ডিজিটাল ভালোবাসা

তাজমহলের কথা আমরা কে না জানি। সম্রাট শাহজাহান তাঁর স্ত্রী মমতাজ মহলের প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন দেখাতে গিয়ে নির্মাণ করেছিলেন তাজমহল। অসাধারণ ভাস্কর্য এই তাজমহলকে বানিয়ে ছিল দুনিয়ার সপ্তম আশ্চর্যের একটি। সাদা মার্বেল পাথরের তৈরি এই স্থাপত্যটি যুগের পর যুগ ভালোবাসার এক অবিস্মরণীয় প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আগ্রা শহরে যমুনা নদীর তীরে। ঐতিহাসিক ভালোবাসার গল্প গুলো আমাদের সকলেরই জানা। এই যেমন লাইলি মজনু, শিরি ফরহাদ, ইউসুফ জুলেখা। এই সব ভালোবাসা গুলোতে অপ্রাপ্তির ব্যথা থাকলেও, এদের গভীরতা যুগে যুগে এদের স্মরণীয় করে রেখেছে। 

আমাদের মত সাধারণ মানুষদের ভালোবাসা ঐতিহাসিক না হলেও, প্রতিটাতে কোনো না কোনো একটি গল্প থাকে। গল্প শুরুর চমৎকার একটি ঘটনা থাকে। থাকে কিছু ব্যথা বেদনা, কিছু প্রতিকূলতা, কিছু বোঝা পড়া, অথবা কিছু আত্মত্যাগ। আরও থাকে অপেক্ষার পালা। তবেই না শেষ পর্যন্ত পাওয়া যায় প্রকৃত ভালোবাসা, পাওয়া যায় ভালোবাসার মানুষটিকে। 

এই যুগের ভালোবাসা ভিন্ন সুতোয় বোনা। বিশেষ করে জেনেরেশন Y এবং জেনেরেশন Z তাদের মনের মানুষ খোঁজার ব্যাপারে অনেক বেশী স্বাবলম্বী, অনেক বেশী স্বাধীন। তাদের অনেকেই অনলাইন ডেটিং এ বিশ্বাসী, যেটা কিনা ফেস-টু-ফেস রোম্যান্স এর পরিবর্তে স্ক্রিন-টু-স্ক্রিন রোম্যান্সকে পরিচালনা করে। সেটা কিরকম?

বর্তমান সময়ে পশ্চিমা জগতের তরুণ তরুণীদের মধ্যে যে বিষয়টি প্রচুর জনপ্রিয়তা পাচ্ছে তা হলো, অনলাইন ডেটিং বা অনস্ক্রিন রোম্যান্স। আমেরিকার কিছু জরীপ যাচাই করে দেখলাম, ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সী ছেলেমেয়েরা শুধুমাত্র বন্ধু/বান্ধবী খোঁজার উদ্দেশ্যে অনলাইন ডেটিং সাইট গুলো ব্যবহার করে। অন্যদিকে ৩০ ঊর্ধ্ব বয়সীরা বা মধ্য বয়স্করা আসলেই তাদের মনের মানুষ খোঁজার লক্ষ্যে এটিতে সাইন আপ বা রেজিস্ট্রেশন করে। ডেটিং সাইট গুলির প্রায় ৫৪% রেজিস্টার্ড সদস্যরা বিশ্বাস করে, অনলাইন ডেটিং যথার্থ সার্থক একটি উপায় প্রেমিক প্রেমিকা পাওয়ার ক্ষেত্রে। আমেরিকার ২০% বিবাহ হয়ে থাকে এই অনলাইন ডেটিং এর ফলশ্রুতিতে। যারা অনলাইন প্রেম করে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়, তাদের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ বা ডিভোর্স এর হার তুলনা মূলক ভাবে কম।

