নায়িকার বিড়ম্বনা
বিশাল বড় ড্রয়িং রুমের এক কোনে সাংবাদিক বসে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। কখন সেলেব্রিটি নায়িকা নীচে নামবেন ইন্টারভিউ দিতে।
হঠাত হন্তদন্ত করে বাইশ তেইশ বছর বয়সী একজন তরুণী ঘরে এসে ঢুকল আর অত্যন্ত উচ্চ স্বরে জানান দিলো কিছু কথা। যার সারমর্ম করলে দাঁড়ায়, আজ ম্যাডামের মন খুবই খারাপ। তাই ইন্টারভিউ তাড়াতাড়ি সেরে ফেললে ভালো হয়।
সাংবাদিক ভাবছে, শুরুই তো করা গেলোনা তা এখন আবার শেষের সময় নির্ধারণ। কি আর করা।
দশ মিনিট পরে সেলেব্রিটি নায়িকা নীচে নামলেন। মুখে প্রচণ্ড কড়া মেকাপ, চুল কিছুটা আগোছালো। বিমর্ষ, ভারাক্রান্ত চেহারা। হাতে লেটেস্ট মডেলের আই ফোন। সাংবাদিক উঠে দাঁড়াতেই নায়িকা হাত ইশারা করলেন বসার জন্য। তাদের দু'জনার কথোপকথোন শুরু হলো।সাংবাদিকঃ- ম্যাম, আমি অশেষ কৃতজ্ঞ আমাকে সময় দেবার জন্য। যতোটা তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি কথা শেষ করবো। ম্যাম, শুনলাম আপনার মন ভালো নেই। একটু কি শেয়ার করবেন কেনো ভালো নেই, যদি না কোন ব্যক্তিগত ব্যাপার হয়ে থাকে?
নায়িকাঃ- না, না। কোন ব্যক্তিগত ব্যাপার নয়। আমার মন আর ভালো থাকে কি করে? আমার কথা কি কেউ মনে করে? আমাকে তো সবাই ভুলতে বসেছে....
সাংবাদিকঃ- ছি, ছি, কি বলেন ম্যাম, আপনি এতো বড় একজন স্বনামধন্য চিত্রনায়িকা, আপনাকে সবাই ভুলে যাবে কি করে?
নায়িকাঃ- তাতে কি? এখন কি আর নায়িকার অভাব আছে? ফেসবুক খুললেই তো খালি নায়িকার ছড়াছড়ি।
সাংবাদিকঃ- সেটা কি রকম?
নায়িকাঃ- এই দেখুন না। এখন তো ঘরে ঘরে নায়িকা। বারো বছরের বালিকা থেকে শুরে করে বাহান্ন বছরের খালা, সবাই এখন নায়িকা। সবার কত রকমারি, ঝকমারি ফেসবুক প্রোফাইল। প্রতিদিন নিউজ ফিড এ নিত্য নতুন ছবি পোস্ট। শুয়ে, বসে, নেচে, গেয়ে, হাসাহাসি, ঝাপাঝাপি আরো কত কি। বন, জঙ্গল, পাহাড়, সমুদ্র, ছাদ, বারান্দা, বাগান, সুইমিং পুলে কত কত ছবি আর ভিডিও। প্রতি পোস্টে হাজার হাজার লাইকস পরে।
অথচ আমাদের কথা ভাবুন। এই অভিনয় জগতে নাম করতে গেলে আমাদের পয়সা খরচ করে পাবলিসিটি ম্যানেজার রাখতে হয়। সাংবাদিকদের সাথে খোশ সম্পর্ক গড়তে হয়। ম্যাগাজিন এ কভার চাইলে এডিটর সাহেবের বাসায় উপহার পাঠাতে হয়। দু'চারটে স্ক্যান্ডালে ও জড়াতে হয়। তবেই না আমদের নিয়ে লেখালেখি শুরু হয়, কানাঘুষা শুরু হয়। ওদের সাথে প্রতিযোগিতায় আমরা ক্রমশ পিছিয়েই পড়ছি।
সাংবাদিকঃ- কিন্তু ম্যাম, সবার তো আর নায়িকা হবার চেহারা, গ্ল্যামার থাকেনা....
