এক নজরে ২০২০

আমরা সকলেই কেমন যেন ছুটছিলাম। জীবনের তাগিদে ছুটছিলাম। তীব্র গতিতে ছুটছিলাম। আর ভাবছিলাম যে আমাদের হাতে একদম সময় নেই। প্রিয় মানুষ গুলোর জন্য সময় নেই। জীবনকে উপভোগ করার সময় নেই। গুরুজনদের দিকে তাকানোর সময় নেই। ভাব ভালোবাসা প্রকাশের সময় নেই। নিজের জন্য সময় নেই। সব কিছু ভুলে, সব কিছু ছেড়ে যখন পাগলের মত ছুটছিলাম, তখন হঠাত যেন কি একটাতে প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা খেলাম। হোঁচট খেয়ে, মুখ থুবড়ে পড়লাম। ফিরে তাকালাম চারিদিকে। সময়টা যেন থেমে গেলো। আমাদের জীবনটা থমকে দাঁড়ালো।  নতুন করে ভাবলাম সবকিছু। নতুন করে করলাম সব হিশেব নিকেশ। 

বহুবিধ কারনে আমরা কোনো কোনো বছরকে স্মরণ করে রাখি। এই যেমন বিয়ের বছরটা, সন্তান জন্মানো, বড় কোনো অ্যাকসিডেন্ট, বাবা মা'কে হারানো, মনের মত চাকরী, উল্লেখযোগ্য রেজাল্ট  এমন কিছু। এই সব স্বাভাবিক ঘটনা গুলোর পাশাপাশি এ বছরে আরও একটি বড় ঘটনা ঘটেছে। প্যান্ডেমিক। যা এবছরটাকে একদম অন্য রকম করে দিয়েছে। যা আমাদের স্মৃতিতে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ২০২০ সালের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে মনের ভেতর বিভিন্ন ধরণের অনুভূতি দানা বাঁধছে। কোনোটা সুখের, কোনোটা দুঃখের। কি পেলাম, কি দিলাম, কি হারালাম, কি নিলাম তারই একটি নীল নকশা করবার চেষ্টা করছি। কোন দিকের পাল্লা ভারী তা জানিনা।

এ বছরের একদম শুরুতে, জানুয়ারি মাসে আমি পরিবারসহ বাংলাদেশে ছিলাম। দেশে থাকাকালীন আমার ছেলেদের সব চাইতে রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা, চট্টগ্রামের কক্সবাজার এ বেড়াতে যাওয়া। পৃথিবীর সব চাইতে দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত যেই দেশটিতে আছে, তা দেখার সুযোগ আমার ছেলেদের কাছে এনে দিয়েছিল এক বিরাট বিস্ময়। তারা এতদিন গুগোল সার্চ করে যা জেনেছিল তা যেন বাস্তবে রূপ নিয়েছিল। কক্সবাজার এ তিন দিনের সেই ছোট্ট সফরটিতে আমরা অনেক ঘুরে ছিলাম, অনেক আনন্দ করে ছিলাম। সমূদ্রের বিশাল গর্জন, রোঁদে চিকচিক বালি, নীলাভ আকাশ, শামুক ঝিনুকের ছড়াছড়ি, ডাবের পানি, বাতাসের আর্দ্রতা,শুঁটকি মাছের নোনা গন্ধ এ সব কিছুর ভাবনা আমাকে ভীষণ ভাবে nostalgic করে দেয়। ভ্যাকসিন নিয়ে কবে আবার দেশে যেতে পারবো, সেই অপেক্ষায় দিন গুনছি।

আমরা যারা বিদেশে আছি করোনার কারনে তাদের অনেকেরই জীবন যাত্রা ভীষণ ভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। চাকরী, শিক্ষা, চিকিৎসা, ছুটি কাটানো, কেনা কাটা, উদযাপন সব কিছুই আমরা করেছি এবং করে যাচ্ছি বাড়ির চার দেয়ালের ভেতর থেকে। দিনের পর দিন বাসায় থাকতে থাকতে পরিবারের সদস্যদের একে অন্যের প্রতি সহনশীলতা বেড়েছে। একে অন্যের চাওয়া পাওয়ার প্রতি খেয়াল বেড়েছে। এটা নিঃসন্দেহে একটি ভালো ব্যাপার। পরিবারের সকলকে নিয়ে আল্লাহ এর অশেষ রহমতে এখনো সুস্থ এবং রোগ মুক্ত আছি, এটা একটা বিরাট পাওয়া।

