নীল আমেরিকা??

অনেক ধৈর্য ও সহ্যের অবসান ঘটিয়ে, অনেক গুলো নিদ্রাহীন রাতের ক্লান্তি ঘুচিয়ে, অনেক যোগ বিয়োগের হিসাব মিলিয়ে, আমেরিকার প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনের অবশেষে ইতি ঘটলো। আমেরিকার মাটিতে গণতন্ত্র আবার প্রতিষ্ঠা হল, তবে অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে, চার দিন ধরে চলা হাড্ডাহাড্ডি লড়াই এর মাধ্যমে। যদিও অনেক আশাবাদী নাগরিকের ধারণা ছিল যে ডেমোক্র্যাটদের জন্য এটা একটা Land slide victory হবে, বাস্তবে তা হয়নি। খুব সহজে ডেমোক্র্যাটদের বিজয় অর্জন হয়নি। 

প্যান্ডেমিকের কারনে এবারের ভোটিং প্রথা ছিল অনেক অন্য রকম। মেইল করে ভোট দেয়া মানুষের সংখ্যা অধিক হওয়াতে কোনো কোনো অঙ্গরাজ্যে ভোট গণনা করতে অনেক দেরী হয়েছে। কাজেই নিশ্চিত ফলাফল আসতে ও অনেক সময় লেগেছে। তবে সবচাইতে উল্লেখ যোগ্য ব্যপারটি হল, গত চার বছরে এই দেশটির মানুষেরা তাদের চিন্তা ধারা একটুও পাল্টায়নি। আমাদের বর্তমান প্রেসিডেন্ট এর পপুলার ভোটের সংখ্যা তাই প্রমান করে। সমগ্র জনগোষ্ঠীর সাতচল্লিশ শতাংশ মানুষ (47% of the whole population) এখনো এদেশের বর্তমান প্রেসিডেন্ট এর অনুসারী। 

বৈষম্যবাদ, বর্ণবাদ, বিভাজন, মেরুকরণ, হটকারিতা, মিথ্যা প্রচারণা, আক্রমণাত্মক আচরণ, নারীদের প্রতি অসম্মান, অন্য জাতির প্রতি অশ্রদ্ধা, সংবাদ মাধ্যম ও সংবাদ কর্মীদের প্রতি কটাক্ষ, সুবিধা বঞ্চিত মানুষদের প্রতি অবজ্ঞা, এমন অনেক বহুমাত্রিক নিম্নমানের মানসিকতা বা কর্মকাণ্ডের সাথে যেই মানুষটি ছিল ওতপ্রোত ভাবে জড়িত, তেমন একজন মানুষকে পছন্দ করতে কারো রুচি হয় কি করে? এটা আমার বোঝার একদম বাইরে। বহু বছর ধরে আমেরিকায় বসবাসরত অনেক প্রবাসী বাঙালিরাও বা কি করে তাকে ভোট দেয়ার জন্য মনঃস্থির করে, এটা আমার একদম বোধগম্য নয়। দিনে দিনে মানুষের স্বাভাবিক চিন্তাশক্তি কি লোপ পাচ্ছে?  

আমি এক সময় ভাবতাম, আমেরিকান জাতি মনে হয় বিরাট একটা বাবেল বা গন্ডির মধ্যে বাস করে। এই বাবেল এর বাইরে, সারা দুনিয়াতে কি হচ্ছে এই নিয়ে তাদের বিন্দু মাত্র মাথা ব্যাথা নেই। সারা দুনিয়ার মানুষের দুঃখ, কষ্ট, সমস্যা, অভাব, যুদ্ধ, বিগ্রহ কোনো কিছুতেই তাদের কোনো সহানুভূতি হয়না, দুঃখ প্রকাশ হয়না। হতে পারে, অন্য কোনো দেশের কারনে তাদের নিজেদের জীবনযাত্রা, নিজেদের আর্থসামাজিক অবস্থানে তো কোনো পরিবর্তন আসেনা। তাহলে আর চিন্তা কি? তাদের বাবেলটা তো অক্ষতই থাকে। দুনিয়ার সব থেকে শক্তিশালী আর বিত্তশালী দেশের নাগরিক হিসাবে তারা বাস করে চলে, গর্ব আর দম্ভকে সাথী করে। 