নায়িকাঃ- আরে, গুল্লি মারেন আপনার চেহারায়। ঐ যে ফিল্টার না কি যেন বলে, যেটা দিয়ে ছবির ভেতর সবগুলো খুঁত ঢেকে দেয়। তাহলে আর সমস্যা কি? ঐ কারসাজি দিয়ে সবার চেহারা হয়ে যায় ঝকঝকে, গ্ল্যামারাস। ফিগার হয়ে যায় আকর্ষণীয়। আবার শুনেছি, ছবির মাথা কেটে দিয়ে তার উপর নিজের মাথা বসিয়ে দেয়া যায়। ফটোশপ না কি যেন বলে...
আমাদের কষ্ট আর কে বুঝবে? শুটিং এর আগে আমরা ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে মেকাপ করি যেন খুঁত গুলো ঢাকা পড়ে। তারপর ডিরেক্টর এর পছন্দ মত কাপড় পড়ি, ফিগার বানাই। দিনের শেষে শুটিং প্যাক আপ হলে ঘণ্টা ধরে সেই মেকাপ তুলি, গেটাপ খুলি।আর তিনারা কয়েক বার ক্লিক, ক্লিক ক্লিক করেই তেলেসমাতি....সবাই হয়ে যায় বিউটি কুইন ক্যাটরিনা, কারিনা।
সাংবাদিকঃ- তা ম্যাম, আপনিওতো চাইলে সোশ্যাল মিডিয়াতে একাউন্ট খুলতে পারেন। আপনারতো বিরাট ফ্যান ক্লাব হয়ে যাবে।
নায়িকাঃ- তা আর বলতে। সোশ্যাল মিডিয়াতে একাউন্টতো খুলতেই চেয়েছিলাম। গিয়ে দেখি, আমার নাম আর ছবি ব্যবহার করে ইতিমধ্যে ডজন খানেক একাউন্ট আছে। প্রতিটাতেই হাজার হাজার ফলোয়ারস। এখন কে বুঝবে, কোনটা আসল আর কোনটা নকল। আপনিই বলেন ভাই।
সাংবাদিকঃ- তাও তো কথা। তা ম্যাম, আপনার ম্যানেজার বা পিএস, অনলাইন এর ব্যাপারে আপনাকে সহায়তা করতে পারে।
নায়িকা ম্যাডামের চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো।
নায়িকাঃ- পিএস এর কথা আর কি বলবো। আজ যে মেয়েটাকে দেখলেন তাকেতো নতুন রেখেছি। আমার দশ বছরের পুরনো পিএস চাকরী ছেড়ে চলে গিয়েছে।
সাংবাদিকঃ- তাই নাকি? তা কোনো বেতন সংক্রান্ত জটিলতা?
নায়িকাঃ- না, না বেতনের ব্যাপার নয়। সে আমার বেতনে খুশীই ছিলো। হয়েছে কি জানেন।
আমার প্রাক্তন পিএস এখন খুবই ব্যস্ত তার ট্র্যাভেল ব্লগ নিয়ে।
সাংবাদিকঃ- আপনার পিএস এখন ট্র্যাভেল ব্লগ করে?? তা কেমন করে?
বিভিন্ন দেশে ট্র্যাভেল করার অর্থ বা সময়, সে পেলো কিভাবে?
নায়িকাঃ- আমারোতো একই প্রশ্ন ছিলো। সে কি বলল জানেন?
শুটিং এর কারনে সে যখন আমার সাথে বিভিন্ন দেশে যেত আর বহু জায়গা ঘুরে দেখতো, সেই মেয়ে সব গুলোর ছবি তুলে রাখতো। তা প্রায় শ'এ শ'এ ছবি। ওগুলো দিয়েই এখন সে ব্লগ খুলেছে। তার ব্লগে চার হাজার ফলোয়ারস। সে হয়ে গিয়েছে দারুণ বিখ্যাত ভিসুয়াল স্টোরি টেলার। তার এখন আমার জন্য সময় কোথায়? সেও ফেমাস হতে চায়।
সাংবাদিকঃ- কি সাংঘাতিক কথা!
নায়িকাঃ- তা ভালো কথা। আপনি কি চা, নাস্তা খাবেন? খেলে বলেন, দিতে বলি। আমার বাবুর্চি আবার সন্ধ্যা সাতটার পর বাড়ি চলে যাবে।
সাংবাদিকঃ- ওমা, কেনো?
নায়িকাঃ- আমার রান্নার লোকটি বহু দিনের পুরনো। কিন্তু কিছু দিন হলো, সে সন্ধ্যা সাতটার পরে ছুটি চায়। বাড়ি গিয়ে সে তার স্ত্রীকে রান্না ঘরে সাহায্য করে কাটাকুটি করতে। তার স্ত্রীর আছে একটি ইউটিউব কুকিং চ্যানেল। 'বাঙ্গালীর হরেক রকম'। বিশাল পপুলার, একেবারে ফাইভ স্টার রেটিং। ঘরে ঘরে মহিলারা দেখে আর রান্না শেখে।
সাংবাদিকঃ- হায় ভগবান!