লেখালেখি করা আমার  খুবই পছন্দের একটি কাজ। ছোট বেলায় স্কুল, কলেজে থাকতে লেখালেখির অনেক অভ্যাস ছিল। আমেরিকায় এসে পড়াশোনা, চাকরী, ঘর সংসার, বাচ্চা কাচ্চা সামলাতে গিয়ে বহু দিন লেখালেখি থেকে দূরে ছিলাম। ২০২০ এ এসে হঠাত করে প্যান্ডেমিক এর শুরু আর ঘরে বসে থাকা যেন সেই পুরোনো অভ্যাসটিকে খুঁজে নিয়ে আসলো। বহু দিনের ইচ্ছা আমার নিজস্ব একটি ব্লগ এর সূচনা করতে পারলাম, যার নাম দিলাম 'দূরে কোথাও'। আমার খুব ঘনিষ্ঠ জনেরা যারা এই কাজে ক্রমাগত আমাকে ভালোবাসা আর অনুপ্রেরণা জুগিয়ে যাচ্ছে, তাদের কাছে আমি অশেষ কৃতজ্ঞ।

বিজ্ঞান আমার খুব প্রিয় একটি বিষয়। সৌরজগত, মহাকাশ, গ্রহ গ্রহান্তর, নক্ষত্র এসবের রহস্য এখনো পুরোপুরি আবিষ্কার হয়নি। জ্যোতির্বিজ্ঞান এর নিয়ম অনুযায়ী, সূর্যের চারিদিকে ঘুরতে ঘুরতে সৌরজগতের গ্রহগুলি মাঝে মাঝে খুব কাছাকাছি এসে পড়ে। তেমনি একটি বিরল ঘটনা ঘটেছিল গত ২১শে ডিসেম্বর। প্রতি ২০ বছর অন্তর, বিশাল আকার জুপিটার গ্রহ আর বলয়ধারী শনি গ্রহ একদম নিকটে এসে পড়ে। তবে এ বছরেরটা উল্লেখযোগ্য ছিল এই বিধায় যে এ দুটোর মধ্যে দূরত্ব এতোই কম ছিল যা সাধারনত প্রতি ৪০০ বছরে একবার ঘটে। খালি চোখে দেখলে আকাশে একত্রিত অবস্থায় এদেরকে দু'টির জায়গায় একটি গ্রহ বলে মনে হবে। ছেলেদের সাথে দোতালার বারান্দায় দাঁড়িয়ে মিশমিশে কালো আকাশের গায়ে দুটি গ্রহের এই মহামিলন আমি দেখেছি। ছেলেরা তাদের SkyView Lite App ব্যবহার করে এই বিরল ঘটনাটির ছবি তুলেছে। পৃথিবী নামক গ্রহটি ছেড়ে যাওয়ার আগে স্মরণীয় স্মৃতির তালিকায় এটির কথা আমার মনে পড়বে। 

এই করোনা মহামারীতে আমেরিকা, বাংলাদেশ সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বহু মানুষ তাদের আপন জনদের হারিয়েছে করোনার কারনে অথবা অন্য কোনো কারনে। সেই বেদনার ভার তারা বহন করে যাবে জীবন ভর। ২০২০ হবে তাদের জন্য একটি দুঃসহ স্মৃতি। আর যারা করোনায় আক্রান্ত হয়েছে এবং মৃত্যুর দরজা থেকে ফেরত এসেছে, তাদের জন্য হবে একটি নতুন জীবনের সূচনা। জীবনকে উপভোগ করার একটি নতুন সুযোগ। অন্য দিকে, বাড়ির অসহনীয় আর অস্বাভাবিক পরিবেশের মধ্যে যারা বন্দী হয়েছে, নিত্য নির্যাতন আর অমানবিকতার সম্মুখীন হয়েছে, তাদের জন্য আমার অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে সমবেদনা। আগামী বছরটা নিশ্চয় তাদের জন্য অন্য রকম হবে।

