ভ্যালেন্টাইন্স সমাচার

প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাস এলেই আমার টেনশন শুরু হয়ে যেতো। এই বুঝি আমার ছেলেদের স্কুলের শিক্ষিকার কাছ থেকে ইমেইল এলো। আর সেই ইমেইল আসতো বিশাল বড় এক ফিরিস্তি নিয়ে। ক্লাসে কি ভাবে Valentine's Day বা V Day পালন করা হবে তার বর্ণনা নিয়ে।

ফিরিস্তিটা ছিল এই রকম। ক্লাসের মোট ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা এবং নামের তালিকা আসতো। তাদের প্রত্যেকের জন্য Goody Bag বানিয়ে আনতে হবে যার ভেতর Candy এবং পছন্দসই অন্যান্য ছোট খাটো উপহার থাকতে হবে। এই যেমন পেন্সিল, স্টিকার, ছবি, মালা, চুরি ইত্যাদি। প্রতিটি ব্যাগে  গিফটের সাথে একটা করে শুভেচ্ছা  মেসেজও থাকতে হবে।

এটাই শেষ নয়। প্রতিটা ছাত্রছাত্রী তাদের নিজেদের জন্য বাড়ি থেকে একটি Valentine's Box  ডেকোরেট করে বানিয়ে আনবে যার মধ্যে সে অন্যান্যদের দেয়া গুডি ব্যাগ গুলি collect করে রাখবে। পুরো ক্লাসের মধ্যে এই বাক্স গুলোর ভিত্তিতে, সবচেয়ে 'আকর্ষণীয়' বাক্স এবং সবচেয়ে  Funny  বা 'হাস্যকর' বাক্স, সেই দুজন বিজয়ীর নাম ঘোষণা করা হবে। তারা দু'জন ক্লাসের শিক্ষিকার কাছ থেকে বিশেষ পুরুস্কার পাবে।

ঘটনার আদ্যপান্ত শুনে এই মুহূর্তে হয়তো আপনাদের গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। আমার তো ইমেইল পড়েই মাথা ব্যথা শুরু হয়ে যেত এবং শপিং এর কথা চিন্তা করে জ্বর এসে যেত। আমার মাস্টার্স ক্লাসের ফাইনাল পরীক্ষার চাইতেও বেশী কঠিন মনে হতো। প্রোজেক্টটা যেন আমার ছেলের নয়....আমার, এমন অনুভূতি হতো। প্রথম শ্রেণী থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত Elementary স্কুলের বছর গুলোতে এই  celebration  চলত। আমার দুই ছেলের জন্য আমি মোট দশবার এই পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছি।    

ইমেইল এর পর শুরু হতো আমাদের ক্যান্ডি আর গুডি ব্যাগ shopping। সাধারনত ফেব্রুয়ারি মাসে ভ্যালেন্টাইন্স উপলক্ষে আমেরিকার স্টোর গুলোতে রমরমা Sale চলে। লাভ shape, হার্ট shape, red রং, pink রং, প্রতিটা জিনিসেরই বিভিন্ন রকম variety আর বিভিন্ন রকম দাম। Sale এর আগের দাম, পরের দাম। অনেক সময় regular sale এর উপর আবার দশ/বিশ পারসেন্ট ছার। একে বারে মাথা গুলানোর জোগাড়। একবার স্টোরে যাওয়া মানে কমপক্ষে দু'ঘন্টা ঘোরাঘুরি। কারন একবার দোকানে ঢুকলে, কোনো কিছু না কিনে বেরিয়ে আসা একেবারেই অসম্ভব। আমেরিকার Business Model টাই এমন। Consumers দের  emotion  নিয়ে কি করে খেলতে হয় তা এরা খুব ভালো করে জানে। আর এজন্যই আমেরিকানরা এতো Shopaholic

আমি আর ছেলেরা, আমাদের বিশাল ফিরিস্তি নিয়ে গুনে গুনে তাদের দু'জনের ক্লাসের কোন উপহার কয়টা লাগবে তার হিসাব করতাম, আর দোকানের এ মাথা থেকে ও মাথা ঘুরে পছন্দের জিনিসগুলো বাছার চেষ্টা করতাম। আরো একটা কথা। ছেলেরা সব সময় মনে করিয়ে দিতো, সব জিনিসই একটা করে বেশী কিনতে হবে। কেনো বলুন তো? শিক্ষিকার জন্যওতো একটা গুডি ব্যাগ বানাতে হবে!

