বাবার কথা (২)

বাবা তুমি ফিরলেনা, শোনালেনা ফেলে যাওয়া  সুর 
আছো কাছে, তবু হায় চলে গেছো কত না সে দূর। ~ 

আমার বাবা খুব সৌখিন মানুষ ছিলেন। শৈশবের কিছু চমৎকার স্মৃতি, আমার বোনদের কাছে আছে। এসবই আমার জন্মের আগের কথা। বাবা খুবই পছন্দ করতেন ছুটির দিনে সবাইকে নিয়ে বেড়াতে যেতে। সিনেমা, পিকনিক, রেস্তোরা অথবা কোনো লং ড্রাইভে যাওয়া, এ সবগুলো ছিল তাঁর পছন্দের তালিকায়। তবে সব চাইতে পছন্দ করতেন মাছ ধরতে যেতে। আমার আপাদের খুব আনন্দদায়ক একটি স্মৃতি, ছোট বেলায় বাবার সাথে নদীর পাড়ে মাছ ধরতে যাওয়া। বাড়ি ফিরে মা'কে বলতেন সেই মাছ রান্না করতে। সবাই মিলে সেই মাছ খাওয়ার আনন্দই ছিল আলাদা। পরিবারকে সময় দিয়ে তিনি পেতেন সন্তুষ্টি, পরিতৃপ্তি।

আপন মানুষদের খুশী করতে তাঁর চেষ্টার অন্ত ছিলোনা। কাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে ঝাঁকা ভরা মুরগী, ঝুড়ি ভরা আম, বিশাল একটি মাছ, এক কাদি ফল, পাঁচ কেজি মিষ্টি এমন অনেক কিছুই কিনে নিয়ে এসে চমকে দিতেন মা'কে। হাসি মুখে প্রকাশ করতেন তাঁর ভালোবাসা, আমদের জন্যে। চোখের পানিতে সেসব কথা স্মরণ করেন আমার মা। একদিন এক কিশোর ছেলেকে বাড়ি নিয়ে এসে উপস্থিত। মা'কে বললেন, ট্যুর শেষে ফেরার পথে লঞ্চ ঘাটে এই ছেলেটির সাথে পরিচয়। বেচারার বাবা-মা নেই, যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। কাজ করে খেতে চায়। তাই বাবা মায়া করে বাড়ি নিয়ে এলেন। সরল বিশ্বাসে যে কাউকেই আমার বাবা বুকে তুলে নিতেন। 

প্রকৃতি কোনো অশুভ ঘটনার আভাস অনেক আগে থেকেই দিতে থাকে। বাবা মারা যাওয়ার মাস খানেক আগে মা'র খুব প্রিয় একটি হীরার আংটি হারানো যায়। আর একবার কাজ থেকে ফেরার সময় বাবা বড় একটি অ্যাকসিডেন্ট এর হাত থেকে বেঁচে যায়। আমরা বুঝতে পারিনি, বিধাতা একটি বড় দুঃখ জনক ঘটনার ইঙ্গিত দিয়ে যাচ্ছিলেন আমাদের। একটি ভয়াবহ পরিণতি অপেক্ষা করছিল আমাদের জন্যে। 

সেই বিশেষ দিনটি এখনো আমার চোখে ভাসে। বাড়ি ভর্তি চেনা অচেনা অনেক লোকজন - আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব, পাড়া প্রতিবেশী। সবার চোখে মুখে তীব্র শোকের ছাপ। বোনেরা পাগলের মত কাঁদছে। মা বার বার জ্ঞান হারাচ্ছেন। কি হচ্ছে বুঝতে না পেরে আমি সবার দিকে ব্যাকুল হয়ে তাকাচ্ছি। সেই অপ্রিয় সত্য কথাটি কেউ আমাকে বলছেনা।