এই ডেটিং সাইট গুলো, অনেক রকম ম্যাচিং অ্যালগরিদম এর ভিত্তিতে যাচাই বাছাই করে সদস্যদের জন্য তালিকা তৈরি করে, যাতে কপোত কপোতীরা তাদের সম মানসিকতার বন্ধু বান্ধবীদের খুব সহজেই বেছে নিতে পারে। নিজের ব্যক্তিগত কিছু তথ্য আর ছবি দিয়ে একটি প্রোফাইল খুলতে হয়। তারপর এই সাইট গুলি একের পর এক ঐ সব তথ্যের সাথে  ম্যাচ করে সম্ভাব্য প্রেমিক/প্রেমিকার সন্ধান দিতে থাকে। মজার বিষয়, কাউকে পছন্দ করলে বা আরো বেশী কিছু জানতে চাইলে, ডান দিকে সোয়াইপ করতে হয়। আর যদি করা হয় বামদিকে, তাহলে সেই সব প্রার্থীর ছবি বা তথ্য আর কখনো সাজেশন হিসেবে আসেনা। পরবর্তীতে এই বাছাইকৃত তালিকা থেকে ছেলেমেয়েরা তাদের পছন্দের মানুষের সাথে চ্যাট বা ভিডিও চ্যাট চালিয়ে যায়। এরপর যদি কাউকে ভালো লেগে যায় বা সত্যি কোনো সম্ভাবনা থেকে থাকে, তাহলে একদিন সামনা সামনি দেখা করা হয়। আরো দূর অগ্রসর হলে গভীর প্রেম, অতঃপর বিয়ে।

ইন্টারনেট দুনিয়াতে যতো গুলো ডেটিং সাইট আছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশী জনপ্রিয় হল - টিন্ডার। খুব অল্প কিছু তথ্য দিয়ে এতে প্রোফাইল খুলতে হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, যারা প্রথম প্রথম স্ক্রিন রোম্যান্স করতে যাচ্ছে তাদের জন্য এটি সব থেকে সহজ এবং নির্ভরযোগ্য স্থান । কারন এই সাইটটি শর্ট টার্ম এবং লং টার্ম দুই ধরনের প্রেমের অপশন দিতে পারে। 

দ্বিতীয় সারিতে অবস্থান করছে - বাম্বেল। বাম্বেলে একটি মেয়ে প্রথমে মেসেজ দেয় এবং ছেলেটি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যোগাযোগ না করলে ছেলেটি তার সম্ভাব্য পছন্দের পাত্রী তালিকা থেকে মেয়েটিকে হারিয়ে ফেলে। মেয়ে বিশেষজ্ঞদের মতে, নির্দিষ্ট সময়সীমার কারনে একটি ছেলে কতটা সিরিয়াস এবং কনফিডেন্ট তার পরিচয় পাওয়া যায়।  

আরো কিছু জনপ্রিয় সাইট গুলোর মধ্যে আছে  হিঞ্জ, ওকে কিউপিড, ম্যাচ, ই হারমনি। এগুলোর একেকটিতে একেক রকমের ব্যক্তিগত তথ্য নিবন্ধন করা হয়। এই যেমন, পছন্দের অভ্যাস বা হবি, ধর্ম বা রাজনৈতিক দলমত, ভবিষ্যতে বাচ্চা নিতে আগ্রহী কিনা, কোন পেশায় ইচ্ছুক, কোন এলাকাবাসী ইত্যাদি। আবার কোনো কোনোটিতে রীতিমতো পার্সোনালিটি কুইজ পাশ করে তবেই অন্তর্ভুক্ত হতে হয়। 