জিনিস তো কেনা হলো। এবার গুডি ব্যাগের পালা, মেসেজ লেখার পালা। প্রথম দিন চলত তারই প্রস্তুতি। টেবিল এর উপর সব জিনিস বিছিয়ে দিয়ে একটা, একটা করে গোনো আর ব্যাগে ভরো। ছেলেরা এই কাজটিতে খুবই মজা পেতো। ছোট ছোট কার্ড বানিয়ে সে গুলোতে ছেলেদের নিজের হাতে মেসেজ লিখতে হতো। একই মেসেজ,  From  এর জায়গায় একই নাম, To এর জায়গায় খালি নামটা বদল। এই কাজটা অবশ্য সহজ ছিলো।

দ্বিতীয় দিন তৈরি করা হতো ভ্যালেন্টাইন্স বাক্স। কারিগরি পেশায় আমি একেবারেই অজ্ঞ। তবুও, মাথার ভেতর creative  বুদ্ধি যা কিছু আছে তা থেকে হাতড়ে, হাতড়ে, নিংরে বের করে এনে একটা কিছু তৈরি করার চেষ্টা করতাম। আমি না পারলে ওদের বাবাকে এই কাজে সামিল করা হতো। সবাই মিলে বসে চলতো জাদুর বাক্স তৈরির আপ্রাণ চেষ্টা। Finally বাক্সটি দেখতে যেমনই হোক, আমার ছেলেরা মহা উৎসাহে, মহা আনন্দে সেগুলো যত্ন করে Backpack এর পাশে রেখে দিতো পর দিন স্কুলে নেয়ার জন্য। তাদের আনন্দ দেখে আমিও শেষমেশ আনন্দিতই হতাম।

ভ্যালেন্টাইন্স ডে সম্পর্কে এতো কথা বলে, এর ইতিহাস সম্পর্কে কিছু না বললে অন্যায় হবে। ভি ডে'র শুরুটা কিন্তু খুব আনন্দের ছিলো না। ২৭০ এ ডি (270 A.D.) তে রোমান সাম্রাজ্যের নেতা ক্লডিয়াস, তার রাজ্যে সকল বিবাহ যোগ্য ছেলেদের বিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কারন তাদের সকলকে যুদ্ধে যেতে হবে। এতে করে প্রেমিক/ প্রেমিকারা দারুন অসুবিধায় পড়ে যায়। এটা শুনে 'ভ্যালেন্টাইন' নামে একজন পুরোহিত বা পাদ্রী গোপনে এরকম অসংখ্য প্রেমিক যুগলদের বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে থাকে। কারন তিনি ছিলেন ভালোবাসায় বিশ্বাসী। এক সময় রাজা জানতে পেরে ভ্যালেন্টাইনকে জেলে ভরে এবং তার ফাঁসির আদেশ হয়। ওদিকে ভ্যালেন্টাইন ইতিমধ্যে, জেলার সাহেবের মেয়ের সাথে ভালোবাসার বন্ধনে বাঁধা পড়েছে। ১৪ই ফেব্রুয়ারি তার ফাঁসির দিন ধার্য করা হয়। মৃত্যুর আগে তিনি তার প্রেমিকার জন্য চিঠি লিখে যান যাতে লেখা থাকে "ইতি, তোমার ভ্যালেন্টাইন"। এই ঘটনার প্রায় ২০০ বছর পরে এই দিনটিকে সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন্স ডে হিসেবে ধার্য করা হয়।