বিধাতা যতো ধরনের জীব সৃষ্টি করেছেন তার মধ্যে মানুষ সর্বশ্রেষ্ঠ। কাজেই যে কোনো ধরনের crisiscoping mechanism বের করা মানুষের জন্য একটি সহজ কাজ। আমরা মানব জাতি যে যেভাবে পারি, এই পরিবর্তিত জীবন ধারার সাথে আপ্রান ভাবে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছি। হোক তা কোনো সমাজসেবা মূলক কাজ করে,  দুঃস্থকে আর্থিক সাহায্য করে, রোগীকে চিকিৎসা সেবা দিয়ে, অনলাইনে সামাজিকতার বন্ধন বাড়িয়ে, কোনো সুপ্ত প্রতিভার প্রকাশ ঘটিয়ে, অথবা নিজের আপন জনদের সাথে quality time কাটিয়ে। 

যিনি আমাদের এই দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, যিনি দুনিয়াতে করোনা ভাইরাস পাঠিয়েছেন, তিনি আমাদের এটা সহ্য করবার সাহস এবং শক্তিও দিয়েছেন। আর তাইতো বিজ্ঞানীরা অক্লান্ত পরিশ্রম আর গবেষণা চালিয়ে তৈরি করে ফেলেছে করোনা ভাইরাস এর ভ্যাকসিন। মানব কল্যানে যা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। বিজ্ঞানীরা তাদের কাজটি নিষ্ঠার সাথেই পালন করেছে। বাকি কাজটি করতে হবে আমাদের। বাড়াতে হবে সচেতনতা। হতে হবে সহানুভূতিশীল। 

বিপদ এখনো কাটেনি। আজকে আপনার বিপদ, তো কাল আমার। 
মাস্ক পড়ুন, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন। ভ্যাকসিন গ্রহন করুন। 

সবাইকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা!              

Comments

  1. This global crisis has no doubt made us more resilient, tolerant and above all aware of our own standing & existence.
    You are so right that this challenging experience will some how make as reasses our objectives and focus on what we might want to take away from life

    ReplyDelete
  2. অনেক তথ্য দেওয়া আছে তোমার এই লেখাটিতে।আর তার সাথে আছে বছরের শুরু এবং পেরিয়ে যাওয়ার অনবদ্য বর্ননা।মানুষ যে কি একটা ভয়াবহ সময় পার করছে সেটা যার বাড়িতে করনা হানা দিচ্ছে সেই বুঝতে পারছে।কতো মানুষ হারিয়ে গেল। আল্লাহ সবাইকে ভাল রাখুন। এই দমবন্ধ অবস্থা থেকে মুক্ত করুক আমাদের।আরো লিখার অপেক্ষায় রইলাম। ভাল থেকো।

    ReplyDelete
  3. করোনাভাইরাস সত্যিই আমাদের ফোকাস বদলে দিয়েছে। কি হয়নি তার পেছনে না ছুটে কি আছে তা থেমে দেখবার সময় করে দিয়েছে। সেই কবিতাটা কত সত্যিঃ "দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া, একটি ধানের শীষের উপর একটি শিশির বিন্দু।"

    ReplyDelete
  4. বাহ্।তোমার আশাবাদী লেখাটি পড়ে খুব ভালো লাগলো। ইংরেজীতে একটি কথা আছে 'seeing the big picture', তুমি তাই করেছো। আপাতঃ দৃষ্টিতে যা ক্ষতিকর মনে হচ্ছে তা প্রকৃত ভাবে আমাদের অনেক কিছু শেখাচ্ছে যাতে আমরা আবার নতুন এক পৃথিবী গড়তে পারি। নতুন বছরের অনেক শুভেচ্ছা রইলো।

    ReplyDelete

Post a Comment