খুব দুঃখজনক হলেও সত্যি, ঘরে আর বাইরে নারীদের বাঁধার শেষ নাই। নিজ পরিবার, কর্মক্ষেত্র, অফিস আদালত, স্কুল কলেজ, রাস্তা ঘাট, হোটেল রেস্তোরা সব জায়গায় তাদের জন্য অপেক্ষা করে প্রতিকূলতা আর বৈরী পরিবেশ। তারা হয় লাঞ্ছিত, অপমানিত, নির্যাতিত। একমাত্র সুস্থ সমাজ আর সুস্থ পরিবেশই যে কোন জাতির নারী গোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ নিরাপত্তা আর উপযুক্ত মর্যাদা দিতে পারে। তবে সুস্থ সমাজ গঠনে চাই সুস্থ মানসিকতা যা একমাত্র হতে পারে শিক্ষার মাধ্যমে। শিক্ষার কোন বিকল্প নাই। যে মেয়েটির মনে একটু হলেও শিক্ষার আলো পৌঁছেছে, সে আর কিছু না হলেও ভালো আর মন্দের পার্থক্য করতে শিখবে। যে পুরুষটির মধ্যে একটু হলেও শিক্ষার আলো পৌঁছেছে, সে আর কিছু না হলেও তার চলার পথের সঙ্গী, নারীটিকে সম্মান করতে শিখবে।  

৮ মার্চ ছিল আন্তর্জাতিক নারী দিবস। জাতিসংঘ এ বছর নারী দিবস পালন করেছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিপাদ্য নিয়ে। 'নেতৃত্বে নারী : কোভিড-১৯ বিশ্বে সমান ভবিষ্যৎ অর্জন'। একবিংশ শতাব্দীতে নারীরা তাদের যোগ্যতা, মেধা আর শ্রম দিয়ে সমাজের বিভিন্ন পেশায় এবং কর্মক্ষেত্রে শীর্ষ স্থানীয় পদ অর্জন করেছে ঠিকই। তবে যথাযোগ্য সম্মান পাওয়া বা সমান অধিকার পাওয়া তা সে হোক আর্থিক বা সামাজিক, মৌখিক বা লিখিত, একক বা দলীয়, এই বিষয়টি এখনো অনেক দূরের একটি লক্ষ্য। এই পুরুষ শাসিত সমাজে 'জেন্ডার বৈষম্য' তাই নারীদের জন্য এখনো একটি চলমান যুদ্ধ বা চ্যালেঞ্জ। নারীবাদী মহিলাদের আন্দোলনের মূল প্রতিবাদের ভাষা।

শুধু গুটি কয়েক বা মুষ্টিমেয় কিছু মহিলাদের দিয়ে বিচার করলে হবেনা। একেবারে তৃণমূল পর্যায় থেকে শুরু করে একদম উচ্চপদে অধিষ্টিত হোমরা চোমরা, সবার দৃষ্টি ভঙ্গিতে পরিবর্তন আনতে হবে। এতে সমাজের সকল স্তরের নারী ও পুরুষ দু'এরই ভুমিকা রাখা চাই। ঘরের স্বামী, অফিসের বস, ক্লাসের শিক্ষক, বাড়ির শাশুড়ি, পাড়ার বান্ধবী সকলেরই ভাবনায় পরিবর্তন আনতে হবে। একটি নারী মুখ থুবড়ে পড়লে, তাকে টেনে তোলার দায়িত্ব শুধু একটি পুরুষের নয়, আরও একটি নারীরও। নারী ও পুরুষের মাঝে সমতা আনার দায়ভার শুধু একা নারীদের নয়, পুরুষদেরও।

বেগুনী, সবুজ আর সাদা এই তিনটি রং আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতীক। বেগুনী রং দেয় মর্যাদা ও সম্মান, সবুজ রং আশার আলো আর সাদা রং দেয় শুভ্রতা ও নির্মলতা। প্রজাপতির ডানা না থাকলেও আমাদের নারীদের আছে, স্বপ্ন ডানা। যে ডানা দুটো দিয়ে আমরা আমাদের স্বপ্ন গুলোকে পূরণ করতে চাই, ইচ্ছে গুলোকে পাখা মেলে ধরতে চাই। যে ডানা দুটো আমাদের ওড়ার ক্ষমতা দেয়। আকাশের সীমা, পরিসীমা ছাড়িয়ে, রংধনু পেরিয়ে, দূরে, আরও বহু দূরে। আমার পৌঁছে যাই আমাদের লক্ষ্যে।

Imagine, with all your mind ~ Believe, with all your heart ~ Achieve, with all your might.

Comments

  1. ভালো লাগল নারীদের নিয়ে তোমার ভাবনা।সত্যিই নারীরা কোথায় নেই?

    ReplyDelete
  2. How wonderfully you have illustrated the main reasons to celebrate International Women's Day. Women empowerment should be seen as an intrinsic need, not a desire, to be able to stand along Men in this new fast growing world

    ReplyDelete
  3. I like the way you present your points of view from a neutral stance leading them to fruitful solutions, leaving it to the readers for their own better understanding. You look at things from both sides of the coin. This gives a complete perspective of the matter. Excellent!

    ReplyDelete
  4. A truly invigorating piece of writing. Rightly pointed out that women's empowerment can only be achieved by a concerted effort by the family and society. Unfortunately the societal reflections are pretty dismal. I can only speak for the society I am living in, where we have a long way to go to see the light of hope.

    ReplyDelete

Post a Comment