বুকের মধ্যে প্রচণ্ড একটি চাপ...অসহ্য ব্যথা...অসম্ভব অস্থিরতা....হাসপাতালে নেবার কয়েক ঘণ্টা পরেই বাবা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আমার একজন মামা উনার পাশে ছিলেন সে সময়। চলে যাবার সময় বেশী কিছু বলে যেতে পারেননি। শুধু আফসোস করেছিলেন, তাঁর সবচেয়ে কাছের মানুষটিকে সঙ্গী বিহীন করে দিয়ে যাবার জন্যে। হয়তো ভেবে কষ্ট পেয়েছিলেন যে তাঁর সন্তানেরা আর কখনো বাবা বলে কাউকে ডাকতে পারবেনা। জীবনের শেষ মুহূর্তে চোখের সামনে আমাদেরকে দেখে যেতে পারেননি। চলে গেছেন বড় নীরবে, নিস্তব্ধতার মধ্য দিয়ে।

শেষবারের মত যখন তাঁর মুখখানি দেখেছিলাম, মনে হয়েছিল কি শান্ত, স্নিগ্ধ মুখশ্রী। স্মিত হাসি লেগে ছিল তাতে। কি গভীর শান্তিতে তিনি চোখ দুটো বন্ধ করে শুয়ে আছেন। আমি ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠেছিলাম। আমার মনে পড়ে, আমি কাঁদতে কাঁদতে বাবাকে ডাকছি, বাবা শুনছেন না। কেউ আমার বাবাকে আমায় ধরতে দিচ্ছেনা। আমার সমস্ত কান্না, সমস্ত বিলাপ নিষ্ফল আর্তনাদ হয়ে ঘরের চার দেয়ালের মধ্যে ঘুরে ফিরছে, বাবা জেগে উঠছেন না। 

এই বিয়োগান্তক দৃশ্যের সঠিক বর্ণনা আমার জানা নেই। শুধু এইটুকু বলতে পারি, আমাদের সংসারের এক অতি প্রিয়জন তাঁর সব প্রিয়জনদের ছেড়ে যাত্রা করেছিলো এক না ফেরার দেশে। আমরা কেউ তাঁকে থামাতে পারিনি। কোনো প্রিয়জনকে হারানোর বেদনা যে কত তীব্র হতে পারে তা ছোট ছোট তিনটি মেয়ে আর মা'তে, এই প্রথম বারের মত জেনেছিল। 

সৃষ্টিকর্তা তাঁর হাতে গড়া প্রতিটি দিনকে শুভ্র, সুন্দর করে পাঠান আমাদের জন্যে। ১৯২৭ সালের জুলাই মাসের একটি শুভ দিনে তাঁর আগমন ঘটেছিল এই পৃথিবীর মাঝে। ১৯৭৬ সালের নভেম্বর মাসের একটি পবিত্র দিনে তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন, সকলের ভালবাসাকে সঞ্চয় করে। মাঝে রেখে গেলেন তাঁর হাসি, আনন্দ, কিছু ক্ষণ, কিছু সময়। মানুষকে ভালোবেসে আর মানুষের ভালোবাসা পেয়ে যে জীবনে মৃত্যু আসে, সে জীবন ব্যর্থ নয়, তা সার্থকতায় পরিপূর্ণ।

   

"ছেলেবেলার দিন ফেলে এসে, সবাই আমার মত বড় হয়ে যায়।
জানিনা ক'জনে আমার মত, মিষ্টি সে পিছু ডাক শুনতে যে পায়।
আয় খুকু আয়। আয় খুকু আয়।"

হেমন্ত মূখার্জির এই গানটি আমার খুব প্রিয় একটি গান। আমার বোন নাদিয়া লোদী ওয়াহাব এ গানটি গেয়েছে, যা আমাদের বাবার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করলাম।


পাবনার এডওয়ার্ড কলেজে বাবা তাঁর উচ্চ মাধ্যমিক পড়েছিলেন। ২০১৫ সালে দেশে গিয়ে, পাবনায় সেই এডওয়ার্ড কলেজ দেখতে গিয়ে, তার প্রাঙ্গনে দাঁড়িয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে আমি অনুভব করার চেষ্টা করেছি। হয়তো এখান দিয়েই বাবা হেঁটে যেতেন। হয়তো ওখানটাতে বসে বন্ধুদের সাথে গল্প করতেন আর এক সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতেন। প্রতিবার দেশে গিয়ে যখন বাবার কবর যিয়ারত করি, তাঁর মাথার পাশে বসে দোয়া করি, তখন মনে মনে ভাবি - বাবা, তুমি কি শুনতে পাও? তুমি কি জানতে পারো, তোমার সেই ছোট্ট মেয়েটি আজ কত বড় হয়েছে। আকাশের পানে তাকিয়ে সে আজো তারা গোনে।   