আপনি যদি আমার মত ওল্ড স্কুল বা প্রাচীনপন্থী হয়ে থাকেন তাহলে হয়তো ভাবছেন, কি সাংঘাতিক কথা! একটা সফটওয়্যার কি করে আমার আকাংখার মানুষকে খুঁজে এনে দেবে? আর তার পরামর্শ অনুযায়ী কেনই বা আমি কোনো একজন সম্পর্কে উৎসাহী বা নিরুৎসাহী হবো? আশ্চর্যের ব্যাপার হলো আমি যে ভাবেই চিন্তা করি না কেন, এখনকার ছেলেমেয়েরা কিন্তু এই বাছাই প্রক্রিয়ায় ভীষণ ভাবে নির্ভরশীল। তারা ক্ষতির চাইতে লাভকেই বেশী দেখতে পায় এই কাজটির মধ্যে। তারা নিজেরা যেহেতু এক ধরনের সিদ্ধান্ত হীনতায় সর্বক্ষণ ভোগে, তখন কোনো এ আই বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স তাদের হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে দিলে ক্ষতি কি? তারা ভার্চুয়ালি পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তাদের নেক্সট মুভ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়। কোনো কোনো সময় তাদের জীবন সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়।

গত ফেব্রুয়ারি মাসের এক জরিপে আমেরিকান তরুণ প্রজন্মের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, কেন তারা অনলাইন ভালোবাসায় বেশী আগ্রহী, সামনা সামনি কারোর সাথে পরিচিত হওয়ার আগে? তাদের উত্তর গুলো বিভিন্ন ক্যাটাগরির ছিল এবং সবচেয়ে প্রাধান্য পেয়েছিল যে কয়েকটি বিষয় সেগুলো হল, তারা নিঃসঙ্গ - তারা সামাজিকতায় অভ্যস্ত নয় - তারা কৌতূহলী জানার জন্য কে আছে স্ক্রিনের ঐ পারে - আর কোন কাজ করার নেই বলে - ডেট খুঁজতে এটা খুবই সুবিধা সম্মত উপায় বিধায়। 

কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় না বলে পারছিনা। এই খেলায় অংশ নিতে ছেলেমেয়েরা প্রাথমিক ভাবে তাদের চেহারা বা লুক এর উপর ভীষণ ভাবে জোর দেয়। কারন একটি পারফেক্ট ছবি তাদেরকে নিয়ে যেতে পারে স্বপ্নের রাজকন্যা বা রাজকুমার এর কাছে। 'সেলফি' দেয়া এই ক্ষেত্রে বিশেষ অত্যাবশ্যকীয় একটি উপায়। তবে মূল কথা হল, অল্প সময়ে কাউকে পরিপূর্ণ চেনা কখনই সম্ভব নয়। তাইতো, অল্প চেনার ভিত্তিতে কাউকে বাতিল করে দিয়ে পরের জনের কাছে হানা দেয়া, এসব ছেলে মেয়েদের অভ্যাসে পরিণত হয়। আরো একটি দুঃখজনক ব্যাপার হল, কখনো তারা পরে যায় ধোঁকাবাজদের পাল্লায় যারা কিনা ভুয়া বা ফেক অ্যাকাউন্ট খুলে বসে থাকে পাত্রপাত্রী পটানোর উদ্দেশ্যে। 

"এই শোন না, টুকুনের (কাল্পনিক নাম) বাবার সাথে কেমন করে পরিচয় হোলো, সেই গল্পটা বলি।"... গল্পের বই এ বা নিজের জীবনে আমরা এই ধরনের দৃশ্য বহুবার দেখেছি। চারিদিকে গোল হয়ে বসে গল্পকার এর সেই রোমাঞ্চকর কাহিনী বিভোর হয়ে শুনেছি আর ভেবেছি আহারে, আমার জীবনেও কি এমন হবে? কবে দেখা হবে সেই মানুষটির সাথে? 

লাভ ম্যারেজ না অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ? - এটি ছিল আমাদের সময়ে সবচাইতে আকর্ষণীয় প্রশ্ন। যাদের লাভ ম্যারেজ তাদের যেমন প্রেম করার গল্প আছে, আবার যাদের জীবনে অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ হয়েছে, তাদেরও কোনো একটি দারুন গল্প আছে, প্রথম দেখা হবার। আমার মা আমার বাবাকে প্রথম দেখেছিল তাদের বিয়ের আসরে। শুনেছি, বিয়ের আগে আমার নানী পাত্র পক্ষের বাড়ি গিয়ে ছেলেকে দেখে কথা পাকা করে এসেছিলেন। 