গত চার বছর ধরে এবং বিশেষ করে এই ২০২০ সালে এসে, চারিদিকের ব্যাপার স্যাপার দেখে আমার ধারণার আমূল পরিবর্তন ঘটলো। নিজের দেশের ভেতরে ঘটে চলা এতো ধরণের সমস্যা দেখেও কিছু মানুষের বিন্দু মাত্র বোধোদয় হয়নি। প্যান্ডেমিক, চাকরী হারানো, অর্থনৈতিক মন্দা, সীমিত স্বাস্থ্য সুবিধা, জলবায়ু পরিবর্তন কোনো কিছুই তাদেরকে ভাবিয়ে তোলেনি। হতে পারে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেই বিরাট গন্ডিটি একমাত্র গন্ডি নয়। এই সব মানুষেরা নিজেদের ব্যক্তিগত আরো একটি ক্ষুদ্র পরিসীমার গন্ডির ভেতর বাস করছে যেটা স্বার্থপরতার দেয়াল দিয়ে ঘেরা। যে গণ্ডির ভেতর থাকতে থাকতে আর একতরফা ভাবতে ভাবতে, এরা ভুলেই গেছে কিসে ভালো আর কিসে মন্দ।

আর তাইতো, করোনা ভাইরাস এর প্রকোপে আড়াই লক্ষ আমেরিকানের করুণ মৃত্যুর কথা জেনেও এসব মানুষদের বিজ্ঞান মানার প্রতি শ্রদ্ধা আসেনি। চাকরী হারিয়ে দিনের পর দিন অর্থ কষ্টে জীবন যাপনের পরেও এদের মনে হয়নি, সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্তটি নেয়া উচিত ছিল। মায়ের কোল থেকে শিশুকে ছিনিয়ে নিয়ে তাড়ের বেড়া দেয়া খাঁচায় ভরার দৃশ্য দেখেও এদের চোখে পানি আসেনি। গলার উপর পাড়া দিয়ে শ্বাস রুদ্ধ করে কোনো কৃষাঙ্গকে মেরে ফেলার ভিডিও ফুটেজ দেখে এদের মনে হয়েছে, এসব কালারড (Black, Brown, Indigenous) মানুষেরা এদেশে থাকার যোগ্য নয়। একটি সুষ্ঠ আর নিরপেক্ষ নির্বাচন এর ফলাফল মানতে এরা রাজী নয়। ভোট চুরি আর ভোট গণনায় ভুল আছে বলে এরা সমাবেশ, মিছিল করছে। আর এই সব মাস্ক বিহীন সমাবেশ, বিক্ষোভের মধ্য দিয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে দিচ্ছে সেই অদৃশ্য ভাইরাসটি, যা নীরবে বংশ বিস্তার করছে ঘরে, ঘরে, পাড়ায়, পাড়ায়।

মাস খানেক আগে আমি 'কলম্বাসের আমেরিকা' নামে একটি লেখা প্রকাশ করেছিলাম যেখানে ছিল আমার দ্বিধা, উৎকণ্ঠা। কে হতে যাচ্ছে আমাদের নতুন প্রেসিডেন্ট? এক মাস পরে, আজ এই সন্ধিক্ষণে এসে, আমি নিশ্চিত যে আমরা অবশ্যই একটি নতুন এবং মুক্ত আমেরিকার স্বপ্ন দেখতে পারি। যেই আমেরিকাতে আমি স্বাধীন ভাবে শ্বাস নেব। নির্ভয়ে ভাববো, আমি এদেরই একজন। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, নির্বিশেষে আমরা একত্রিত হবো একটি সম্পূর্ণ জাতি 'যুক্ত রাষ্ট্র' হিসেবে। 

জানুয়ারী মাসে একটি নতুন সূর্যোদয় আমাদেরকে আগামী দিনের আলো দেখাবে, একটি নতুন পথের সন্ধান দেবে। যেই নতুন নেতাটি আমাদের রক্ষা করতে আসছেন, তিনি আমাদের ভালবাসবেন, আশ্বস্ত করবেন। প্রতিদিন সকালে আতংক আর ভয় নিয়ে আর আমাদের দিন শুরু করতে হবেনা যে আজ আমাদের প্রেসিডেন্ট আবার নতুন কি নাটকের সূচনা করলো।

তবুও মনের কোনে কোথায় যেন একটু সংশয় থেকেই গেল। এই ভেবে যে, এদেশের অর্ধেক মানুষ এখনো আমার মত করে ভাবছেনা। তারা বর্তমান প্রেক্ষাপটে খুশী নয়। তারা আমাদের অপছন্দ করে। সাংঘাতিক অপছন্দ করে। তারা মনে মনে চায়, আমরা যেন এদেশ ছেড়ে চলে যাই, কারন এদেশটা শুধু তাদের। আমরা যেন তাদেরটায় ভাগ না বসাই। শিক্ষা, কর্মে, মেধায়, পারদর্শিতায় তাদের থেকে এগিয়ে না যাই। সুযোগ পেলেই তারা একচোট দেখিয়ে দেবে আমাদের। শুধু একটি ইশারার অপেক্ষায়।