অনেক, অনেকদিন আগে "নূর" নামের একজন মানুষ তাঁর সমস্ত দ্যুতি ছড়িয়ে আলোয় আলোকময় করে রেখেছিলেন আমাদের চারজনকে। আজ তিনি আমাদের মাঝে না থাকলেও , ঐ দূর গগন পারে যেথায় নীলের পরে নীল, তারও পরে নীল একাকার হয়ে মিশে আছে, ঠিক তাঁর মধ্যেখানটাতে জ্বলজ্বলে একটি তারা হয়ে জ্বলছেন। রাতের আকাশে যার স্বর্গীয় দীপ্তি সমস্ত জগতকে আলোকিত করে। সেই আলোর পথ ধরে বর্তমানের আমরা এগিয়ে চলেছি আগামী কালের সন্ধানে। 

যে পথের শেষে একদিন আবার দেখা হবে বাবা, তোমার সাথে।  

Comments

  1. A thoroughly beautiful and visceral tribute to our Nana Bhaiya. Whilst we didn't have the privilege of seeing him, he was very much alive to us through the stories told to us by his three daughters, my mum and two Khalas. I feel him with us everyday and feel his presence. I'm sure he would be so proud of you, mum, Boro Khalamoni & Nanima. May Allah bless his soul. You are right in that we will see him again, inshAllah.

    ReplyDelete
    Replies
    1. A piece of him is still alive in you, your name. Nana Bhaiya would have been proud of all his grand children!

      Delete
  2. A beautiful tribute by two lovely daughters. It felt like I was reading a novel about a thoughtful, caring, loving noble man who held his dearest family close to his heart.

    ReplyDelete
  3. The love for your father flows seamlessly throughout this tribute. The caring is obvious, the expression is effortless, and the yearning is heartbreaking. Yet what shines through is the obvious wholesomeness of a wonderful man's relationship with his loving family --- during his short presence, lasting through the years in his absence. As a father, I can say without a doubt that any father would love to live in their children's hearts with such fondness.

    ReplyDelete
  4. Daddy's departure has been one of the most heart wrenching loss in our lives. This piece is full of profoundly painful emotions, which has given me goose bumps. It took me straight back, where I dread to revisit.
    However, I believe that the process of grief & the challenging journey has made us more stronger, self aware, caring and above all modest just like our Father. Daddy you are the real NUR and will always glow strongly in our lives.

    ReplyDelete
  5. This tribute towards Nana bhai reflects so many emotions all 4 of you felt towards him at once.
    Reading this makes me feel a sense of pride to be the grand daughter of such a kind hearted, respected and benevolent man. I thank you,Muna khalamoni, Nanima and ma for making me well acquainted to Nana Bhai through your stories and specially this wonderful piece.
    The writing made my eyes swell up in tears only imagining the pain you all had been through. There is so much to learn from all your struggles and achievement!

    ReplyDelete
  6. বাবার জন্য সন্তানের ভালবাসার যে আকুতি তোমার লিখায় তা চমৎকার ভাবে উপস্থাপন হয়েছে। কি করার আছে আমাদের সব কিছু মেনে অথবা ভূলে থেকে আমাদের পথ চলতে হয়।ভূলে থাকা কি সম্ভব?তাইতো বারবার হারানো বাবার কথা উঠে এসেছে।আর নাদিয়ার বাবাকে নিয়ে গানটি আবার মনটাকে ভরিয়ে দিল।তোমাদের কথা আর গানে উনি বেঁচে থাকবেন অনন্ত কাল ।

    ReplyDelete

Post a Comment