ভালোবাসা আগেও ছিল, ভালোবাসা এখনো আছে। ধরনটা পাল্টেছে, প্রকাশটা পাল্টেছে, আর পাল্টেছে গল্পটা। ~আমাদের সময়ে যেটা ছিল স্বাভাবিক, এখন সেটা সেঁকেলে।~ এখনকার সময়ে যেটা স্বাভাবিক, আমাদের কাছে তা অদ্ভুত।~

"Where did you two meet?" কেউ একদিন এযুগের কাপল কে জিজ্ঞেস করবে।
তারা মৃদু হেসে বলবে,  "Oh! We met on an online dating app" সবাই গোল হয়ে বসে শুনবে সেই হাইটেক গল্প। জানবে, স্ক্রিন টু স্ক্রিন অভিসারের রোমাঞ্চকর বিবরণ। 

Comments

  1. Digital love can only happen in a digital age. This is surely a great contemporary concept. Thoroughly enjoyed reading how LOVE has evolved over the years. The statistics is also very impressive.
    The thing that surprises me most is, that at this age "Emotion is highly dependent on Intellect". I wonder what might happen after this.
    Another superb Piece.

    ReplyDelete
  2. হয়তো নির্বিবাদী Algorithm এখনকার ছেলে মেয়েদের আকৃষ্ট করে। মুরুব্বী Algorithm অযথাই তার নিজের পরিচিত পাত্র/পাত্রী কে ভাল লাগার জন্য চাপ দেবে না, Wingman Algorithm পছন্দের মেয়েটিকে নিয়ে চলে যাবে না, বান্ধবী Algorithm কখনই boyfriend ছিনিয়ে নেবে না। আর ঘটক Algorithm রাজপুত্রের কিংবা অর্ধেক রাজত্ব আর রাজকণ্যার সাথে তড়িঘড়ি করে শুভকাজ সম্পাদন করবেন না। There may be a layer of honesty in AI, তাই না? মমতাজের গাওয়া নাণ্টূ ঘটকের গানটা মনে পড়লঃ

    নাণ্টূ ঘটকের কথা শুইনা অল্প বয়সেই করলাম বিয়া।
    মুরুব্বীরা কইল সবাই no tension, no চিন্তা,
    পাইসো জীবনে দারুণ একটা পোলা।
    পোলা তো নয়, সে তো আগুনের গোলা রে,
    পোলা তো নয়, একখান আগুনেরই গোলা!!!

    ReplyDelete
  3. Yet another brilliant piece on a very relevant and interesting topic. Being in the generation Y demographic, I have personally seen several fruitful relationship developing via online dating sites; and it is widely gaining popularity in the Eastern countries as well in recent years.

    I believe both marriages arranged by ghotoks and the AI of online dating sites have it's own charm.

    ReplyDelete
  4. Very well researched piece of work. Interestingly, I had no knowledge regarding this matter. Thanks a million for the information. Very much appreciate your regular writeups on a wide array of topics. Your blog has helped me think deeper into such important changes in the lifestyle of this generation.

    Although artificial intelligence is taking over human communication, the foremost thing it lacks is the touch of emotion. I believe that without emotion love cannot be in its purest form.


    ReplyDelete
  5. This reminds me of an old ritual that was often put into practice by some people following Hinduism. It was and still is an old version of the digital techniques. The Hindu astrologer would compare the birthcharts of the prospective bride and groom to see if they are compatible, followed by more rituals, i.e, choosing the auspicious moment for getting married or avoiding ill moments during solar or lunar eclipses for the same reason.
    The bottom line is that we all want to be sure if the person we want to relate to on a deeper level is the right one for us. However, despite all the measures taken, through old or new ways, does true love follow suit? Sometimes it does, sometimes it doesn't but 'true love' is always what we seek.
    Thanks for your interesing and informative article with some food for thoughts.

    ReplyDelete

Post a Comment