জাতিসংঘের ইউনিসেফ সংস্থা আজকের দিনটিকে (20th November) 'বিশ্ব শিশু দিবস' বা  World's Children Day  হিসেবে পালন করছে। তারা বলছে, আজকের দিনটি হল  A day to reimagine a better world for every child. আর তার মধ্যে পড়ে, বিশ্বের সকল শিশুর জন্য শিক্ষা, চিকিৎসা, নিরাপত্তা, মুক্ত পরিবেশ এর নিশ্চয়তা। তাদের এই উদযাপনের থিম কালার  হল  নীল। কারন তাদের ভাষায়,  Feeling blue means feeling and doing good. আমার দুই ছেলের মত এদেশের অধিকাংশ ছেলেমেয়েরা আজকের দিনটিতে নীল রঙের কাপড় পড়ে স্কুল করবে। সোশ্যাল মিডিয়াতে মেসেজ দেবে #GoBlue. তারাইতো আগামী দিনের বাহক। একটি সুন্দর পৃথিবী যাদের কাম্য। 

এই আমেরিকার মাটিতে আমার মত লাখো ইমিগ্র্যান্টদের সন্তানেরা জন্মিয়েছে এবং বড় হচ্ছে। সুদূর ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আমি ভাবছি, আসলেই কি আমরা একটি  নীল আমেরিকার  স্বপ্ন দেখতে পারি? যে দেশে প্রতিটি শিশুর জন্য একটি সুবর্ণ ভবিষ্যতের সম্ভাবনা থাকবে। এই মুহূর্তে ঠিক জানিনা। 

এই আমেরিকার মাটিতে আমাদের ছেলেমেয়েরা আসলে কতটা নিরাপদ? কতটা স্বাধীন? কতটা সমাদৃত?....প্রশ্ন থেকেই যায়।     

Comments

  1. ব্রিটেনে বসে পড়লাম লেখাটি। সংবাদের সাথে আমার তেমন যোগাযোগ নেই - তেমন খবর আমি রাখিনা কারণ ৯৯ শতাংশ negative খবর। কিন্তু এই লেখাটিতে অনেক কিছু সম্বন্ধে অবগত হলাম। সেই সঙ্গে আশা, নিরাশার কথাও পড়লাম। অনেক ধন্যবাদ। আসলে মানব জাতি অনেক সময় discomfort zone এ থাকতে থাকতে সেটাই তাদের comfort zone হয়ে যায়, সেখান থেকে আর তারা সরতে চায়না। তাদের বুদ্ধি, বিবেচনা লোপ পায় - গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেয়, ভালো হবে, কি মন্দ হবে এসব না ভেবেই। কিন্তু আমরা স্বপ্ন দেখি, আশা রাখি আর তাই আমাদের অস্তিত্ব এখনো আছে। এই আলোকে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমেরিকার জনগণকে এবং বিশ্বের সকলকে জানাই আমার শুভকামনা।

    ReplyDelete
  2. N L Wahhab
    Cautiously comprehensive portrayal of the current precarious status of the great USA.
    Hope is the only thing that we can all latch onto by having a positive focus for a peaceful and better future, without any amusing daily soap, which will be missed though

    ReplyDelete
  3. খুবই সমসাময়িক এবং সঠিক পর্যবেক্ষণ!! ক্ষমতা জনতারই হাতে, এই সত্যটি সকল নেতাই কাজে লাগান। ইতিহাসে কোন কোন নেতা জনগনকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন --- নেলসন ম্যান্ডেলা, মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র, আব্রাহাম লিংকন তারই উদাহরণ। কিন্তু ইতিহাসের পাতা ভরে আছে ক্ষমতালোভী, দুরভীসন্ধী অমানুষ দিয়ে। তার উদাহরণ দিয়ে শেষ করা যাবে না --- আমাদের বর্তমান বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রেসিডেন্ট, প্রাইম মিনিস্টার রূপে দেখতে পাই তাদেরকে। এমনকি তারা জনগষ্ঠীর এক বিশাল অংশকে ছলে, বলে, কৌশলে আয়ত্ত করে ফেলে। যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী নির্বাচনী কাঠামো এবারকার মত এক দুরভীসন্ধী নেতাকে প্রতিহত করতে পেরেছে। বেশীরভাগ রাষ্ট্রে সেই নির্বাচনী কাঠামো কলুষিত, তাই জনতা সেই অমানুষদের থামাতে পারে না। আর সাধারণ মানুষ দেয় তার মাশুল।

    ReplyDelete
  4. A well designed piece on portraying the real picture of America and a majority of it's population. I too at times feel they live in a bubble.
    However, here's to hoping for a better tomorrow!

    ReplyDelete

Post a Comment