১৩৮১ সালে একজন কবি প্রথম তার কবিতাতে রোম্যান্টিক ভালোবাসার বর্ণনা দিতে গিয়ে ভ্যালেন্টাইনের সাথে তুলনা করেছিলেন। তারপর থেকে  ১৪ই ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ১৯১৩ সালে হলমার্ক কোম্পানি প্রথম ভ্যালেন্টাইন্স কার্ড প্রকাশ করে। একে একে কালের বিবর্তনে ফুল, চকোলেট, কার্ড, কেক, বই, আংটি, জুয়েলারি নানা উপহার সামগ্রী আদান প্রদানের মাধ্যমে ভালোবাসা দিবসটি পালন শুরু হয়। তবে শুধুমাত্র কপোত, কপোতী নয় বরঞ্চ পরিবারের যে কোনো সদস্য তার পছন্দের, প্রিয় মানুষটিকে এই দিনে উপহার দিতে পারে। এই বিশেষ দিনটিতে বিবাহ অনুষ্ঠান করা, ছেলে মেয়েকে propose করা বা Candle Light Dinner করা পশ্চিমা জগতে খুবই পপুলার কিছু রীতি। সমগ্র আমেরিকাতে এই এক দিনেই রেস্টোরান্ট, শপিং আর গিফট বাবত মিলিয়ন, মিলিয়ন ডলার ব্যবসা হয়।  আমেরিকা ছাড়াও যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, মেক্সিকো, ফ্রান্স, ইটালি, আর্জেন্টিনা, ডেনমার্ক এ এই দিবসটি পালন করা হয়।

আমার ছেলেরা Elementary স্কুলের পাঠ চুকিয়েছে বহু দিন হলো। ফেব্রুয়ারি মাস আসতেই তাই আমার আর টেনশন শুরু হয়না। কিন্তু আমি ভাবি, আজকের যুগে ভালোবাসা যেরকম মেকি আর ফেলনা হয়ে গিয়েছে, যেরকম লেন দেনের হিসাব মাফিক হয়ে গিয়েছে, তাতে ঘটা করে বছরের একটি দিন আমাদের সকলকে ভালোবাসার কথা মনে করিয়ে দিলে ক্ষতি কি? ব্যস্ত জীবনের কোলাহল থেকে একটু সরে গিয়ে নিজেদের আপন জনদের সাথে কিছু সময় কাটালে ক্ষতি কি? ভালোবাসার মোড়কে দেয়া উপহার পেয়ে আপনার প্রিয়জনটির মুখে যে হাসি ফুটবে, তা দেখার সৌভাগ্য থেকে কেন নিজেকে বঞ্চিত করবেন? 

নিঃস্বার্থ ভালোবাসা কি আদৌ আছে? আমি কাকে ভালোবাসি এটা জানা যেমন জরুরী, কেউ কি আমাকে ভালোবাসে এটা জানাও সমান ভাবে জরুরী।  

Comments

  1. This is a great narration and story telling on Valentine's day. I totally agree with you that there is no harm in demonstrating love through making the day special for our valentine's on this day

    ReplyDelete
  2. Your sons will fondly remember the school events, albeit a little tiring, along with their parents' love and support. We don't have that in England, not that I know of. I always admired the courage of St. Valentine and although the event promotes consumerism, there is a sad and sweet story attached to it. Enjoyed reading it to a great extent.

    ReplyDelete
  3. খুব সময়উপযোগী লিখা। হোক না একটু ভালবাসার ছড়াছড়ি একটি দিনকে কেন্দ্র করে।খুব সুন্দর লিখা।সবার জন্য অনেক ভালবাসা ।

    ReplyDelete
  4. খুব ভালো লাগলো লেখাটি পড়ে।

    ReplyDelete

Post a Comment