সামনের সারিতে

লোকটি শক্ত করে মেয়েটির গ্লাভ পড়া হাত চেপে ধরলো। তার শ্বাস প্রশ্বাসে খুবই কষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে ফুসফুস দুটো ওঠা নামা করতে করতে বুকের পাঁজর ভেঙ্গে বেরিয়ে আসবে। ফুসফুস দুটো যেন আর পারছে না, তারা  ছুটি চায়। লোকটি বুঝতে পারলো তার সময় শেষ। ক্ষীণ স্বরে মেয়েটিকে অনুরোধ করলো, তার স্ত্রীর কাছে যেন একটি সংবাদ পৌঁছে দেয়। তিনি মেয়েটিকে বলল, আমি আমার স্ত্রীকে সারা জীবন ভালোবেসেছি। আমি খুব দুঃখিত তাকে একা করে চলে যাবার জন্য। খুবই দুঃখিত, নিয়মগুলো না মানার জন্য....আস্তে আস্তে ঠোঁট দুটো বন্ধ হয়ে এলো। মনিটরে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া সরল রেখায় চলতে শুরু করলো। মেয়েটি জোরে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললো....আরো একজন হারিয়ে গেলো। মেয়েটির দুচোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। মাস্ক আর ফেস শিল্ডের আড়ালে কেউ তা লক্ষ্য করলো না।  

এই মেয়েটির মত আরো অনেকের কথা আমরা গত বছর প্রায় সারাটা সময় ধরে শুনে এসেছি। পশ্চিমা জগতে এদের ডাকা হয় ফ্রন্টলাইন ওয়ার্কার। বাংলায়, সম্মুখ যোদ্ধা। করোনা আক্রান্ত পৃথিবীতে আমাদের সকলের সুস্থ, স্বাভাবিক আর নিরাপদ জীবনের নিশ্চয়তা দিয়ে যাচ্ছে যেই এক বা একের অধিক পেশার মানুষ, তারা হলো সম্মুখ যোদ্ধা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, মৃত্যুর ভয় না করে, মানবতার সেবায় তারা কাজ করে যাচ্ছে বিশ্রামহীন ভাবে। 

সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে এই অকুতোভয় যোদ্ধারা বিশাল প্যান্ডেমিকের সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছে বীর দর্পে। আর পেছনের সারিতে চিন্তা মুক্ত দাঁড়িয়ে আমরা কি একবারো ভেবেছি, প্যান্ডেমিকের শুরু থেকে কেমন কেটেছে তাদের দিন? এই সম্মুখ যোদ্ধাদের জীবন যাত্রা কেমন ছিল ?

ডাক্তার, নার্স, ফার্মাসিস্ট, স্বাস্থ্য কর্মী, জরুরী স্বাস্থ্যসেবা কর্মী, বৃদ্ধাশ্রম কর্মী সবাই ছিল এই যুদ্ধে পুরোদস্তুর সামিল।  তবে এই যুদ্ধে তারা ইচ্ছে করে যায়নি। তাদের ইচ্ছা বা অনিচ্ছার কথা কেউ জিজ্ঞেসও করেনি। সময় আর পরিবেশ তাদেরকে যুদ্ধের মুখে ছুঁড়ে দিয়েছে।  করোনা ভাইরাসের বিশাল থাবা যখন পুরো দুনিয়াটা গ্রাস করলো তখন থেকেই তারা তাদের দায়িত্বের কাছে হলো বন্দী। 

বাড়ি থেকে কাজ করা বা  working from home এর কোনো সুযোগ তারা পাইনি। তারা লম্বা শিফটে কাজ করেছে, ওভার টাইম করেছে। দিনের পর দিন বাড়ি যায়নি। ছুটি বা ভ্যাকেশন এর কথা তারা গুনাক্ষরেও তোলেনি। ফেস মাস্ক, গাউন, ফেস শিল্ড, অক্সিমিটার, ভেন্টিলেটার হয়েছে এদের নিত্য দিনের সাথী। মুখের মাংস পেশীতে বসে গিয়েছে ফেস মাস্ক এর রক্ত বর্ণ দাগ। কাজের থেকে বিশ্রাম তারা তখনই পেয়েছে যখন তারা নিজেরা করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। 

যেসব ডাক্তার আর স্বাস্থ্য কর্মী সরাসরি করোনা ইউনিটে কাজ করেছে তারা দিনের পর দিন বাড়ির কোনে এক ঘরে কোয়ারিন্টিন জীবন কাটিয়েছে, প্রিয়জনদের দূর থেকে ভালোবেসেছে। কেউ কেউ গাড়ীতে রাত্রি যাপন করেছে। তাদের কেউ পরিবারকে দূরে কোথাও পাঠিয়ে দিয়েছে, দিনের পর দিন আপনজনদের কাছে আসতে দেয়নি। কেউ কেউ মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে। তারা চায়নি তাদের কারনে তাদের সন্তানেরা বা বৃদ্ধ বাবা মা অসুস্থ হোক। অনেক নার্স আর স্বাস্থ্য কর্মীরা PTSD, Depression, Anxiety তে ভুগেছে। রাতের পর রাত ঘুমোতে পারেনি, গভীর রাতে দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠেছে।  একটি বিরাট অংশের সম্মুখ যোদ্ধারা জীবন যুদ্ধে পরাজিত হয়ে আমাদের ছেড়ে চিরতরে চলে গিয়েছে পরপারে। তাদের প্রিয় মানুষেরা আর কোনো দিন দেখবেনা তাদের মুখ।

সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে আরো যারা যুদ্ধ করেছে তারা হলো সংবাদপত্র ও গনমাধ্যম কর্মী। ঘরের ভেতর বন্দী থেকে আমরা যখন জানতে চেয়েছি দেশের করোনা পরিস্থিতি কি, কয়জন আক্রান্ত হয়েছে, কয়জন মারা গিয়েছে এরকম বহুবিধ খবর দেশের আনাচে, কানাচে থেকে সংক্রামণের ঝুঁকি নিয়ে এনে দিয়েছে এই সংবাদ কর্মীরা। জরুরী তথ্য আর নিয়মাবলী প্রচার করে গেছে আমাদের সকলের স্বার্থে। 

সকলের নিরাপত্তা ও সুব্যবস্থার নিশ্চয়তা দিয়েছে যে মানুষগুলো তারা হলো আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। মানবতার সেবায় তারাও সম্মুখ যোদ্ধা। লক ডাউন আর কারফিউ এর মধ্যে তারা রাস্তায় রাস্তায় টহল দিয়েছে, আইন অমান্য কারীদের বাধা দিয়েছে, ঘরে ফেরত পাঠিয়েছে। জীবন যাত্রা স্বাভাবিক আর গতিশীল রাখার জন্যে আরো কাজ করে গিয়েছে  ডেলিভারি সার্ভিস, পোস্টাল সার্ভিস, Food Industry এর কর্মীরা। দুনিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে আর্ত মানবতার সেবায় কাজ করে গিয়েছে Humanitarian and Social Service এর কর্মীরা, Emergency Relief Aid রা।

এই সাহসী মানুষ গুলো কোনো বাহবা, ধন্যবাদ বা প্রশংসা চায় না। চায়না কোনো মেডেল বা পুরস্কার। সোশ্যাল মিডিয়াতে নিজেদের কর্ম জীবনের প্রচার আর কৃতিত্বের কথা তারা বলে বেড়ায়না। শুধু শেয়ার করে তাদের দুঃখ ভরা কাহিনী আর না বলতে পারা অনুভূতির কথা। 

তারা এ জগতের বিবেকহীন মানুষদের সাবধান করতে চায়। স্বার্থপর মানুষদের বোঝাতে চায়। তারা চায় আমরা যেন তাদের কষ্ট অনুভব করে, নিয়ম মেনে চলি। আমরা যেন মৃত্যুর কথা স্মরণ করে, নিয়ম মেনে চলি। এই মানুষগুলো মৃত্যুকে খুব কাছাকাছি থেকে দেখেছে। তাই জীবনের মূল্য তাদের কাছে অনেক অনেক বেশী। 

যখন একটি করে জীবন ঝরে যায়, তাদের হৃদয়ে রক্ত ক্ষরণ হয়। বুকের গভীরে ক্ষত চিহ্ন হয়। সময়ের স্রোতে সেই ক্ষত গুলো হয়তো শুকোয়, হয়তো শুকোয় না। তবুও তারা কাজ করে যায় নীরবে, নিষ্ঠার সাথে, সাহসের সাথে। কোনো বৈরী পরিবেশ তাদেরকে থামিয়ে রাখতে পারেনা। 

সম্মুখ যোদ্ধারা, লাখো সালাম তোমাদের।         

Comments

  1. We are going through a global crisis and this is becoming a part of history. Thank you for documenting the relentless & painstaking process our frontline workers, THE HEROES of the Pandemic are going through in a regular basis.
    Hats off to you all.
    We will always be indebted to you all for your selfless contribution

    ReplyDelete
  2. পরিবারে বেশ কয়েক জন সম্মুখ যোদ্ধার জীবন টা যেন দেখতে পেলাম। এই সুন্দর বাস্তব লেখার মাঝে। আরো পড়ার অপেক্ষায় থাকলাম..

    ReplyDelete
  3. মানুষ ছিল সম্পদ আর অস্ত্রের পাহাড় বানাতে ব্যস্ত। এই ক্ষুদ্র ভাইরাস প্রমাণ করে দিল সত্যিকার অর্থে মূল্যবাণ আসলে মানুষের বিবেক আর বুদ্ধি। সম্মুখযোদ্ধার হৃদয় তার সমস্ত শক্তি দিয়ে প্রতিদিন মোকাবেলা করছে এই ভাইরাসের আক্রমণ, আর বিজ্ঞাণীর মেধা আজ এনে দিয়েছে ভ্যাকসিন যা এই অদ্রিশ্য শত্রুকে শেষ পর্যন্ত পরাজিত করবে। তাও মানুষ কি পারবে সম্পদ আর অস্ত্রের মোহ কাটিয়ে উঠতে?

    ReplyDelete
  4. Well done. You have excellently analyzed the struggle of the front line workers. After reading your this write up I have realized that, yes truly we don't think about those people who are working hard to save our lives and make us aware. Today for the first time I got to know that the doctors, health officers, and pharmacists couldn't take leave during the corona period until they themselves were covid positive. One thing has really made me impressed and that is, the front line workers don't talk about their achievements and working life getting publicity in the media, but they only share about their sad story and unsaid feelings. Truly we should think about their risk taking, doing sacrifices, and struggle. Hats off to them. By the way, again this is one of your remarkable write ups. Hats off to you too.

    ReplyDelete
  5. I always thought about these front line workers. The writer portrayed their sufferings with such perfection.

    ReplyDelete

Post a Comment