ম্যাম, আপনার অবস্থাতো খুবই খারাপ। আপনিতো খুব শিগগিরি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলবেন।
নায়িকাঃ- তাই তো ফেলছি। আর নিতে পারছিনা। চারিদিকে এখন সবাই ফেমাস হতে চায়, Attention পেতে চায় - রূপে, গুনে, কর্মে, কথায়। এতো সব রূপ, গুন, রান্নাবান্না, শিল্পকলা এতো দিন কোথায় ছিলো?
প্রতিদিন এতো এতো সোশ্যাল মিডিয়া সেলেব্রিটি জন্মাচ্ছে। স্ন্যাপ চ্যাট, টিক টক, ইউটিউব, ইন্সট্যাগ্রাম খুললেই যাদের দেখা যায়। খোদ হলিউড, বলিউড, ঢালিউড, টালিউড মিলিয়েওতো এদের সবার জায়গা হবেনা।
এই "Look-At-Me'' ওয়ার্ল্ড এ এখন অসম্ভব প্রতিযোগিতা। কোন দিকে যে যাই বুঝতে পারছিনা।
সাংবাদিকঃ- আচ্ছা, একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি। আগামীতে আপনার কয়টি ছবি মুক্তি পেতে যাচ্ছে, যদি বলতেন?
নায়িকাঃ- এই ছাতামাথা প্যান্ডেমিকের কারনে আমার হাতে ছবির সংখ্যা একদম কম। আর ছবি করলেই বা কি, কেউ তো আর সিনেমা হলে যেতে চায়না। সবাই ঘরে বসে নেটফ্লিক্স, ইউটিউব, অ্যামাজন প্রাইম দেখে।
ঐ যে বললাম, নিজের প্রচারণা করতে আর পরিচিতি পেতে মানুষ এখন কি না করছে। ভক্ত আর ফলোয়ারসদের কৃত্রিম প্রশংসা আর বাহবা কুড়িয়ে মানুষ তাৎক্ষনিক বড় হতে চায়, নিজের সম্পর্কে ভালো feel করতে চায়।
আমাদের হয়েছে শনির দশা। আমরা যারা আসলেই মিডিয়া লাইনে আছি, আমাদের আর কোন কদর নাই। আর পাঁচ দশজনের সাথে কোন তফাত নাই।
সামনে আরো কত কি যে হবে, ভাবতেই পারছিনা। সামনে আমাদের এগারো নম্বর বিপদ সংকেত।
******************************************************************************
হঠাত নতুন পিএস এসে ঘরে ঢুকল। আর নায়িকা ম্যাডাম তড়িৎ গতিতে উঠে দাঁড়ালেন।
নায়িকাঃ- ভাই, ভালো থাকবেন। এখন আমার উঠতে হবে। আমি যাই।
আমার এখন টিউটোরিয়াল দেখার সময়......মেকাপ টিউটোরিয়াল, শহরের একজন ফেমাস বিউটিসিয়ান এটি দেখিয়ে থাকেন।
সাংবাদিক সাহেব কিছুক্ষণ হাঁ করে থাকলেন। তিনি হাসবেন না কাঁদবেন বুঝতে পারলেন না।
Excellent representation of this new ERA, which is making us the victim of "LOOK AT ME". We are under a lot of pressure to be a "DOER" than a human "Being". We are in a serious need to do something, no matter what that thing is. Facebook, Instagram, Snapchat or YouTube is helping us to meet our unmet need from the past in any shape or form. Yes it is helping some of us to quickly become famous but the question is how long lasting will this fame be. As it says "Sudden spark tends to fizzle out".
ReplyDeleteThe main thing is I love your blog and your excellent writing prowess
Fantastic piece. Very funny, but also very relevant to our modern way of life. Keep up the good work!
ReplyDeleteIt is hilarious and amazing at the same time. It has humour and information about new trends that are conveyed through dialogues. The readers can make up their minds as to how they want to interpret this. A very clever piece of write-up.
ReplyDeleteYouTube দেখে আমিও একদিন রান্না করেছিলাম। Video টার শেষ উক্তি ছিলঃ "পছন্দ হলে Like দিতে বা Share করতে ভুলবেন না যেন।" হা হা হা
ReplyDelete